হুমায়ূন আহমেদের একটা নাটকের নাম- ‘মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’। যারা নাটকটি দেখেছেন তারা জানেন এর স্যাটায়ারটি কোথায় লুকানো। হুমায়ূনের নাটক মানেই নির্মল বিনোদন। সেখানে হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে কান্না। নাটকটিতে রিয়াজ, মাহফুজ, জাহিদ হাসান দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। মন্ত্রী চরিত্রে চ্যালেঞ্জার ছিলেন অনবদ্য। সালেহ আহমেদ চেয়ারম্যান চরিত্রে লা-জবাব। ফারুক তো ফারুকই। মন্ত্রী মহোদয় গ্রামে যাবেন। হুলস্থূল কাণ্ড। বিরাট ব্যাপার স্যাপার। চারিদিকে আনন্দ আয়োজন। টান টান উত্তেজনা। রাজনৈতিক সেক্রটারি রিয়াজ আগেই এসেছেন। সব দেখভাল করছেন। তোরণ নির্মিত হচ্ছে ত্রিশের ওপরে। বাদ্য বাজনার আয়োজন চলছে। প্রত্যেক গ্রামেই একজন করে ‘মহান’ পাগল থাকে। জাহিদ হাসান বি.এ পাশ, চৈত- বৈশাখ মাসে মাথা থাকে সামান্য গরম। রিয়াজ তাকে ‘তুই’ করে সম্বোধন করায় এক চড়ে তার দাঁত ফেলে দিয়ে পুরো গ্রামে ‘বিরাট ঘটনা’র জন্ম দেয় সে। এতোদিনে লোকে শুধু শুনেছে বা বলেছে ‘এক চড়ে দাঁত ফালায়া দিমু’! এই প্রথম পাগল ‘ইতিহাস’ করলো। সে সত্যি সত্যি মন্ত্রীর পিএসএর দাঁত ফেলে দিল। যদিও রিয়াজ বলেছে ওটি ছিল তার ‘লুজ’ দাঁত!
মন্ত্রী মহোদয় আসবেন হেলিকপ্টারে। যাওয়ার সময় একজন মরণাপন্ন রোগী সঙ্গে নিয়ে যাবেন। ঢাকায় চিকিৎসা হবে। চেয়ারম্যান নিজে ‘মরণাপন্ন’ রোগী হিসেবে যেতে চাইলেও মন্ত্রীর নির্দেশ শিশু রোগী নিতে হবে। জনগণের সেন্টিমেন্ট জাগবে শিশুদের প্রতি, বুইড়া চেয়ারম্যানের প্রতি না। চেয়ারম্যানের এক নিকট আত্মীয় সুস্থ শিশুকে ‘মরণাপন্ন রোগী’ সাজানো হলো। মন্ত্রী মহোদয় গ্রামে এসে একটি মসজিদ এবং মন্দিরে অনুদান দেবেন। গ্রামে কোনো হিন্দু না থাকায় চেয়ারম্যানের চামচা মুসলমান ফারুককেই হিন্দু সাজতে হলো। ক্যামেরায় ফোকাস হলেই হলো। লোকজন তো আর লুঙ্গি খুলে দেখবে না কে হিন্দু কে মুসলিম! মন্ত্রী মহোদয় দুজন এতিম মেয়েকেও বিয়ে দেবেন। সাথে দেবেন গাই গরু। বরযাত্রীর সাথে গাই গরু যায় ভালো। কন্যা দুজন পাওয়া গেলো। বর পাওয়া হলো মুশকিল। জাহিদকে প্রস্তাব দিতে গিয়েই চড় খেয়ে দাঁত হারালো রিয়াজ!
হেলিকপ্টার জোগাড় হলো না। মন্ত্রী শেষ পর্যন্ত এলেন গরুর গাড়িতে করে। বৃষ্টিতে মন্ত্রী মহেদয় কাকভেজা। ইতঃপূর্বে পুলিশ ফোর্স সব পাগল জাহিদ হাসানের বশ হয়ে গেছে। তার কথায় তারা পুকুরে গলা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মন্ত্রীর একান্ত সচিব মাহফুজ ও এপিএস গড়বন্দি। যে দুজন মেয়ে জোগাড় হয়েছে তাদের বিয়ের জন্য বর পেয়েছে জাহিদ হাসান। গরুর গাড়িতে আসা মন্ত্রীকে কেউ বিশ্বাস করছে না। তাকেও বেঁধে ফেলা হলো। কাজি ডেকে বিয়ে শেষ হলো। চ্যালেঞ্জার একবার পরিচয় দিতে চেয়ে বললো যে সে নিজেই মন্ত্রী। এবার পাগল আবার ক্ষেপে উঠলো :
“তুমি মন্ত্রী? তুমি জানো বাংলাদেশের মন্ত্রী কী জিনিস? মন্ত্রীরে নিয়া হাসি তামশা করবা না!”
পাগলের কথা হলেও একশ কথার এক কথা সে বলেছে। বাংলাদেশের মন্ত্রী খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। তাঁদের নিয়ে হাসি তামশা করা যায় না। তাঁরা হয়তো মুখ ফসকে বলে ফেলেন : আল্লার মাল আল্লায় নিছে। বলুক। কথা তো খারাপ বলে নাই। দুনিয়ার সব মালই আল্লার। হতে পারে বিরাট লঞ্চ ডুবির ঘটনায় বহু মানুষের মৃত্যুশোকে কথাটা তিনি জুতমতো বলতে পারেন নাই। কিন্তু ‘লাশের বদলে ছাগল’ও তো তাঁরাই দেন।
কেউ হয়তো বললেন, উই আর লুকিং ফর শত্রুজ। বলুক না! আপনারা কি ভুলভাল বলেন না? উনাদের চাপ বেশি৷ জনগণের জন্য কাজ করতে গেলে ভুল হয়। তাই বলে ট্রল করা ঠিক না। এজন্যই বাঙালির উন্নতি নাই। খালি ট্রল আর ট্রল। রানা প্লাজা ধ্বংসের পর কেউ হয়তো বললেন, পিলার ধরে কতিপয় দুর্বৃত্ত ঝাঁকুনি দেওয়ায় বিল্ডিং ধ্বসে গেছে। যেতেই তো পারে। আপনারা সবই অবিশ্বাস করবেন?
আপনারা ‘তালা মারার তত্ত্ব’ ভুলে গেলেন? চোর ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তালা মারার কথা প্রথম কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল আপনাদের মনে নাই? তিনি স্বরাষ্ট্র হয়েও গার্হস্থ্য জীবনের কথা কি ভুলেছিলেন? আপনারা অকৃতজ্ঞ!
বাংলাদেশে বিকল্প রেসিপি নতুন কিছু তো নয়! ভাতের বদলে আলু খেয়েই তো আমরা আজ বলীয়ান, মহীয়ান, গরীয়ান! একটা তত্ত্ব এলেই লোকজন গালিগালাজ করে, ট্রল করে! এটা ঠিক না। বহু রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কথা বলার অধিকার সবার আছে। তাঁদের আছে সবচে বেশি।
ইফতারে খেজুরের পরিবর্তে বরইয়ের কনসেপ্ট আমার কাছে দারুণ লেগেছে। দেশীয় জিনিসের রপ্তানি হতে পারে বাইরেও। লোকজন এক সময় বাতাবি লেবুর চাষ নিয়েও হেসেছে। অথচ বাতাবি লেবুতে দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। এক সময় বরই হতে পারে আন্তর্জাতিক পণ্য। শুকনো বরই গুড়া দিয়ে শরবতের ব্যবস্থা করতে পারেন। প্রেশার থাকলে উপকার পাবেন। রমজান হলো সংযমের মাস। আপনারা খালি মিষ্টি খোঁজেন! ডায়াবেটিক রোগীর জন্য বরই হতে পারে ব্যাপক সম্ভাবনার ফল! (এটি কি ফল না সবজি? বিশেষজ্ঞরা মত দিবেন)। আমি আরবের খেজুর উচ্চমূল্যে কিনব না। দেশীয় বরই দিয়েই সারব এবারের ইফতার। ইনশাল্লাহ।
‘বরই সমাচার’ লিখতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ কেন এনেছি আশা করি বুঝেছেন। একজন পাগলও বুঝেছে মন্ত্রী যেনতেন বিষয় না। তাঁদের নিয়ে মজা করা যায় না। তাঁরা অনেক কাজে থাকেন। দেশকে নিয়ে তাঁরা সবসময় চিন্তিত। সাধারণের জন্য বস্তাভরে খেজুরও তো আসবে! কমদামে গিলবেন। দরিদ্র মানুষ খায় না, গিলে।
রোজা মুখে বাদ্য ছাড়া গান গাওয়ার ব্যাপারে মেছাল কী? আমার একটা বরই গাছ আছে। পোলারে গাছে তুলে দিয়ে গান ধরব: বাপু চ্যাংড়ারে…গাছে চড়িয়া দুটি বরই পাড়িয়া দে…!
সারাদিন রোজা রেখে সন্ধ্যাবেলা ইফতারে একটা চুক্কা বরই মুখে দিয়ে খিচ দিয়া পড়ে থাকবেন। ইনশাল্লাহ, দেশপ্রেমের কারণে রোজা কবুল। আল্লাহ মহান।
আমার বৌ কিছু বুঝে না। এই খবর শুনে বললো : এই দেশে দরিদ্র মানুষদের নিয়ে যে রকম মওজমাস্তি করা হয় তাতে মাঝে মাঝে মনে হয় ‘চড় দিয়া একটা দাঁত….!’ তারে বুঝাইলাম থাক, রমজানে সবুর করতে হয়।
তারচেয়ে বলো বরইয়ের জয় হোক।