প্রথম পাতা » বিনোদন » চে’র বিপ্লবীসত্তা : প্রিয় মামুনুর রশিদ

চে’র বিপ্লবীসত্তা : প্রিয় মামুনুর রশিদ

Mamunur Rashid

আরণ্যকের ঋষিতুল্য মানুষটির নাম মামুনুর রশিদ। নিজ হাতে গড়া দেশের প্রথম সারির নাট্যদল আরণ্যকের প্রধান কর্তাব্যক্তি প্রিয় মামুনুর রশিদ গতকাল ১৮ পেরিয়ে ১৯- এ পা রাখলেন চিরতরুণ এই গুণী নাট্যযোদ্ধা। তাঁর বয়স ৭৬ বছর! অথচ জন্মদিন পার করলেন মাত্র ১৮ টি! ১৯৪৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ. পাশ করেন মামুনুর রশিদ। গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।

যুদ্ধ শেষে শুরু করলেন আরেক যুদ্ধ- নাট্যচর্চা। স্বাধীন বাংলাদেশে গড়ে তুললেন নাটকের দল – আরণ্যক নাট্যদল। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় যাঁরা দেশকে ভালোবেসে গেয়ে গেলেন মানবতার জয়গান তাঁদের একজন তিনি। রাজনীতি-অর্থনীতির মোহে নিজেকে বিলিয়ে দেননি। অর্থের পেছনে ছুটলে হতে পারতেন দেশের শীর্ষ ধনাঢ্য ব্যক্তি, ব্যবসা করলে হতেন শীর্ষ ব্যবসায়ী, হতে পারতেন সরকারি বড় আমলা কিংবা রাজনীতির শিকারী। তিনি কিছুই হননি। হয়েছেন বিপ্লবী, করেছেন শ্রেণী-সংগ্রাম।

মামুনুর রশিদ নাট্যচর্চার পদাঘাতে দূর করতে চেয়েছেন অপসংস্কৃতি, নাটককে কেবল বিনোদন নয় করেছেন সংগ্রামের হাতিয়ার। নাট্যচর্চায় জীবনের গানের সাথে যোগ করেছেন বিপ্লবের রসদ। মঞ্চের উইংসের আড়ালে থেকেও সমাজকে তুলে ধরেছেন নির্মোহ দৃষ্টিতে। নিজেও অভিনয় করেছেন। নাটক লিখেছেন। নির্দেশনা দিয়েছেন। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮২)। স্বৈরশাসনের কারণে প্রত্যাখ্যান করেছেন সেই পুরস্কার। অভিনয়ে পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। যারা ‘মনপুরা’ সিনেমা দেখেছেন তারা জানেন কী দুর্দান্ত খল অভিনেতা তিনি। ২০১২ সালে তাঁর নাট্যচর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন ‘একুশে পদক’। এখনো নাটকপাগল এই মানুষটি নিয়মিত মঞ্চে অভিনয় করেন। তাঁর হাত ধরে এদেশে তৈরি হয়েছিল নব্বই দশকের প্রতাপশালী অভিনেতা তুষার খান, আজিজুল হাকিম, আজাদ আবুল কালাম, বৃন্দাবন দাশ, তারিন, তাজিন, তমালিকা, সালাউদ্দিন লাভলুরা। আরণ্যকের সৃষ্টি চঞ্চল চৌধুরী, আ খ ম হাসান, শামীম জামানরা হালের ক্রেজ হলেও তারা মামুনের সাগরেদ।

‘ময়ূর সিংহাসন’ নাটকে ‘দিলীপ’ চরিত্রে মামুনুর রশিদের অভিনয় বিস্ময়কর। এখনো এতো কঠিন ও দীর্ঘ সংলাপ তিনি মুখস্থ রাখতে পারেন যা রীতিমতো বিস্মিত হতে হয়। ‘সঙক্রান্তি’, ‘রাঢ়াঙ’, ‘চে’র সাইকেল’ নাটকে অভিনয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন তিনি। এখনো তরুণ টগবগে যুবকের মতো অভিনয়ে ব্যস্ত তিনি। আসলে তাঁর পেশাটাই এমন যে এখান থেকে অবসর হয় না। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই কেবল যবনিকা পতন হতে পারে। তবে মামুনুর রশিদরা মরেও অমর হয়ে থাকেন। তাঁদের অসমাপ্ত কাজ চলে যায় নবনাট্যযোদ্ধাদের হাতে। শুরু হয় আরেকটি অধ্যায়, আরেকটি দৃশ্য।

মামুনুর রশিদের অনেক নাটক আমি দেখেছি। নাটকের দলের সাথে যুক্ত ছিলাম। তাঁকে কাছে থেকেও দেখেছি। দেশ নিয়ে দেশের মানুষ নিয়ে তাঁর নাট্যভাবনা অনুভব করেছি। দেশ বিদেশে তাঁর নাটক প্রশংসা কুঁড়িয়েছে। মামুনুর রশিদ এখনো একটি নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্ন দেখেছিলেন শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরীরা। হয়তো তাঁর সেই স্বপ্ন থেকে যাবে অধরাই।

মামুনুর রশিদ বৈষয়িক মানুষ ছিলেন না। নিজের জন্য কিছুই করেননি। যারা থিয়েটার করেন তাদের দৈন্যদশা আমি জানি। তবে তিনি চাইলে অনেক কিছু করতে পারতেন। করতে চাননি। আসলে সেই পথেই তিনি হাঁটেননি। তাই তাঁর বাবা আক্ষেপ করে বলেছিলেন : ‘তুই কবে একটা চাকরি বাকরি করবি? অনেকে ডিসি এসপি হইতেছে। তুই তো কিছুই হইতে পারলি না!’

মামুনুর রশিদের বাবা হয়তো জানতেন না এইদেশে হাজার হাজার ডিসি এসপি আছে, কিন্তু মামুনুর রশিদ আছে কেবল একজন!

তাঁর জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা।

বিনোদন থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *