প্রথম পাতা » জীবনযাপন » হেইট স্পিচ নাকি হেইটফুল মাইন্ড, নাকি স্বার্থ হাসিল

হেইট স্পিচ নাকি হেইটফুল মাইন্ড, নাকি স্বার্থ হাসিল

হেইট স্পিচ বা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য নিয়ে সারা বিশ্ব বিচলিত। হেইট স্পিচ হচ্ছে প্রকাশ্য কোন বক্তব্য যা জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম, লিঙ্গ বা বর্ণের উপর ভিত্তি করে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে বা সহিংসতাকে উৎসাহিত করে।

ফেইসবুকে হেইট স্পিচ ছড়িয়ে অনেক সহিংসতা ঘটানো হয়েছে বাংলাদেশে। কক্সবাজারের রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, টিটু রায়কে ঘিরে রংপুরে যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার পিছনে রয়েছে হেইট স্পিচ।

হেইটফুল মাইন্ড

হেইট স্পিচ কেন ছড়ানো হয় তার আলোচনার পূর্বে কথা বলব হেইটফুল মাইন্ড নিয়ে। হেইটফুল মাইন্ড হলো বিদ্বেষমূলক মনোভাব। হেইটফুল মাইন্ড বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আইন আপনার মুখকে থামাতে পারলেও আপনার চিন্তাকে থামাতে পারেনা।

ছোট বেলা একটি গল্প শুনেছি। এক মুসলিম বন্ধু এবং এক হিন্দু বন্ধুর মধ্যে কথোপকথন:

মুসলিম বন্ধু: তোদের নাকি ৩৩ কোটি দেবতা! কয়জনের নাম বলতে পারবি?
হিন্দু বন্ধুটি দুর্গা, শিব, সরস্বতী, গণেশ, লক্ষ্মী, এরকম কয়েকজন দেবতার নাম বলে আর বলতে পারেনি। সে জিজ্ঞেস করল, “তোদের না হাজার হাজার নবী রাসুুল আছে? কয়জনের নাম বলতে পারবি?”

মুসলিম বন্ধুটি আদম আঃ, মুসা আঃ, ইসা আঃ, হযরত মোহাম্মদ সাঃ বলার পর গ্রামের সবার নামের শেষে আঃ যোগ করে বলতে থাকলো। যেমন- করিম আঃ, রহিম আঃ, জামাল আঃ, কামাল আঃ…
তাকে থামিয়ে দিয়ে হিন্দু বন্ধুটি বলল, “থাক, আর বলতে হবে না। বুঝেছি তুই পারবি।”

এভাবে ছোট বেলায়ই ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির তৈরি করা হয় যা হেইটফুল মাইন্ড তৈরির প্রাথমিক ধাপ।

আবার বড় হয়ে শুনেছি এমন কিছু গান যা নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব তৈরিতে সহায়ক। যেমন “চলে গেছ তাতে কি, নতুন একটা পেয়েছি।”

হেইট স্পিচ কেন ছড়ানো হয়

‘ঘৃণা’ ছড়ালে লাভ হয় ক্ষমতাবান বা বিশেষ গোষ্ঠীর।

ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়িয়ে নানান ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করা হয়, তাই সামগ্রিকভাবে ঘৃণা হলো প্রভাবশালীদের এক রকমের হাতিয়ার৷ এর বাইরে এককভাবে যারা ঘৃণা ছড়ান, তারা কুশিক্ষা বা কুচেতনার বশবর্তী হয়ে এমন করেন বলে মত অনেকের।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক আফসান চৌধুরী৷ তিনি মনে করেন, হেইট স্পিচ কিছু মানুষের জন্য টিকে থাকার একটি কৌশল। ঘৃণা ছড়ালে কারো কারো লাভ হয়৷ তাই লাভবান হতেই হেইট স্পিচ ছড়ানো হয়৷

‘‘একাত্তরে কিছু মানুষ সুবিধা নেবার জন্য বা লুটতরাজ করার জন্য বিদ্বেষ ছড়িয়েছে৷ কিন্তু গোষ্ঠীগতভাবে মুসলিমরা হিন্দুদের প্রতি বা হিন্দুরা মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষী কখনোই ছিল না৷” ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের টিটু রায় কিংবা ফেনীতে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ের পর যেসব ঘটনা ঘটেছে সবই স্থানীয় সুবিধা আদায়ের জন্য হয়েছে বলে মনে করেন আফসান চৌধুরী৷

‘‘দেখবেন, বেশিরভাগ এমন ঘটনার পর জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে৷ স্থানীয় প্রভাবশালীরাই তা করেছে৷” তিনি নিজের গবেষণায় দেখেছেন যে, এসব ঘটনায় স্থানীয় মুসলিমরাই হিন্দুদের আশ্রয় দিয়েছেন৷ তাই তিনি মনে করেন, ধর্মীয় উস্কানি থাকলেও এগুলোতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষয় নেই৷ অধ্যাপক চৌধুরী মনে করেন যে, প্রভাবশালীরাই বিদ্বেষ টিকিয়ে রেখেছে৷ কারণ, সাধারণ মানুষের বিদ্বেষ করা ছাড়াও রুটিরুজির কাজ করতে হয়৷ তাই বিদ্বেষ টিকিয়ে রেখে লাভ হয় ক্ষমতাবানদেরই৷ কোনো কোনো গোষ্ঠী এই সুযোগ নিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিল করে৷

তিনি মনে করেন, সারাবিশ্বে সবাই সহিংস বিদ্বেষকেই বড় করে দেখে৷ কিন্তু এই সমাজে অহিংস বিদ্বেষ ছড়িয়ে অর্থনীতি ধ্বংস করে কেউ কেউ নিজেরা লাভবান হচ্ছে, সেটি কেউ দেখে না৷

“আজকে যদি একজন ১ হাজার কোটি টাকা মেরে দিতে চায়, সে যদি ১০ কোটি টাকা বিএনপির বিরুদ্ধে খরচ করে, তাহলে সে দুর্নীতি করে পার পেয়ে গেল৷ কারণ, তখন আওয়ামী লীগের লোকেরা তাকে কিছু বলবে না৷ একই কথা বিএনপি সরকারে এলে তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷”

আবার যদি ২ টি গ্রুপ থাকে, সংখ্যালঘু গ্রুপটির প্রতি বিদ্বেষ ছড়ালে সংখ্যাগুরু গ্রুপ থেকে সুবিধা পাওয়া যায়। এভাবে হেইট স্পিচ টিকে আছে।

ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য, প্রপাগান্ডা, অ্যাক্টিভিজম ইত্যাদি অনলাইনে হরহামেশাই চলে৷ এগুলো নিয়ে দেশে দেশে বিতর্ক কম হয়নি৷ নানা দেশে তাই সামাজিক মাধ্যমে সরকারি হস্তক্ষেপও এসেছে৷ অনেকে এটাকে আবার মুক্ত মতের উপর হস্তক্ষেপ বলেও মনে করেন৷ তাই হেইট স্পিচ বন্ধ করা সহজ নয়।

যখন রাষ্ট্র সবাইকে সমান সুযোগ দিতে পারবে, এবং ঘৃণা ছড়িয়ে যখন লাভবান হওয়ার পথ সংকীর্ণ হয়ে আসবে তখনই কেবল হেইট স্পিচ কমে আসবে।

জীবনযাপন থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Bikul
বিকুল
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। ভালোবাসেন ব্লগিং করতে এবং অন্যের লেখা পড়তে। অবসর সময় কাটান ভালো মুভি দেখে। সারা বিশ্ব ঘুরে দেখতে চান।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *