প্রথম পাতা » জীবনযাপন » এই খানে এক নদী ছিল…

এই খানে এক নদী ছিল…

Rivers of Bangladesh

জল জোছনার দেশ, ভাটির দেশ বাংলাদেশ। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ প্রাণের এই ভূখণ্ডজুড়ে প্লাবিত হতো তেরশো নদী। বাংলার আলপথ, মেঠোপথ, রবীন্দ্রনাথের রাঙামাটির পথ এক সময় প্লাবিত হতো আকস্মিক বন্যায়। মরুর চরে পলি পড়তো। কৃষকের মন ভরে উঠতো আগামীর প্রত্যাশায়। পলিমাটির কোমলতায় বাংলার মানুষ গড়ে উঠেছে অতিথিপরায়ণ, বাউলিয়ানা ও কাদামাটির মতো নরম মনের হয়ে। এদের দিল ছিল নরম, কলিজা ছিল ঠান্ডা। নাতিশীতোষ্ণ, মৌসুমী বায়ুর দেশ, ষড়ঋতুর দেশটি ক্রমশ হয়ে উঠলো ভয়ঙ্কর দাবদাহের অযাচিত ভূখণ্ড। আজ এদেশের তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি! যেন সাহারা মরুভূমি!

পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতা নদীকেন্দ্রিক। জলের প্লাবন ব্যতীত নগরায়ণ কল্পনা করাও দুরূহ। ফলে ইতিহাসের শুরুই নদীবিধৌত অঞ্চলকে কেন্দ্র করে।ঢাকা গড়ে উঠেছিল বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে। আহসান মঞ্জিলে গেলে নবাব পরিবারের সেই স্নিগ্ধ মধুর স্মৃতি কল্পনায় ভেসে উঠবে। শান্ত বুড়িগঙ্গার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নবাবমহল। নদীতে পালতোলা নৌকা চলছে দূর গন্তব্যে। সকালের নদীতীর থেকে ছুটে আসতো লিলুয়া বাতাস। শাহীমহল হয়ে যেতো বেহেশতি বাগান। কিন্তু কল্পনাটুকুই শুধু বাকি আছে। আহসান মঞ্জিলে গেলে এখন আপনার মনে হবে কোন বেক্কল নবাব এখানে এতো টাকা খরচ করে বাড়ি করেছিল? বুড়িগঙ্গার কৃষ্ণজল, দুর্গন্ধময় বাতাস আর লঞ্চের বিরক্তিকর ভেঁপু আপনার কল্পনাকে করবে কলুষিত। বুড়িগঙ্গার কালোজল এখন আর মুখে তোলার জো নেই। কচুরিপানায় ঢেকে গেছে এ নদীর তট। খচ্চরদের দখলে গেছে দুই পাড়ের অসংখ্য জমি। বুড়িগঙ্গা এখন ওয়ারিশান তবু তার স্থান বৃদ্ধাশ্রমে!

নদী নিয়ে বাংলাসাহিত্যে আছে ব্যাপক সৃষ্টিশীলতা। বাংলার প্রথম গ্রন্থ চর্যাপদেও আছে নদীকেন্দ্রিক জনজীবনের চিত্র। ডোম্বীদের নৌকাচালনা, তাদের জীবনের রূপবৈচিত্র্যের বহুমাত্রিক আলেখ্য সৃষ্টি হয়েছে নদীর প্রবহমান স্রোতধারায়। মধ্যযুগের প্রথম কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও আছে নদীর আলেখ্য। নৌকাখন্ড নামে একটি অধ্যায়ও আছে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলায় যমুনা যেন প্রেমের আধার হয়ে উঠেছে। মধ্যযুগের অন্নদামঙ্গল কাব্যের মাঝি ঈশ্বরী পাটনী কী সুন্দর করেই না বলেছিল : আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে!

আধুনিক সাহিত্যেও নদীকেন্দ্রিক বহু গল্প, উপন্যাস, কবিতা রচিত হয়েছে। রবীন্দ্রসাহিত্যের এক বিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে নদনদীর মহিমা। পদ্মানদীর বুক চিরে রবীন্দ্রনাথের আনাগোনায় সৃষ্টি হয়েছে ছুটি, সোনারতরী, অতিথি, নৌকাডুবির মতো শিল্পসম্ভার। পালতোলা নৌকা মানবজীবনের গভীর এক জিজ্ঞাসা হয়ে আছড়ে পড়েছে পোস্টমাস্টার গল্পে। জলধারার আকস্মিক প্রভাবে একরাত্রি এক স্কুল মাস্টারের জীবনে বয়ে এনেছে চিরায়ত অমীমাংসিত জীবনবোধ। খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তনে নদী এসেছে সর্বগ্রাসী এক শিল্পিত সত্যরূপে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য থেকে নদীর প্রসঙ্গ বাদ দিলে চরায় আটকে যাবে তাঁর শিল্পস্রোত। তাঁর শিল্পজিজ্ঞাসার নানাপ্রান্তে নদী এসেছে বিচিত্র প্রতীক ও রূপক সেজে। গীতাঞ্জলির বাউলসুরে নদীর ভূমিকা অনন্য। মুক্তধারার প্রবহমানতা না থাকলে তিনি কি লিখতে পারতেন : রূপ সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি!

একজন মাইকেল তো কাতর হয়েছিলেন কপোতাক্ষের স্মৃতিতে অবগাহন করেই। মহাকবি হওয়ার মহামন্ত্র তো তিনি পেয়েছিলেন নদের স্বচ্ছ জলেই। কপোতাক্ষের স্মৃতি যদি তাঁকে না ফিরাতো তবে কি একটা সার্থক মহাকাব্য সৃষ্টি হতো বাংলা ভাষার রূপখনির পূর্ণমণিজালে?

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলোই প্রায় নদীকেন্দ্রিক। মানিকের পদ্মানদীর মাঝি, অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম, সেলিনা হোসেনের হাঙ্গর নদী গ্রেনেড প্রভৃতি উপন্যাসে নদীপাড়ের জীবন কতো বিচিত্র রূপ লাভ করেছে! বহু আঞ্চলিক উপন্যাস লেখা হয়েছে নদীকে উপজীব্য করে। নদীতীরের জনজীবন বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে নতুন মাত্রা।

শুধু সাহিত্য নয় রাজনীতির অঙ্গনেও বাংলার নদনদীর রয়েছে বিস্তর প্রভাব। আর তাই বাংলাদেশের একটি বৃহৎ দলের প্রতীক হয়ে উঠেছিল নৌকা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধুর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল নদীপাড়ের জনজীবন। বিশ্বরাজনীতিতে একসময় গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত নাম হয়ে উঠেছিল পদ্মানদী। প্রমত্ত পদ্মার বুকচিরে বাংলার দুঃসাহস নির্মাণ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। যমুনা ব্রিজ উত্তরবঙ্গের মানুষকে দিয়েছিল মুক্তি, আর পদ্মাব্রিজ দক্ষিণবঙ্গের মানুষকে দিয়েছে স্বস্তি।

একদিন হয়তো সমস্ত নদীই রূপ নেবে ক্ষীণধারায়। তখন হয়তো অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে যমুনা কিংবা পদ্মার ব্রিজ! আমরা ছোটবেলায় যে আবেগ নিয়ে পড়তাম : আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে / বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে…! আমার সন্তানরা সেই আবেগ খুঁজে পায় না। আমরা সত্যিই এমন নদী দেখেছি। দুপাড়ে কাশফুল দেখেছি। শেয়ালের হাঁক শুনেছি। আঁচলে ধরেছি ছোটমাছ। আমার সন্তানরা জীবনের এ সমস্ত অনাবিল আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তারা জানে না নদীতে মাছের সঙ্গে খেলা করা যায়। তারা দেখেনি পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ব্যাঙ খেলা করে। এরা বইয়ের ভারে ক্লান্ত, হোমওয়ার্কের আবর্জনায় নত, প্রাত্যহিক মূল্যায়নের দুশ্চিন্তায় আহত, এদের পলিমাটির মতো নরম মনটা কবেই নিহত!

Rivers of Bangladesh
পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা নদীর সাম্প্রতিক রূপ

আজ বাংলাদেশে নদী বলতে কচুরিপানার স্তুপ, দুপাড়ে কংক্রিটের ভবন, সমস্ত চর পড়ে আছে। মাঝে মাঝে জলধারার ক্ষীণরেখার চিহ্নটুকু ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। মানিক একালে থাকলে পদ্মানদীর মাঝি না লিখে লিখতেন পদ্মানদীর গাড়িয়াল। তিতাস এখন আর নদীর নাম নয়। এটি বড়জোর একটি খালের নাম। তিতাস বললে নদীর নামের আগে আসে গ্যাসফিল্ডের নাম!

গতকাল একটা গান শুনলাম :

‘দুষ্ট লোকের মিষ্ট কথা
তিক্ত তাহার ফল
পোস্ট অফিসে খবর আইছে
যমুনায় নাই জল!’

বাংলার নদীগুলো এভাবে জলহীন হয়ে পড়লে বহু ইতিহাসই পাল্টে যাবে। বহু রূপক, সংকেত, প্রতীক হয়ে পড়বে অর্থহীন। বাংলার নদীগুলোকে বাঁচান। এখন প্রায় গ্রামেই টিউবওয়েল অকেজো। আমার গ্রামে শত শত সাম্বাসিবল করা হয়েছে। পানির স্তর নেমে গেছে অকল্পনীয় নিচে। এভাবে চলতে থাকলে এদেশে সবচেয়ে দামি হয়ে উঠবে খাওয়ার জল।  নিয়মিত দখল, বালু উত্তোলন, ভবন নির্মাণ এবং বন্ধুদেশের অনীহা ও অন্যায্যতায় শুকিয়ে গেছে শত শত খরস্রোতা নদনদী। অকেজো হয়ে পড়ছে হাজার হাজার কোটি টাকার সেতু। ব্যাহত হচ্ছে জনজীবনের বিচিত্র রূপ৷ মরুবাসীদের মতো আমরা হয়ে উঠছি অসহিষ্ণু, বর্বর ও বদমেজাজি।

অবশেষে পথিক নবীর গানের কথা দিয়ে ইতি টানছি :

‘এই খানে এক নদী ছিল জানলো নাতো কেউ
নদীর জল ছিল না, কূল ছিল না
ছিল শুধু ঢেউ!’

তখন ছোট ছিলাম। এই গানের অর্থ বুঝি নাই। আজ এই গানের অর্থ বুঝে বিমলানন্দ পেয়েছি!

আমরা দিনে দিনে সব হারিয়ে ফেললাম। বিসর্জন দিলাম আমাদের প্রিয় এবং আদরের সবই। ময়ূর সিংহাসনের এমনই কুহক! কী নশ্বর আমাদের বন্ধুত্ব!!!

জীবনযাপন থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *