সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম সেরা সৃষ্টি প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক, অভিযাত্রী, গবেষক– কী নন তিনি! টমাস আলভা এডিসন এবং নিকোলা টেসলার বাঙালি ভার্সন।
তিনি ৬৯টি ভাষায় পারঙ্গম, ৭২টি আবিষ্কারের আবিষ্কর্তা, হায়ারোগ্লিফিক পড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন, মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার দুর্বোধ্য লিপির পাঠোদ্ধারকারী।
সত্যজিৎ রায় কাল্পনিক এই প্রতিভাবান বাঙালি বিজ্ঞানীকে নিয়ে ৩৮টি ছোট-বড় গল্প লিখেছেন। ফেলুদার তুলনায় খ্যাতি একটু কম হলেও শঙ্কুকে অগ্রাহ্য করা এক কথায় অসম্ভব।
১৯৬১ সালে সত্যজিতের চল্লিশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত হয় তার পারিবারিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’ এর তৃতীয় সংস্করণ। সন্দেশ এর পাতা ভরানোর উদ্দেশ্যেই সত্যজিৎ রায় প্রফেসর শঙ্কুকে সৃষ্টি করেন।
১৯৯০ সালে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত ‘স্বর্ণপর্ণী’ গল্পে শঙ্কুর যে আত্মজীবন কথা আছে, সেই অনুসারে হিসেব করলে দেখা যাবে তিনি ১৯১১-১২ সাল নাগাদ জন্মেছিলেন।
এদিকে আবার ১৯১২ সালেই প্রকাশিত হয়েছিল আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ – প্রোফেসর চ্যালেঞ্জারের এক আশ্চর্য রোমহর্ষক অভিযান কাহিনি। কালস্রোতে হারিয়ে যাওয়া এক আদিম পৃথিবী দেখে এসেছিলেন প্রোফেসর চ্যালেঞ্জার।
নিজের লেখা বাংলা গল্পের ইংরেজিতে অনুদিত বইয়ের ভূমিকায় ১৯৮৭ সালে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, শঙ্কু আসলে ‘mild-mannered version of Professor Challenger’।
তদানীন্তন বিহারের (অধুনা ঝাড়খণ্ড) গিরিডিতে প্রফেসর শঙ্কু স্থায়ীভাবে বাস করতেন। পিতা শ্রী ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু পেশায় ছিলেন একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। গিরিডিতে জনপ্রিয় এই চিকিৎসক গরীব-অভাবীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতেন।
প্রফেসর শঙ্কু গিরিডির এক স্কুল থেকে মাত্র ১২ বছর বয়সে ম্যাট্রিক, ১৪-তে কলকাতার কলেজ থেকে আইএসসি এবং ১৬ বছর বয়সেই ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিতে ডবল অনার্সসহ বিএসসি পাশ করেন।
বিএসসি পাশের পর পিতার ইচ্ছায় বছর চারেক বেদ, উপনিষদ, আয়ুর্বেদ সহ বিভিন্ন সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। তারপর মাত্র ২০ বছর বয়সেই কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।
শঙ্কু চিরকুমার। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী নিউটন নামের পোষা বেড়াল ও কাজের লোক প্রহ্লাদ। প্রতিবেশী বিজ্ঞান-বিমুখ অবিনাশবাবু। কিন্তু বিজ্ঞান বিমুখ হলে কী হবে, কখনও কখনও সেও হয়ে যায় প্রফেসর শঙ্কুর অভিযানের সঙ্গী। প্রফেসরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের তালিকায় রয়েছেন জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেলম ক্রোল, ইংরেজ বিজ্ঞানী সণ্ডার্স ও অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী নকুড়বাবু।
কোনান ডয়েলের প্রোফেসর চ্যালেঞ্জার ভীষণ রাগী। সকলেই তাঁকে ভয় পায়। শঙ্কুর প্রথম গল্প ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ তে শঙ্কুও বেশ বদরাগী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। চাকর প্রহ্লাদের সামান্য ভুলে, রেগেমেগে নিজের আবিষ্কৃত স্নাফ-গান বা নস্যাস্ত্র প্রহ্লাদের গোঁফের কাছে প্রয়োগ করেছিলেন শঙ্কু!
শঙ্কু একজন আবিষ্কর্তা, একজন ইনভেন্টর। প্রফেসর শঙ্কুর মোট ৭২টি আবিষ্কারের কথা জানা যায়। এই তালিকায় রয়েছে নানা আজব বস্তু। এই সব আবিষ্কার ও তাদের নামকরণের ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়ের ভাষাপ্রীতি ও কৌতুকবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।
কী কী আছে এই তালিকায়! দেখে নেওয়া যাক।
১. মিরাকিউরলঃ স্বর্ণপর্ণী নামে এক গাছড়ার পাতা থেকে তৈরি সর্বরোগহর বড়ি। মড়া মানুষ বাঁচানো ছাড়া আর সব অসুখেরই সমাধান এই বড়িতে। এর কৃতিত্ব অবশ্য শঙ্কু নিজে নিতে রাজি নন। কারণ, এই গাছড়ার সন্ধান দিয়েছিলেন এক সাধুবাবা।
২. অ্যানাইহিলিনঃ চার ইঞ্চি লম্বা আশ্চর্য পিস্তল। শত্রুর দিকে তাক ঘোড়া টিপলেই দুষ্টু লোক ভ্যানিশ।
৩. সমনোলিনঃ ঘুমের ওষুধ। একবার খেলেই ১০ মিনিটের মধ্যে নাকডাকা ঠেকায় কে?
৪. রিমেমব্রেনঃ লুপ্ত স্মৃতি ফিরিয়ে আনার যন্ত্র। পরীক্ষার হলে একবার কাছে পেলে মন্দ হতো না।
৫. ল্যুমিনিম্যাক্সঃ জোরাল আলোর ল্যাম্প। ব্যাটারি বা বিদ্যুৎ ছাড়াই দিব্যি চলে।
৬. শ্যাঙ্কোপ্লাস্টঃ এটা যে ঠিক কী, সেটা শঙ্কু নিজে বলে যাননি। তাঁর শেষ গল্প ডেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনায় এই জিনিসটির নাম শোনা যায়। তবে সে গল্প অসমাপ্ত।
৭. ইনটেলেক্ট্রনঃ বুদ্ধিমত্তা মাপার যন্ত্র।
৮. স্নাফ গান (নস্যাস্ত্র): শঙ্কুর তৈরি বন্দুক। রক্তপাত ঘটায় না, প্রাণেও মারে না। শুধু একটানা দু’দিন নাগাড়ে হাঁচি হতে থাকে। ‘গান্ধীবাদী অস্ত্র’ বলা যায়।
৯. বিধুশেখরঃ রোবট অত্যাধুনিক রোবট। শঙ্কুর বিপদে কারও নির্দেশ ছাড়াই ‘অ্যাকশন’-এ নামতে পারে। বিধুশেখর সাধু ও চলিত বাংলায় কথা বলতে পারে। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের ধারণার হাতে-কলমে ব্যবহার।
১০. ভয়ের স্বপ্ন দেখার ট্যাবলেটঃ আইডিয়া এসেছিল মহাভারতের ‘জৃম্ভণাস্ত্র’ দেখে। খেয়ে ঘুমালে এমন ভয়ের স্বপ্ন আসবে, যে চুল-দাড়ি পেকে যাবে একরাতেই।
১১. ফিশ-পিলঃ মাছের বিকল্প বড়ি। নিউটনের খাদ্য। এমনই স্বাদ যে, একবার খেলে পরের বার মাছ ফেলে বড়িই বেছে নিতে বাধ্য মার্জারকুল।
১২. বটিকা-ইন্ডিয়াঃ বটফলের রস থেকে তৈরি খিদে-তৃষ্ণানাশক ওষুধ। এক ট্যাবলেটে দামোদর শেঠরা পর্যন্ত তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবেন।
১৩. নতুন ধরনের কাগজ-কালিঃ ‘ব্যোমযাত্রীর ডাইরি’ অর্থাৎ, শঙ্কুর প্রথম গল্পে এই ধরনের ডাইরির উল্লেখ মেলে। শঙ্কু এই ডাইরি এবং কালিতেই লিখতেন। সেটা যে তাঁরই আবিষ্কার করা, সেটা কোথাও বলা নেই। তবে যে ডাইরি আগুনে পোড়ে না, তবে পিঁপড়ে খেয়ে ফেলতে পারে, আবার কালির রং ঘনঘন বদলায়— এমন ডাইরি শঙ্কু ছাড়া আর কে বানাতে পারেন?
১৪. সুগন্ধীঃ ছত্রিশ রকমের ফুলের নির্যাস মিশিয়ে তৈরি। ঘরে ছেটালেই মেজাজ ফুরফুরে।
১৫. অদৃশ্য হওয়ার ওষুধঃ উপাদান বলতে, এক্সট্র্যাক্ট অফ গরগনাসস, প্যারানইয়াম পোটেনটেট। সোডিয়াম বাই কার্বনেট, বাবুইয়ের ডিম, গাঁদালের রস, টিঞ্চার আয়োডিন।
১৬. কার্বোথিনের গেঞ্জিঃ জামার নীচে পরে থাকলে শক লাগে না।
১৭. মাইক্রোসোনোগ্রাফঃ মানুষের কানে পৌঁছোয়ে না যে সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শব্দ, সেগুলো শোনা যায় এর দৌলতে। এমনকি পিঁপড়ের ডাক পর্যন্ত।
১৮. এয়ার কন্ডিশনিং পিলঃ গরমে শীত আর শীতে ঠান্ডা লাগে এই ট্যাবলেট পকেটে বা জিভের তলায় রাখলে।
১৯. ইলেকট্রিক পিস্তলঃ ৪০০ ভোল্টের শক। অবশ্য কার্বোথিনের গেঞ্জি পড়ে থাকলে এই পিস্তল কাবু করতে পারবে কি না , সেকথা শঙ্কু বলে যাননি।
২০. পোলার রিপলেয়ন থিয়োরিঃ জিনিসটা কী, খায় না মাথায় দেয়, সেটা লেখা নেই কোত্থাও। নিশ্চয় জটিল কিছু হবে। উল্লেখ পাওয়া যায় ‘শঙ্কু ও খোকা’ গল্পে।
২১. নিওস্পেক্ট্রোস্কোপঃ ভূত দেখার যন্ত্র। সঙ্গে ভূতের সঙ্গে কথাবার্তার সুযোগ ফ্রি।
২২. রোবুঃ অত্যাধুনিক সর্বজ্ঞ রোবট। বানাতে খরচ পড়েছিল ৩৩৩ টাকা সাড়ে সাত আনা মাত্র।
২৩. লিঙ্গুয়াগ্রাফঃ এই যন্ত্রে কোনও ভাষার কথা রেকর্ড হয়ে তিন মিনিটের মধ্যে অনুবাদ হয়ে যায়।
২৪. অ্যানাস্থিসিয়ামঃ নয়া কিসিমের বন্দুক। ট্রিগার টিপলেই সামনের শত্রু কয়েক ঘণ্টার জন্য অজ্ঞান।
২৫. ক্যামেরাপিডঃ এতে রঙিন ছবি তোলা হয়ে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে বেড়িয়ে আসে প্রিন্ট আউট। যখন এই ক্যামেরার কথা লিখেছেন শঙ্কু, তখনও কিন্তু পোলারয়েড ক্যামেরা আবিষ্কার হয়নি।
২৬. ঘ্রাণশক্তি বাড়ানোর ইঞ্জেকশনঃ নামকরণ করে যাননি শঙ্কু।
২৭. শ্যাঙ্কোভাইটঃ মাধ্যাকর্ষণ বিরোধী ধাতু। শূন্যে দিব্যি ভেসে থাকতে পারে।
২৮. শ্যাঙ্কোপ্লেনঃ শ্যাঙ্কোভাইট দিয়ে তৈরি বিমান।
২৯. টার্বোলিনঃ শ্যাঙ্কোভাইটের জ্বালানি। গন্ধ চন্দন কাঠের মতো। যে হারে দাম বাড়ছে পেট্রোল –ডিজেলের, তাতে পরখ করে দেখা যেতেই পারে।
৩০. তৃষ্ণাশকঃ তেষ্টা মেটানোর বড়ি।
৩১. কফি পিল, টি-পিলঃ কফি এবং চায়ের বিকল্প বড়ি। কাপ হাতে সুড়ুত শব্দে চুমুকের মজাটা হবে না হয়তো, তবু ঠেলায় পড়লে চায়ের অভাবে মন্দ কী?
৩২. ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম প্রাণঃ সঙ্গী ছিলেন বৈজ্ঞানিক হামবোল্ট।
৩৩. অরনিথিনঃ পাখিদের শেখানোর যন্ত্র।
৩৪. অক্সিমোর পাউডারঃ পাহাড়ে উঠতে অক্সিজেনের অভাবে যাতে কারও কষ্ট না হয় তাঁর দাওয়াই।
৩৫. কম্পুঃ কথা বলার কম্পিউটার। বানাতে শঙ্কুর সাথে হাত লাগিয়েছেন দেশ বিদেশের নানা বৈজ্ঞানিক।
৩৬. সেরিব্রিলান্ট, নার্ভিগারঃ নার্ভ চাঙ্গা রাখার ওষুধ।
৩৭. এভিলিউটনঃ মানুষকে বিবর্তনের ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যায়।
৩৮. কম্পুডিয়ামঃ প্রেতাত্মা নামানোর যন্ত্র।
৩৯. এক্স এবং অ্যান্টি এক্সঃ সুস্থ মানুষকে কয়েক মিনিটের মধ্যে হিংস্র দানবে পরিণত করে এক্স। অ্যান্টি-এক্স দিয়ে ফের তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।
৪০. মার্জারিনঃ বিড়ালের আয়ু বাড়ানোর ওষুধ। যা খেয়ে নিউটনের আয়ু হয়েছে স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি।
‘স্বর্ণপর্ণী’ গল্পে শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন, ‘বৃদ্ধ নিউটন আমার পায়ের পাশে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে ঘুমোচ্ছে। ওর বয়স হল চব্বিশ। বেড়াল সাধারণত চোদ্দো-পনেরো বছর বাঁচে; যদিও কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিশ বছর বেঁচেছে এমনও শোনা গেছে। নিউটন যে এত বছর বেঁচে আছে তার কারণ হল আমার তৈরি ওষুধ মার্জারিন।’
প্রফেসর শঙ্কুর অভ্যাস ছিল ডায়েরি লেখা। ১৯৯২ সালে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় তাঁর শেষ দুটি অসমাপ্ত ডায়রি ‘ইন্টেলেকট্রন’ ও ‘ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা’ প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর থেকে তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
প্রশ্ন হল, প্রফেসর শঙ্কু আজ কোথায়? ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ গল্পটি পড়ে জানা যায়, তিনি বহু বছর ধরে নিরুদ্দেশ। কেউ কেউ আবার বলেন, কী এক ভীষণ এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
আবার এও শোনা যায়, তিনি আসলে বেঁচে আছেন বহাল তবিয়তে। ভারতবর্ষের কোনও এক অজ্ঞাত অখ্যাত অঞ্চলে গা ঢাকা দিয়ে চুপচাপ নিজের কাজকর্ম করে চলেছেন। সময় হলেই নাকি আত্মপ্রকাশ করবেন।
চমৎকার লেখা।
প্রফেসর শঙ্কুকে নিয়ে মুভি হয়েছে, “প্রোফেসর শঙ্কু ও এল ডোরাডো”।
আপনার লেখা পড়ে মুভিটা দেখার আগ্রহ তৈরি হলো।
আরো লেখা চাই।