সৈয়দ আলী আশরাফ সাহেব অবসর জীবনে প্রবেশ করলেন গত বছর মে মাসে। সরকারি চাকরি করতেন। চাকরি সরকারি হলেও তিনি তেমন ‘সুবিধা’ করতে পারেননি। শহরতলীতে মাত্র তিন শতক জমি কিনেছেন। তবু রাস্তা নিয়ে নানা সমস্যা। আড়াই ফুট প্রশস্ত রাস্তা তিনি উচ্চদামে কিনে নিয়েছেন। পায়ে-হাঁটা পথ। দুই ব্যাগ বাজার করলে দুই হাতে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে যাওয়া যায় না। পাশের দেয়াল ঘেঁষে যেতে হয়। আঙুলের ছাল উঠে যায়। সরুগলি দিয়ে প্রবেশ করার সময় মনে হয় তিনি পুলসিরাত পার হচ্ছেন।
বাইশ ফুট দীর্ঘ রাস্তা পার হলে তাঁর বাসা- ‘সৈয়দ মনজিল’। কথিত আছে আলী আশরাফ সাহেবের প্রপিতামহ এসেছিলেন আরবদেশ থেকে। এ নিয়ে তাঁর বাবা সৈয়দ আলী আসগর নানা গল্প করতেন। আলী আশরাফ বাসাটি তাঁর স্ত্রীর নামে দিতে চেয়েছিলেন। সৈয়দ আলী আসগর দিতে দেননি। সৈয়দ বংশের নানা মোজেজা বলার পর তিনি হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন : ‘নারী জাতিরে এতো উপরে তুলবা না। এরা হইল নেংটিছাড়া মাতবর। বৌয়ের নামে কোনোদিন জমিজমা করবা না। বাড়ির নাম দেও- ‘সৈয়দ মনজিল’। আলী আশরাফ বাবার কথা রেখেছেন।
এই বাসায় উঠার আটদিন পর সৈয়দ আলী আসগর মারা গেলেন। তিন শতকের ছোট বাসা হলেও আলী আশরাফ সুন্দর করে গড়েছেন। ছাদে নানারকম ফুল-ফল-সবজি দিয়ে ভর্তি করেছেন তাঁর স্ত্রী। এই বাসায় ঢুকলে বাইরে যেতে মন চায় না। আবার বাইরে গেলে বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে না। আসা-যাওয়ার মূল সমস্যা তাঁর এই ভূতের গলি। আলী আশরাফ মনে ভাবেন তাঁর পুরো জীবনটাই সরুগলির মতো। এখানে কোনো প্রশস্ততা নেই। না কর্মের, না সৃষ্টির। কর্মক্ষেত্রেও সংকীর্ণ স্টোরে জীবনটা কাটিয়ে দিলেন।
চাকরিজীবনের পঁয়ত্রিশটা বছর তিনি হাবিজাবি জিনিসের রেজিস্ট্রি করলেন। জিনিস শেষ হলে আবার কেনা হতো। আবার খালি হলে নতুন রেজিস্ট্রি। এসবের হিসেব করেই জীবনটা ব্যয় করলেন। টুকিটাকি বদনা বালতির হিসেব রাখার জন্য একটি জীবন ব্যয় করার কি দরকার ছিল পৃথিবীতে? তাঁর ধারণা তিনি বেহেশতে যাবেন এবং সেখানেও তাঁর জন্য যে ঘরটি দেওয়া হবে তা হবে সরুগলির। রাস্তা নিয়ে সেখানেও একটা ঝামেলা হবে। প্রশস্ত রাস্তার সুন্দর একটি বাড়ি আল্লাহ তাঁকে দেবেন এমন কোনো সৎকাজ তিনি এখনো করতে পারেননি। তাই তাঁর ইচ্ছা বাকি সময়টা সৎকাজে ব্যয় করার।
মানুষকে চিনতে হবে। তাদের জানতে হবে। জীবনকে উপভোগ করতে হবে। তিনি তীর্থে বেড়িয়েছেন। মানুষের বিচিত্র জীবন দেখে তিনি উপলব্ধি করবেন ভালো মন্দের তফাত। মাঝে মাঝে আট দশদিন করে বাড়িতে আসেন না। প্রথম প্রথম পরিবারে নানা ঝামেলা হতো। এখন তারা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেকে গতমাসে বিয়ে দিলেন। ছেলের নতুন সংসারে তার মা নানা কিছু নতুন বৌকে শেখাচ্ছে। শেখানোর আনন্দে স্ত্রী স্বামীর থাকা না থাকা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। এখন আলী আশরাফ সাহেব নির্বিঘ্নে তীর্থে বেরুতে পারছেন। আজ তিনি যাবেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। সেখানকার জীবনগুলো দেখা দরকার। তিনি সকাল সকাল বের হলেন।
শহরের বড় রাস্তায় রিক্সায় ঘুরতে ভালো লাগে আশরাফ সাহেবের। তিনি আজমপুর থেকে যাবেন এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে ট্রেনে করে যাবেন কমলাপুর। তারপুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো তাড়া নেই। তবে ট্রেন মিস করলে বিপদ। ট্রেনে আজকাল কী হচ্ছে তা-ও দেখা দরকার। জীবন একেক জায়গায় একেক রকম। ট্রেনের জীবন আর বাসের জীবন একরকম নয়। আবার রিক্সার জীবন কিংবা ঠেলাগাড়ির জীবনও এক নয়। সবই দেখতে হবে। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। এখন তাঁর হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে হয় না। আউট-ইন এর হিসাব কেউ রাখে না। সার্ভিস বুকও ক্লোজড। সো নো তাড়াহুড়া।
বড় রাস্তার গলির মুখে একটি রিক্সা পাওয়া গেলো। তবে রিক্সাওয়ালার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে সে সাধারণ কেউ না। যাত্রীর সিটে বসে নিজের সিটে পা তুলে সিগারেট খাচ্ছে। মাথায় লম্বা চুল। লম্বা, বাঁকানো গোঁফ। যেতে বললে এখন সে যাবে না মনে হচ্ছে। অন্য রিক্সাও নাই। একে তো বলতেও মন চাচ্ছে না। ট্রেন ধরতে পারবেন না ভেবে তিনি বললেন : যাবে?
– কই যাইবেন?
-এয়ারপোর্ট
-ভাড়া বাড়ায়ে দিবেন
-কেন?
-রোইদ বেশি
-মাত্র বাজে সাড়ে আটটা। রোদ কোথায়?
-আপনের বয়স বেশি। রোইদ মজা লাগে। আমার কাছে লাগে জ্বলন্ত আগুন। আপনের লগে ক্যাঁচালে যামু না। অন্য রিক্সা দেখেন।
আলী আশরাফ চারপাশে তাকালেন। কোনো রিক্সা নেই দেখেও অন্য রিক্সার কথা বলছে। তার মানে এ যাবে না। কিন্তু উপায় কী?
– আচ্ছা বলো কতো নিবে?
– চল্লিশ টেকা দিবেন
– এখান থেকে এয়ারপোর্ট দেখা যাচ্ছে। তুমি ভাড়া চাচ্ছো চল্লিশ টাকা। এটা কোনো কথা?
– এইখান থেইকা তো আসমানও দেখা যায়। চল্লিশ টেকা দিয়া পারবেন যাইতে?
আলী আশরাফ লজিক্যালি চিন্তা করলেন। এই লোকের লজিক ভালো। না, এর রিক্সায় উঠতে হবে। জীবন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
– আচ্ছা চলো। তবে বিড়িটা ফেলে দাও। গন্ধ সহ্য হয় না।
পরপর দুই তিনটা টান মেরে রিক্সাওয়ালা সিগারেট ফেলে দিল। রিক্সা চলছে। আশরাফ সাহেব মজা পাচ্ছেন। রিক্সাওয়ালার জীবন সম্পর্কে জানতে হবে।
– তোমার নাম কী?
– সিরাজউদ্দৌলা
আশরাফ সাহেব বিষম খেলেন। সিরাজউদ্দৌলা ঢাকায় রিক্সা চালাচ্ছে বিষয়টা কেমন যেন লাগলো। লোকজন নামধাম একটু হিসাব করে রাখবে না? শুধু সিরাজ হলেও তো হতো! একেবারে সিরাজউদ্দৌলা?
– তা তোমার বাড়ি কোথায়? বাড়িতে কে কে আছে?
– বাড়ি মুর্শিদাবাদ। বাড়িতে আছে বেগম আলেয়া আর গোলাম হুসেন।
আলী আশরাফ মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন না। শুরু থেকেই এই বদমাশটা ফাজলামো করছে। শেষ ফাজলামোটা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি একজন মুরুব্বি। মুরুব্বির সাথে এ ধরনের বেয়াদবি মেনে নেওয়া যায়?
-তোমাকে ধরে একটা থাপ্পর দেওয়া দরকার। আমার সাথে ইয়ার্কি কর।
রিক্সাওয়ালা রিক্সা থামালো। সে নামলো। আশরাফ সাহেব হকচকিয়ে গেলেন। সকাল বেলাতেই এক উটকো ঝামেলা তৈরি হলো। তিনি একথা না বললেও পারতেন। কী দরকার থাপড়া থাপড়ির? সিরাজউদ্দৌলা ঢাকায় রিক্সা চালালে ক্ষতি কী? সিরাজ বেঁচে থাকলে এর চেয়ে কতোই আর ভালো হতো? শুধু শুধু একটা ঝামেলায় জড়ালেন। এখন রিক্সাওয়ালা যদি তাঁকে ধরে বসে উপায় কী হবে? রিক্সাওয়াকা কোমরে গামছা বাঁধলো। তারপর তাঁকে অবাক করে দিয়ে সে বলতে লাগলো :
– ‘তোমার আদেশ আমি ভুলি নাই দাদাভাই। এখনো উপায় আছে বেগম আলেয়া, গোলাম হুসেন। আমার শরীরে শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত এ শৃংখলিত জাতিকে আমি অবমুক্ত করবো। তাদের গলায় পরাবো বিজয়ের মালা। হা হা হা !’
স্যার, ভয় পাইছেন। আমি খারাপ মানুষ না। যাত্রাপালার পাঠ গাই। সিরাজের পাঠ। আপনের সাথে একটু মজা করলাম। ঘাবড়ায়েন না। যাত্রা করে ফাতরা লোকে। এগুলা কইরা সব শ্যাষ করছি। জমিজমা বেইচ্চা এখন পথের ফকির। ফকির সিরাজউদ্দৌলা।
বলেই সে হাসতে শুরু করলো। এমন হাসি আলী আশরাফ জীবনে শোনেননি। হঠাৎ তিনিও হাসতে শুরু করলেন। একেবারে প্রাণখোলা হাসি। হাসি থামলে আশরাফ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন :
– তা সিরাজউদ্দৌলা, তোমার আসল বাড়ি কোথায়?
– বাড়ি স্যার জামালপুর। আমার আসল নাম মোবারক হুসেন।
-স্ত্রী, ছেলে মেয়ে আছে ?
– স্ত্রী দেশের বাড়ি থাকে। আমার কোনো সন্তান নাই স্যার। একটা ছেলে আছিল গতবছর বর্ষার সময় পানিতে ডুইবা মারা গেলো। আড়াই বছর বয়স আছিল।
আশরাফ সাহেব দেখলেন গামছার খুট দিয়ে মোবারক হুসেন চোখের জল মুছলো। রিক্সা এয়ারপোর্ট এসে গেছে।
আশরাফ সাহেব লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কাটলেন। এখনো দশ মিনিটের মতো সময় হাতে আছে। স্টেশনেও বিচিত্র জীবন দেখা যায়। কতো রকমের লোক থাকে এখানে। কতো দেশ থেকে কতোশত লোক আসে যায়! স্টেশনে সবচেয়ে করুণ হলো বিদায়ের দৃশ্য। কেউ চলে যাচ্ছে দেখলে আশরাফ সাহেবের খুব খারাপ লাগে। আমরা তো দেখি কেবল একজন চলে গেলো কিন্তু সে যে কতো কী রেখে গেলো তা দেখি না। সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে সন্তানের মায়াময় মুখ পেছনে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়া। বৃদ্ধ বাবা মাকে ফেলে যাওয়াটাও কষ্টের। আশরাফ সাহেবের এসব কষ্ট দেখতেও ভালো লাগে। তিনি একটি খিলিপান মুখে দিলেন। চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন কংক্রিটগুলোর বেশ উন্নতি হয়েছে। সব মাথার ওপর। একদিন এই বিশাল শহরে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানিও গড়াবে না রাস্তায়। সেদিন হয়তো তিনি থাকবেন না। না থাকাই ভালো। দেশের দুঃসময় না দেখাটাও ভাগ্যের।
ট্রেন এলো। লোকাল যাত্রীরা তাড়াহুড়া করছে। অনেকে দীর্ঘ জার্নি করে এসেছে। তাদের চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। দরজায় ভিড় লেগে গেলো। তিনি ভিড় ঠেলে উঠে পড়লেন একটি কামরায়। গাড়ি চলতে শুরু করলো। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ঘড়িটা নেই। প্রচণ্ড ভিড়ে হয়তো পড়ে গেছে নিচে। ঘড়িটা মেয়ের জামাই শখ করে কিনে দিয়েছিল। আশরাফ সাহেবের খুব পছন্দের একটা জিনিস। হয়তো কেউ না কেউ পেয়েছে। একজন পরলেই হলো। জগতের সব একাই ভোগ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
তিনি জীবনের বিচিত্র রূপ দেখতে লাগলেন। আঠার বিশ বছরের কয়েকজন ছোকরা কার্ড খেলছে। তিনি ধীরে ধীরে তাদের কাছে গেলেন। খেলায় তেমন কারো মনোযোগ নেই। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি আছে। টুইনটি নাইন তেমন জমছে না। তিন কার্ড ধরা নিয়েও একজন সিঙ্গেল খেলার ঘোষণা দিল। প্রথম চান্সেই আটকে গেলো। তার সহযোগী কার্ড ছিঁড়ে ফেললো। হালকা চড় থাপ্পর শুরু হলো।
আলী আশরাফ দ্রুত কামরা ত্যাগ করলেন। টিটি এসে টিকেট চেক করছে। আলী আশরাফ পকেটে হাত দিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। পকেট কাটা গেছে তাঁর। সাথে থাকা সাড়ে তিন হাজার টাকা এবং টিকেট সব গেছে। বিনা টিকেটে ট্রেনে উঠার অপরাধে ঘণ্টা খানেক জেল খাটলেন। তিনি হেঁটেই রওয়ানা দিলেন ভার্সিটির দিকে।
প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে বেলা বারোটার দিকে আলী আশরাফ প্রবেশ করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। জায়গাটার নাম হাকিম চত্বর। বড় করে মঞ্চ করা হয়েছে। বিশাল প্যান্ডেল। আলী আশরাফ এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে৷ ব্যানারটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এখানকার জীবনও তাঁর দেখা দরকার। ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’ চলছে। মঞ্চে বসা কোনো কবিকে তিনি চেনেন না। কবিতার সাথে তাঁর তেমন চেনাজানা নেই যদিও। তবু দেশের নামকরা কবিদের একটু আধটু চেনেন বৈকি! দর্শক সারিতে তিনিসহ চার পাঁচজন আছে। দুজন ছেলেমেয়ে বাদাম খাচ্ছে। নিজেরা কী বিষয়ে তর্ক করছে৷ একবার আড়চোখে দেখলেন মেয়েটা কাঁদছে। ক্ষণেই সব ঠিক হলো। ছেলেটা মেয়েটার মুখে বাদাম তুলে দিচ্ছে। তিনি তাকালেন মঞ্চের দিকে। একজন কবি স্বরচিত কবিতা পাঠ করছেন। মঞ্চে বসা কবিগণ বিরক্তি নিয়ে অপেক্ষা করছেন উৎসব কখন শেষ হবে। জাতীয় কবিতা উৎসবের দৈন্যদশায় আলী আশরাফ কোনো জীবনের ছিঁটেফোঁটাও পেলেন না। তিনি চললেন বাংলা একাডেমির দিকে। কার্জন হল হয়ে হাইকোর্ট এলাকায় যাবেন। কিছু খেতে হবে। পকেটে নাই কোনো টাকা পয়সা। ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে।
রাজু ভাস্কর্য দেখে মনটা খারাপ হলো। মেট্টোরেল জিনিসটিকে খেয়ে দিয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী এই ভাস্কর্যটির দিকে তাকালে আকাশের বিশালতাও দেখা যেতো। তখন এর একটা অর্থ ছিল। পাঁচ বছরে কতো কী চেঞ্জ হলো। এই শহরের মানুষ কি কোনোদিন আর আকাশ দেখবে না?
আলী আশরাফ সাহেবের মনটা খারাপ হলো। চোখের সামনে সব কেমন পরিবর্তন হয়ে গেলো। চল্লিশ বছর আগে তিনি এই শহরে এসেছিলেন। এখন তো যাওয়ার সময় হলো। এই বিশাল শহরে তাঁর আজ দুপুরে খাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। যদিও খাওয়াটা বড় কথা না। এমন একজনও নেই যে তাকে চেনে। তিনিও কাউকে চেনেন না। এখানে শুধু অচেনা লোকের ভিড়। তিনি রমনা পার্কে গেলেন। কিছুক্ষণ পর মনে হলো তাঁর শরীরটা ভালো লাগছে না। বাসায় যাওয়া উচিত। অবসর জীবন আসলে ইতর প্রাণীর জীবন। অর্থহীন জীবনের কোনো মানে নেই। তাঁর জীবনটা সৃষ্টিশীল হয়নি। তিনি জীবনের অপচয় করেছেন। তিনি মারা যাওয়ার পরই সব ক্লোজ হয়ে যাবে। আলী আশরাফের নাম পুত্র কন্যার সার্টিফিকেট ছাড়া আর কোথাও থাকবে না। ঠিক হয়নি। জীবনের এমন অপচয় করা মোটেও ঠিক হয়নি।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বাসায় যাওয়া উচিত। রমনা পার্কের সামনে একটি প্রাইভেট কার দাঁড়ানো। একজন লোক তাঁকে ইশারায় ডাকছেন। আশেপাশে তিনি তাকালেন। তাঁকে তো কেউ চেনে না। কে ডাকবে? হুম, তাঁকেই ডাকা হচ্ছে। ক লোকটা?
কাছে যাওয়ার পর লোকটি বললো, চাচা ভালো আছেন? আপনে আজমপুর যাইবেন না?
-হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনি না।
-চাচা, আমরা সবাই কি সবাইরে চিনি? চিনজান পরে হবে। গাড়িতে উঠেন। আমি ওইদিকেই থাকি। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থ। আপনাকে আজমপুর নামিয়ে দিব। আমি যাব দিয়াবাড়ি। চলেন।
-বাবা, আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নাই।
– চাচা, আমি তো খেপ মারার জন্য আপনারে ডাকি নাই। চিনছি বইলাই তো ডাকছি। টাকা লাগব না। উঠেন।
সকালে রিক্সাওয়ালার জীবনটা তাঁর কাছে অসাধারণ লেগেছে। যাক, ভালোই হলো। হাতেও টাকা নেই। ক্ষুধাও লেগেছে। ‘সৈয়দ মনজিল’-এ আর যাই হোক খাবার আছে। চেনাজানা মানুষও আছে। তিনি গাড়িতে উঠলেন।
গাড়ি দ্রুতবেগে চলছে। ড্রাইভারের নাম লিয়াকত। লিয়াকত বেশি কথা বলে। আলী আশরাফ বেশি কথা বলতে পারেন না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি লিয়াকতের নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন।
– চাচা, গেছিলেন কই?
– মানুষের বিচিত্র জীবন দেখতে। প্রায়ই যাই। আজ গিয়েছিলাম ভার্সিটিতে।
– হ চাচা, ভার্সিটিতে জীবন আছে। জীবনতো আসলে তাগোরই। আমরা তো আইছি খালি জন্ম নিবন্ধন ঠিক করাইতে।
– যাকগা, চাচা কোথায় চাকরি করেন?
– আমি অবসরে গিয়েছি গত বছর।
– ও। আপনের ছেলে মেয়ে আছে?
– আছে। দুইজন। দুটোরই বিয়ে দিয়েছি।
-আপনের কাছে মোবাইল আছে?
– না বাবা। কেন?
– এমনি। আপনার ছেলে মেয়েদের মোবাইল নম্বর মনে আছে?
– কেন বাবা?
– না, ধরেন আপনের কোনো বিপদ হইল। অথবা ছিনতাইকারী ধরলো। আপনের ছেলেকে বলতে হবে দুই লাখ টাকা নিয়ে অমুক জায়গায় আসতে। বলতে পারবেন?
আলী আশরাফ সাহেবের মাথাটা ঘুরে গেলো। এই গাড়িতে উঠা বিরাট বোকামি হয়েছে। জীবনের কঠিন কিছু মহূর্ত তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে।
রাত প্রায় এগারোটা। রাস্তায় শুনশান নীরবতা। কোথায় এটা? আলী আশরাফ সাহেব চোখ মেলতে পারছেন না। তাঁর মুখের রক্ত গিলে গলাটা ভেজাচ্ছেন। তিনি প্রাণপণে বেঁচে থাকতে চাচ্ছেন। তাঁর হাত বেয়ে রক্ত ঝরছে। মাথায় প্রচণ্ড চাপ হচ্ছে। এরা কি তাঁকে ছুরি মেরেছে? কারের দরজা খুলে তাঁকে ফেলে দেওয়া হলো গলির মুখে। তিনি চেনার চেষ্টা করছেন। তাঁর শরীরের রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে।
তিনি দেখছেন আড়াই ফিট প্রশস্তের বাইশ ফিট দীর্ঘ রাস্তাটি তারই দেহের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। একজীবনে তিনি এই রক্তের নদী পাড়ি দিতে পারবেন বলে মনে হয় না।