প্রথম পাতা » সেরা » রতন টাটা কেন শীর্ষ ধনীর তালিকায় নেই

রতন টাটা কেন শীর্ষ ধনীর তালিকায় নেই

Ratan Tata

প্রতিবছর বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের যে তালিকা করে ফোর্বস, সেখানকার বেশ কয়েকটি নাম অনেকের মুখস্থ হয়ে গেছে। বিল গেটস, জেফ বেজোস, এলন মাস্ক, মার্ক জাকারবার্গ বা ওয়ারেন বাফেট। ঘুরেফিরে এদের নামই আসে।

অবাক হবেন যে, আরো কিছু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি রয়েছে তারা তালিকার শীর্ষে থাকা ধনীদের চেয়েও বেশি অর্থ রোজগার করে। ভারতের টাটা গ্রুপ এদের মধ্যে অন্যতম।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, রতন টাটা কিন্তু বিল গেটসের চেয়েও বেশি ধনী। তবুও তার নাম তালিকায় আসে না, কেন?

কারণ হলো, টাটা পরিবার এবং কোম্পানিগুলোর আয়ের ৬৫ শতাংশই চ্যারিটিতে দিয়ে দেওয়া হয়।

তার বিভিন্ন কোম্পানির লভ্যাংশ চ্যারিটিতে যোগ হয়, তার ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নয়।

টাটার ব্যক্তিগত সম্পদের মূল্য কখনও ১ বিলিয়ন ডলারের সীমারেখা ছাড়ায় না।

টাটা গ্রুপ ভারতের ব্র্যান্ডিংয়ে অনন্য। আর এই ব্র্যান্ডিংয়ে সবচেয়ে বড় অবদান রতন টাটার। অর্ধশত বছর ধরে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন টাটা গ্রুপের জন্য, তিলে তিলে বড় করেছেন গ্রুপকে।

১৬০ বছরের পুরোনো এ প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের ১০০টি দেশের সঙ্গে ব্যবসা করে। এই অনন্য প্রতিষ্ঠানটির ২১ বছর ধরে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন রতন টাটা। এ সময়ে টাটা গ্রুপের আয় বেড়েছিল ৪০ গুণ। আর মুনাফা বেড়েছিল ৫০ গুণ।

টাটা গ্রুপের মানবকল্যাণে অনুদান কেবল ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সেগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থাতেও গিয়েছে। টাটা গ্রুপ হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে ৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছিল। এটাই কোনো আন্তর্জাতিক ডোনারের কাছ থেকে পাওয়া সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ। বোস্টনের ক্যাম্পাসে অ্যাকাডেমিক এবং বসবাসের ভবন নির্মাণে ওই অর্থ প্রদান করা হয়েছিল।

বাড়িতে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে টাটা বানিয়েছে হোম পিউরিফিকেশন সিস্টেম। এটা নামমাত্র মূল্যে (মাত্র ১০০০ রুপি) বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করা হয়। টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস লিমিটেড এমন একটি সফটওয়্যার বানিয়েছে যার কোনো নিরক্ষর মানুষকে মাত্র ৪০ ঘণ্টার মধ্যে পড়তে শেখায়।
টাটা গ্রুপ তার কর্মীদের আধুনিক পেনশন সিস্টেম, চিকিৎসা সেবা, মাতৃত্বকালীন ছুটি আর আরো অনেক সুবিধা প্রদান করে।

বিখ্যাত তাজ হোটেলে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় টাটা গ্রুপ সেখানকার কর্মীদের হতাশার মধ্যে ফেলেনি। ওই উত্তপ্ত সময়জুড়ে কর্মীরা নিয়মিতভাবে তাদের বেতন-ভাতা পেয়েছেন।

২৪ ঘণ্টার দিনটাকে চার ভাগে ভেঙে তার শুধু একটা ভাগ অফিসকে দিতে হবে, বাকি সময়টা পুরোপুরি আপনার— কর্মীদের এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিস (টিসিএস)।

জামশেদপুরে টাটা মোটরস প্রাঙ্গনের ভিতরে একটি ব্লাড ব্যাঙ্ক আছে (অন্য প্ল্যাটের ভেতরেও আছে)। আপনি যদি এক বোতল রক্ত ​​দান করেন, তবে শুধুমাত্র সেই দিনের জন্য আপনাকে ছুটি দেওয়া হবে না, আপনি রক্ত ​​দেওয়ার সাত দিনের মধ্যে অতিরিক্ত ছুটিও পেতে পারেন।

অনেক কর্মচারী তাদের ছুটি বাড়াতে এটি ব্যবহার করে। তাই এখানে রক্তের অভাব নেই কখনো! বলাই বাহুল্য, এই নীতির কারণে টাটা কয়েক ম্যান-আওয়ার হারায়, যার জন্য কোম্পানির আর্থিক লোকসান হয়৷

একবার, কোম্পানির কর্মচারীদের সাথে কথোপকথনের সময়, রতন টাটাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল,

“লোকেরা আপনাদের এই নীতির অযাচিত সুবিধা নেয়, এর কারণে আমাদের কয়েক হাজার কর্ম-ঘন্টা সময় নষ্ট হয়। শরীরে রক্তদানের পর রক্ত ২৪ ঘন্টার মধ্যে পুনরায় পূরণ হয়, আপনি এটি জানেন। তাহলে কেন রক্তদানের ৭ দিনের মধ্যে অতিরিক্ত ছুটি দিতে হবে।”

রতন টাটা হাসলেন, (যেমনটা তিনি সবসময় করেন) এবং তারপরে একটি অত্যন্ত শান্ত উত্তর এলো…

“উৎসাহ এমন একটি জিনিস যা আমার আপনাকে শেখানোর দরকার নেই… শুধুমাত্র কয়েকজন লোক রক্ত দান করে কারণ তারা সেটা দিতে চায়। ম্যান-আওয়ার সম্পর্কে কথা বললে, আমরা কিছু ম্যান-আওয়ার হারাতে পারি। আপনি এটা বলছেন, কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন যে, প্রয়োজনের সময় সেই রক্তে বহু ব্যক্তির জীবন যোগ হয়? আমি মানবতার ভালোর জন্য আমাদের কিছু ম্যান-আওয়ার স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।”

মানবকল্যাণে টাটার এমন দানবীয় পরিমাণে বিনিয়োগের উদাহরণ অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করতে পারেনি। এ কারণেই টাটাগ্রুপের কর্ণধারের নাম সেরা ধনীদের তালিকায় আসে না।

এর বিপরীতে বাংলাদেশের শীর্ষ গ্রুপগুলোর কর্মীদের কথা একটু চিন্তা করেন। যেখানে কর্মীরা এই অতিমারীর সময়টা সারাক্ষণ চাকরি হারানোর ভয়ে কাটিয়েছে। কতজনের তো চাকরি চলেও গেছে।

ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে ঝুলানো টু-লেটের সাইনবোর্ড আমাদের প্রমাণ দেয় কত অসংখ্য পরিবার এ শহর ছেড়ে চিরতরে চলে গেছে। অথচ পোশাক শিল্পের মালিকেরা নাকি সরকারি প্রণোদনা পেয়েও ফ্যাক্টরি চালু রাখতে পারছিল না

দুই তিন পুরুষের পুরনো শিল্পগোষ্ঠীরাও টাটার উদাহরণ অনুকরণ করে না বাংলাদেশে। তারা লসই কাটিয়ে উঠতে পারে না কখনো। ফিলানথ্রপি তো অনেক পরের ব্যাপার।

পুনে কলেজের এক অনুষ্ঠানে তরুণদের উদ্দেশ্যে নাকি রতন টাটা একবার বলেছিলেন, ‘ডোন্ট বি সো সিরিয়াস। এনজয় লাইফ অ্যাজ ইট কামস।’

এই জীবনকে উপভোগের বিষয়টাই তো আসল, তাই না?

সেরা থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *