প্রথম পাতা » জীবনযাপন » উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় বাংলাদেশ

উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় বাংলাদেশ

Bangladesh as developing country

বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত স্বরণীয় হয়ে থাকবে চলতি বছর ২০২১ সাল। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকার পর এ রাষ্ট্র চলতি বছর উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের একদফা পর্যবেক্ষণের পর ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারন সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে বাংলাদেশ।

দেশের জন্য এই অর্জন অনেক মর্যাদার। কারণ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীলে উত্তরণের জন্য বিশেষত তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে এদেশ এই স্বীকৃতি অর্জন করতে চলছে। ২০১৪ সালের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল কর্তৃক প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক রিপোর্টে উন্নয়নশীল দেশসমূহের তালিকায় বাংলাদেশের নাম প্রথম অন্তর্ভূক্ত হয়। বিশ্বব্যাংকের বিশেষ বিবেচনায় বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাইয়ে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়।

সাধারনত, জাতিসংঘ তার সদস্য দেশগুলোকে স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত – এই তিন পর্যায়ে বিবেচনা করে বাংলাদেশ ১৯৭৫ সাল থেকে এলডিসি। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ক্ষেত্রে মাথাপিছু আয় অন্যতম মানদন্ড। এছাড়া সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ধারণের জন্য অন্য দুটি মানদন্ড নিরূপণ করা হয়। স্বল্পোন্নত দেশে উত্তরণ করতে হলে কিছু নির্ধারিত শর্ত পূরণ করতে হয়। যেমন- মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, এবং অর্থনৈতিক ও জলবায়ু ভঙ্গুরতা। স্বাধীনতার পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে। অর্থনীতির অনেক সূচকেই বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ভাল করেছে। দারিদ্র, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। নারীর ক্ষমতায়নেও এগিয়ে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে। মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও শিক্ষাক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে, করোনাকালীন এই সময়েও স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পড়াশোনা থেমে নেই। বাংলাদেশ ডিজিটাল হওয়ায় এখন ছাত্র-ছাত্রীরা বাসায় বসে অনলাইনে ক্লাস করতে পারছে।

এমন আরও অনেক সূচকেই বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে ভাল করছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় এলডিসি থেকে উত্তরণের এই জায়গায় আজকের বাংলাদেশ। এই উত্তরণের ফলে দেশের সার্বিক ভাবমূর্তি উজ্জল হবে। বিশাল পরিসরে বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ তৈরী হবে। ২০০৫ সালে মাল্টি ফাইবার অ্যাগ্রিমেন্ট বিলুপ্ত হওয়ায় ধারনা করা হয়েছিল, আমাদের পোশাকশিল্প হুমকির মুখে পড়বে। কিন্তু তা একেবারেই হয়নি। এমন সংকটকাল কাটিয়ে ওঠার স্বাক্ষর বাংলাদেশ রেখেছে। করোনাকালেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের জাতীয় অর্থনীতি তুলনামুলক সহজেই ধকল কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণজনিত চ্যালেঞ্জগুলি ভিন্ন বটে। এই উত্তরণকালে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির একটা সোপান হতে পারে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ অর্জন করা যায় শুধু মাথাপিছু আয় দ্বিগুন হলে অর্থ্যাৎ ১২৩০ মার্কিন ডলারের দ্বিগুন ২৪৬০ মার্কিন ডলার হলে।

বর্তমান সরকারের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৮ সালের মার্চ মাসে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হবার সব শর্ত পূরণ করে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবার জন্য প্রাথমিকভাবে বিবেচিত হয়েছিলাম। সে সময়কার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১২৭৪ মার্কিন ডলার, মানবসম্পদ সূচকের মান ৭৩.২ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মান ২৫.২ ছিল। সাধারণত উত্তরণের বিষয়টি প্রতি তিন বছর পরপর জাতিসংঘের Committee for Development policy (CDP) পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন করে। সিডিপির চুড়ান্ত সুপারিশের তিনবছর পর জাতিসংঘের সাধারন অধিবেশনে চুড়ান্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল, ২০২১ সাল পর্যন্ত এ অর্জনগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারন অধিবেশনে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসার বিষয়ে চুড়ান্ত অনুমোদন পেতে হবে। কিন্তু, কোভিড-১৯ বিবেচনায় প্রস্তুতি হিসাবে তিন বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর সময় পাওয়া গিয়েছে। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আমাদের দেশের চুড়ান্ত উত্তরণ ঘটবে।

২০২০ সালের শেষে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৮২৭ মার্কিন ডলার, মানবসম্পদ সূচকের মান ৭৫.৩ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মান ২৭.৩। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল এর মানদন্ড অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার। জাতিসংঘের হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ২৭৪ ডলার। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবমতে, মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৬১০ ডলার। ইকোসকের মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৪ পয়েন্টের প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশের আছে ৭২। অর্থনৈতিক ঝুঁকির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২। এই পয়েন্টে ৩৬- এর বেশি হলে এলডিসিভুক্ত হয়। ৩২- এ এলে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জিত হয়। এখন বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নয়নের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, এ সরকার টানা দশের অধিক কাল ধরে ক্ষমতায় থাকায় দেশে দারিদ্র্যের হার বিস্মকরভাবে হ্রাস পেয়েছে। অতি দারিদ্র্যের হার কিছুটা কমেছে। নব্বইয়ের দশকে যেখানে বাংলাদেশে মাত্র ২৩ লাখ লোক দারিদ্রসীমা অতিক্রম করতে পেরেছিল, সেখানে বাংলাদেশ আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকারের জনমুখী পদক্ষেপের ফলে গত ১০ বছরে ৫ কোটি মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ছিল ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে ২১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে এবং হতদরিদ্রের হার ২৪ দশমিক ২ থেকে ১২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

বিগত সরকারের আমলে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ ডলার। আর আজ তা ১ হাজার ৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বিনামূল্যে চিকিৎসা ও শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গত ৯ বছরে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে সর্বমোট প্রায় ২৬০ কোটি ৮৫ লাখ ৯১ হাজার ২৮০ টি বই বিতরণ করা হয়েছে। গ্রামীন কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে। যদিও সেবার মান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ দেয়া হচ্ছে। গর্ভপতি মায়েদের রেশনভাতাসহ চিকিৎসার ওষুধ সামগ্রী বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের গ্রামীন অর্থনীতিতেও বইতে শুরু করেছে সামগ্রিক পরিবর্তনের হাওয়া। প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে প্রান্তিক চাষী ও জনগোষ্ঠীর চেহারা। খাদ্য ঘাটতি থেকে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হচ্ছে। দেশে পদ্মাসেতু, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশে অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি অর্জন বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্রসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষুধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষকরে, এই করোনাকালীন সময়ে কৃষিতে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শস্যের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, কৃষক তার নায্যমূল্য পাচ্ছে, এবং সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের কৃষি প্রণোদণা দেয়া হচ্ছে, দেয়া হচ্ছে সার, বীজ ও অন্যান্য কৃষি সামগ্রী।

যার ফলে, বাংলাদেশ এই দুর্যোগময় সময়েও কৃষিতে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেছে। উন্নয়ন মানেই শুধু জিডিপির উন্নয়ন নয়। উন্নয়নের পথচলায় সবাইকে নিয়ে এগোতে হবে।উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দুর্দশা থেকে বের করে আনতে হবে। কমিয়ে আনতে হবে, আয়-বৈষম্য, প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে করের জাল বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। যদিও বাংলাদেশের জিডিপিতে অত্যন্ত কম। নিশ্চিত করতে হবে, নাগরিক অধিকার, প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন, স্বচ্ছতা,জবাবদিহি এবং সুশাসন। আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও দেশীয় বিভিন্ন নিয়ামক মাথায় রেখেই এখন নিতে হবে সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্ততি।

প্রসঙ্গগত, এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে জাতিসংঘের চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাবে। তাই বাংলাদেশকে আগের চেয়ে বেশি খরচ করতে হবে। জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রত্যেক সদস্য দেশকে তার জাতীয় আয়ের ০.০১ শতাংশ চাঁদা দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও এলডিসি হিসাবে বাংলাদেশকে একটি নির্ধারিত হারে চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সরকারি কর্মকর্তারা জাতিসংঘের বিভিন্ন সভায় যোগ দিতে সৌজন্য টিকেট পান, ২০২৬ সালের পর এ ধরনের টিকেট পাওয়া যাবে না, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের বৃত্তি দেয়া হয়, যা হয়তো আর পাওয়া যাবে না। তাই এলডিসি থেকে চুড়ান্তভাবে বের হবার জন্য বাংলাদেশ পাঁচ বছর ও স্বল্পোন্নত দেশসমূহের সুবিধা ভোগ করার জন্য ছয় বছর সময় পাবে। যেহেতু করোনাভাইরাসের মহামারি নেতিবাচক প্রভাবের কারনে অতিরিক্ত দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। তাই স্বল্পোন্নত দেশসমূহের সুবিধা ভোগের সময়ও বৃদ্ধি পেতে পারে যা হয়তো ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হবে। তবে সেই হিসাবে চললে হবে না।এ যুগান্তকারী অর্জন সম্মানের পাশাপাশি অনেক দায়িত্বও বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার সুফল সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাকে ফলপ্রসূ করতে আমাদের আসলে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন ঘিরে সরকারের ঘোষিত রূপকল্প -২০৪১ এর আলোকে উন্নত বাংলাদেশ বাস্তবায়নই হোক আমাদের মূল লক্ষ্য যা বাস্তবায়নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে দায়িত্ব নেয়ার পাশাপাশি দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য এবং জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে যেতে হবে।

জীবনযাপন থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Rony Sarkar
রনি সরকার
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *