প্রথম পাতা » গল্প » ফেরিওয়ালা

ফেরিওয়ালা

Peddler

ঢাকা কলেজের সামনে দিয়ে যেতে আজ আর কোনো বেগ পেতে হয় না ফরিদের। নিউমার্কেটে আনাগোনার কতো বছর হলো? হবেইতো প্রায় পঞ্চাশ বছর। সেই যে সংগ্রামের বছর শুরু। আজও চলছে। সেদিনের কথা বেশ মনে পড়ে। শেখ সাহেবের ভাষণের কয়দিন পরের ঘটনা। নকুল কাকা জোর করলো খুব। একটা কিছু না করলে চলবো কেমনে? চল,যাই। ঢাকা থেইকা কাপড় আনুম। ছিট কাপড়। গ্রামে গ্রামে সেল দিমু। পরথম কয়দিন একসাথেই ব্যবসা করুম। তারপর আলাদা। নতুন বিয়া করছস। পোলাপাইন হইবো। সংসার বড় হইবো। তাগো মানুষ করন লাগবো। আইলসামি করিছ না ছেমরা চল।

নকুল কাকার কথাগুলান আইজো মনে পড়ে। মনে হয় সেদিনের কথা। বউয়ের কাছে বিদায় নিলাম। বউ যাই। চিন্তা কইরো না। শিগগির ফিইরা আসুম। বউ কাপড়ের অঞ্চল খুইলা কয়টা টেকা দিল হাতে। নেন। কয়টা চুঁড়ি বালাও নিয়া আইসেন। মিয়ামাইনসে কিনবো। আফনের ব্যবসা বাড়বো। আমাগো সংসার একদিন বড়ো হইবো। এইকথাখান কইতে গিয়া বউটা শরমে লাল হয়া গেলো। সূর্যবানুর রং আছিল দুধে আলতা। বিয়ের সময় বয়স কতো আছিল আর? তেরো কি চোইদ্দ! কিন্তুক বুদ্ধি আছিল বিষম! আর আছিল দরদি একখান মন। সে-ও তো চইলা গেলো প্রায় বারো বছর। সূর্যবানু, তুই কি জানস আমি আসমানের চাঁন দেহি না একযুগ! আমি সব কালারের কাপড় বেচিলো, লালজমিনে কালো পাইড়ের কাপড় আমি বিকি দেই না কোনোদিন। আইজ বারো বছর আমি আসমানের তারা দেহি নিয়মমাফিক। কোন তারাডা তুইগো! কোন তারাডা তুই?

নকুল কাকা বুজদার মানুষ আছিল। তা-ও কী যে পাগলামি করলো সেইদিন। ঢাকা তহন গরম। কাকারে কইলাম – ঠাণ্ডা হোক সবকিছু। কয়দিন পরে যাই। না। এতো ডরাইলে চলে না বেটা। রাইতে রাইতে চইলা যামু।দিনে সওদা করুম। আবার রাইতে ফিরুম নিজগাঁয়। রেডি থাকিস। ডরাস কেন তুই?

ইস্টিশনে নামলাম ভোর রাইতে। এইবার হাঁটা দিলাম। নিউমার্কেট গিয়া সকালের খাওন। তারপর সারাদিন কী কী করণ লাগবো নকুল কাকার মুখস্থ। আমি শুনতে থাকি। হাঁটি আর মনে পড়ে সূর্যবানুরে। একলা বৌটা রাইত পার করছে। না জানি কত্ত কাঁনছে। আহা বেচারি!

আমরা নীলক্ষেত মোড়ে। নকুল কাকা সব চিনায়ে দিতাছে। এইটাই ভার্সিটি বেটা। দেশের সব জ্ঞানীরা এহানে থাকে। এইদিক দিয়া সামনে গেলেই নিউমার্কেট। কাকা একটা বিড়ি দেন। নে ধর। বাতি আছে? হ। আগুন কেমন বাউলা পারে। এবার জ্বলে উঠে বারুদ। হঠাৎ সামনে একটা জিপ!কিচ্ছু কওয়া নাই, বার্তা নাই, এলোপাথারি গুলি। দৌঁড়াদৌঁড়ি। লাফ- ঝাঁপ। কতোগুলো জানি না। হাজার হাজার কাউয়া যেন আসমানডা তুইলা ধরলো। চিৎকার। কা কা কা। মুয়াজ্জিনের ডাক। নকুল কাকার চিৎকার আর সেই ডাক একাকার! দুইজনেই ডাকে মালিকরে। এইবার আল্লা যেন শুনলো নকুল কাকার আর্তনাদ। বুকখান ফিনকি দিয়া রক্ত ছাড়ছে। ওপরের পকেটের কয়ডা আধুলি রাস্তার ওপর টুংটাং শব্দে আছড়ে পরে। তারপর কতক্ষণ! আইজ আর মনে নাই। নকুল কাকারে রাইখা ফিরা গেছি নীলগঞ্জে। তারপর নয় মাস। সব বন্দ। চইলা গেলাম বর্ডার পার হইয়া। দেশ স্বাধীন হইলে আবার সব শুরু করলাম।

ঢাকায় যাই আসি একলা। আর ফিরা যায় নাই নকুল কাকা। মানুষটারে কই পুড়াইছে না কবর দিছে তা- ও জানলাম না কোনোদিন। গেরামে গেরামে আইজো একলাই সেল দেই ছিট কাপড়। একলা আসি ঢাকায়। একলাই ফিরা যাই নীলগঞ্জে। কে আছে সেখানে? কেউ নাই। সূর্যবানুও নাই। নকুল কাকাও নাই। রক্তেরই বা আছে কেডা? না থাক। তবু তো সমুস্বরী নদী আছে। কায়ামারা বিল আছে। বড় রাস্তা আছে। আর অভ্যাস আছে। যাওয়া আসার অভ্যাস। এইদেশে মারীতো কম আসে নাই। কলেরা আইছে। হাম বসন্ত আইছে। বান আইছে। ঝড় আইছে। দুর্ভিক্ষ আর দারিদ্র্যও আইছে। সব কি ওপর থেইকা নাইমা আহে? আহে না। জমিনের মানুষেরাও চাপাইয়া দেয় রোগ শোক। নকুল কাকারা চইলা যায়।নিঃসন্তান ফরিদরাও নিঃসঙ্গ হয়। জানপছানের সব যায় একটা একটা কইরা।

আইজ তিনমাস লকডাউন। এইবার ইদটাও করতে পারলাম না। পয়লা বৈশাখ পূজা সব গেলো। আল্লাহ কী আজব গজব দিলো একটা সারার নাম নাই। এই ঢাকা কলেজের সামনে দিয়া লোকে লোকারণ্য থাহে। মাইয়া পোলাগো ভিড়ে খালি শরীল নিয়া যাওয়া যায় না।আর একি গিরিবিলডি শুরু হইলো। লক্ষণ নাই, চিকিৎসা নাই। আজব রোগ এক! ফরিদ এগিয়ে চলে।মহাজন ফোন দিছিল। বারোটার মধ্যে দোকানের সামনে সব রেডি থাকবে। দোকান থাকবে বন্ধ। চুপি চুপি রাতেই সব নিয়ে কমলাপুর যেতে হবে। ভোরের ট্রেন মিস করলে বিপদ বাড়বে। মুখের মাস্কটা খুলে ফরিদ আরাম করে একটা বিড়ি ধরায় এবার। ভাবে প্রায় সত্তর বছর বয়সের জীবনে মাস্কয়ালা রোগ সে দেখে নাই। টগবগে এক যুবা সেদিন ঢাকায় এসেই যে মহাসংকটে পড়েছিল তারপর এই ঢাকা – নীলগঞ্জ ছুটেই জীবন এখন যাওয়ার পথে। কিছুই আর নেই এখন। চাওয়া পাওয়া তো কবেই সমস্বরীর বুক চিরে ভেসে গেছে কোন অজানায়। এখন শুধু অভ্যাসটা আছে। নীলগঞ্জ টু ঢাকা। ঢাকা টু নীলগঞ্জ।

বিড়িটা শেষ প্রায়। কোনো গাড়ি নাই। হঠাৎ হঠাৎ দুই একটা মোটর সাইকেল সাঁ করে চলে যায়। পুলিশের টহলও চোখে পড়ছে না।ফরিদের ফেলে দেওয়া বিড়ির আগুনটা জ্বলছে। ফরিদ মাস্কটা মুখে দিবে এমন সময় দেখে বলাকা সিনেমা হলের সামনে একটা এম্বুলেন্স দাঁড়ালো। কয়টা বাজে এখন? এগারোটা হবে। দুইজন লোক নামলো। পলিথিনের মতো কী সব পরা সারাগায়ে। কাকে খুঁজে? আরো দুইজন নামলো। লাশের মতো কী রাখে? লাশই তো মনে হচ্ছে। একি? এম্বুলেন্সতো চলে গেলো। হায় হায়? লাশ ফেলে চলে গেলো কেন? ফরিদ দ্রুত টহলপুলিশ খুঁজতে থাকে। একটা মোটরসাইকেল ইশারা করে। কাউকেই পায় না সে। এইবার সে লাশের কাছে যায়। মরেনিতো! একটা মহিলা। কাঁশছে। কেমন নিঃশ্বাস নিতে চাইছে। গোঁ গোঁ করছে কেবল। এতো বাতাস তবু সে কেন নিতে পারছে না একটুও? পানি? পানি খাবেন? এইবার মহিলাটির চোখ দুটো যেন বেড়িয়ে পড়ছে। রক্ত ছুটে বের হবে এমন। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চায় কী যেন! আর চায় একটু অক্সিজেন!!

এইবার মহিলাটির সব প্রচেষ্টায় ভাঁটা পড়ে। ধীরে ধীরে নিথর হয়ে পড়ে। ফরিদের মা কলেরায় মারা যাওয়ার সময় একটু পানির জন্য এমন আকুতি করেছিল। কেউ দেয়নি। কলেরার রোগীর পানি খাওয়া মানা। এই মহিলাকে ফরিদের মা ভেবে ভুল হয় তার। ফরিদ তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে। মাথাটি তার হাতের ওপর। মহিলাটি তীব্র আক্রোশে একটু নিঃশ্বাস নিতে চাচ্ছে। দমখিঁচে সে শেষচেষ্টাটুকু করে যাচ্ছে। ফরিদ কী করবে?তাঁকে কোলে নিয়ে কি ছুটবে হাসপাতালের দিকে? নাকি যাবে থানায়? কোনদিকে গেলে এই মহিলা নিঃশ্বাস নিতে পারবে প্রাণভরে? ঢাকাশহরে চাইলেই কি কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারে? এখানে বেচাকেনার ফেরিওয়ালা হওয়া সহজ। কিন্তু মানবতার? মানবতার ফেরিওয়ালা হতে গেলে আসলসহ মুনাফা হারানোর ঝুঁকি প্রবল। মুহূর্তেই সব এলোমেলো হয়ে যায় ফরিদের। ফরিদ মৃত্যুপথযাত্রী মহিলার মাথাটা বুকে জড়িয়ে জনমানবশূন্য স্বজনহীন এক নিথর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষাই করে শুধু।

ফরিদ তাকিয়ে আছে নিয়ন আলোয় রঙিন পিচঢালা রাস্তার দিকে।একদল পিঁপড়া প্রাণপণ লড়ছে গাড়ির চাকায় পিস্ট হওয়া মৃতপ্রায় একটি পিঁপড়াকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার!!

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *