বেশ আগের কথা। তখনো স্কুলে ভর্তি হই নি। ঘুরে ফিরে বেড়াই, ধারাপাত পড়ি, সন্ধ্যা হলে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।তখনকার সময়েরই কথা। এইতো অল্প কয়েকদিন আগেই ধানের সময় চলে গেল। এখনো হয়তো কোথাও কোথাও ধান মাড়াইয়ের কাজ চলছে। এসব দেখেই মনে পড়ল সেই পুরানো স্মৃতি।
আমাদের নানাবাড়িতে তখন অনেক ধান হতো। বাবার চাকরি সুত্রে আমরা বাহিরে থাকতাম। তো এই ধানের সময়টা আসলে নানাবাড়িতে যেতাম। মত্ত হতাম ধান মাড়াইয়ের উৎসবে। ধান কাটার বেশ কয়েকদিন আগেই চলে আসতাম নানাবাড়িতে। আসার কয়েকদিন পর একদিন সন্ধ্যায় শুনতে পেতাম গরুর গাড়ির চাকার ক্যাচর ম্যাচর শব্দ। এই শব্দ শুনেই ছুটে যেতাম বাড়ির পাশের রাস্তায়। আনন্দ আর উদ্দীপনায় ভরে উঠতো মন। প্রান ভরে নিতাম সদ্য কাটা ধানের গন্ধ।ঐভাবে ধান জমা হতে থাকত প্রতিদিন। সব ধান কাটা শেষ হওয়ার পর শুরু হতো ধান মাড়াইয়ের কাজ।
যেদিন ধান মাড়াই হবে তার আগের দিন থেকেই অপেক্ষায় থাকতাম। পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙেই ছুটে যেতাম ধান মাড়াই দেখতে। তখন ধান মাড়াইয়ের জন্যে নতুন এক ধরনের মেশিন বের হয়েছিল সেটা দিয়ে ধানের খড় বেশ দূরে উড়ে গিয়ে পড়তো। খুব মজা লাগতো এই দৃশ্য দেখতে।এভাবে ধান মাড়াই ও একসময় শেষ হতো। এরপর শুরু হতো ধান রোদে শুকানোর পালা। ধান সিদ্ধ করে ছড়িয়ে দেয়া হতো গোবর দিয়ে লেপে রাখা উঠোনে। ধান সিদ্ধ করা হতো বড় এক আয়তাকার পাত্রে। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হতো “”তাফাল””। ইট বা মাটি দিয়ে চুলা তৌরি করে তারপর তার ওপর বসানো হতো একে।
ধান মাটিতে ছড়িয়ে পড়ার পর পালাক্রমে চলতো ধানকে ছড়িয়ে ও উল্টেপাল্টে দেয়ার কাজ। এর মাঝেই খড়কে শুকিয়ে জমা করে উঁচু করা হতো। একে বলা হতো পালা দেওয়া। আমার কাছে সবচেয়ে মজাদার ছিল এই কাজটি। খড় শুকাতে দেয়ার পর বাশের এক প্রকার লাঠি দিয়ে খড় নেড়ে দেয়া হতো। এই লাঠিকে বলা হতো “”কেড়াইল”” বা “”কেড়াল””। আর এই কাজটিই আমি করতাম প্রবল উৎসাহে সবার সব নির্দেশ অমান্য করে। ঘামে সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে তারপরো আমার কোনো ভাবান্তর নেই একমনে কোটা দিয়ে খড় নেড়ে যাচ্ছি। এরপর মা ধরে নিয়ে উঠাতো।
সারাদিন খড় নিয়ে নাড়াচাড়া করার ফলে সন্ধ্যা হলে দেখা যেত সারা শরীর চুলকাচ্ছে। তখন প্রতিজ্ঞা করতাম কালকে সকালে আর ধান ধরবো না সুবোধ বালকের মতো বসে থাকব। কিন্তু সকালে উঠে কি আর সেসব কথা মনে থাকত!! সব কিছু ভুলে যেতাম, মেতে উঠতাম ধান ও খড়ের সাথে। এভাবেই কাটত আমার ধানময় দিন।এখনো ধানের সময় আসে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রতিটি গৃহস্থের বাড়ি। কিন্তু এখন আর আমি প্রানোচ্ছল হয়ে উঠতে পারি না বা সুযোগ হয় না। নিরবেই নিজের ব্যাস্ততায় কেটে যায় সময়গুলো। মাঝে মাঝে রোমন্থন করি সেসব স্মৃতি আর ভেসে যাই অতীতের কল্পনার স্রোতে। সত্যিই খুব চমৎকার ও স্মৃতিমাখা মায়াময় অসম্ভব সুন্দর ছিলো সময়গুলি।