প্রথম পাতা » জীবনযাপন » পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়

পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়

what

বাঙালি অন্যকে অপমানের মধ্য দিয়ে একটি পৈশাচিক আমোদ লাভ করে। বিশেষ করে যারা সেলিব্রেটি তাদের অপমান করার মধ্যে আছে পরম তৃপ্তি। এর কারণ কিছুটা মানসিক। অনেকটা এমন : দেখো তুমিও আমার মতোই একজন অতি সাধারণ। আলাদা কেউ নও। তোমাকে নিয়ে ছলিমদ্দি কলিমদ্দিও বেফাঁস কথা বলতে পারে! ড. ইউনুস যখন নোবেল পেলেন তখন এক লোক তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। শেষে যুক্তিতে যখন পারলো না তখন বললো- ‘সে যে ডাক্তর কয়টা লোকের ফ্রি চিকিৎসা করছে?’ ড. আর ডাক্তারের পার্থক্য যে লোক বুঝে না সে-ও এদেশে ইউনুসের বিচার করতে বসে! নোবেলজয়ী একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তির জীবনী পৃথিবীর নানা দেশের বইয়ে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত। অথচ এইদেশে তাঁর জীবন কাটছে ফৌজদারি আদালতের দ্বারে দ্বারে! ড. জাফরউল্লাহ এদেশে সততার অনন্য নজির। এক শার্ট তিনি পরেছেন ত্রিশ বছর। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে তিনি দুঃখী মানুষকে দিয়েছেন স্বল্পমূল্যের চিকিৎসা। বাংলাদেশে ওষুধের দামের যে দৌরাত্ম্য তাতে তিনি প্রতিবাদ করেছেন নিয়মিত। দুই টাকা খরচের একটি ট্যাবলেট যে এদেশে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয় তার মুখোশ উন্মোচন করে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার শিকার হন এই গুণী ব্যক্তি। ১৯৭১ এ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ। রণাঙ্গনের এই যোদ্ধা ইউরোপের জৌলসের জীবন রেখে তিনি দেশকে ভালোবেসে ফিরে এসেছিলেন বাংলায়। বাংলার নষ্ট রাজনীতি তাঁকে ছাড়েনি। দেশপ্রেমের কারণে তাঁকে শায়েস্তা করা হয়েছে মাছচুরির মামলা দিয়ে!

তাহসান বাংলাদেশের একজন সঙ্গীতশিল্পী, অভিনেতা, শিক্ষক, মডেল ব্যক্তিত্ব। আমরা অনেকেই সেদিন জানলাম যে তার মা একসময় পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন। আলোচিত আবেদ আলী জীবন তার মায়ের সময় ড্রাইভার হিসেবে পিএসসিতে ছিলেন। একদল প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে যে তাহসান ২৪ তম বিসিএসে পররাষ্ট্র প্রথম হয়েছিলেন! অথচ তিনি নাকি বিসিএস দেননি। এখন তিনি সরকারি চাকরিতেও নেই! কখনো ছিলেনও না। তিনি আজ অন্ধ জাতির কাঠগড়ায়!

তাহসান সেন্ট যোসেফ স্কুল, নটরডেম কলেজ, ঢাবির আইবিএর ছাত্র। বুয়েটেও চান্স পেয়েছিলেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। গান, অভিনয়, মডেলিংও করছেন নিয়মিত। তার প্রোফাইলটা কিন্তু খুব সাধারণ নয়। কতো অখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে মানুষ বিসিএস এডমিন, পুলিশ, পররাষ্ট্রে যাচ্ছে। তাহসান কি তার মায়ের ছায়া ছাড়াই একটা সরকারি চাকরি ডিজার্ভ করেন না? তার ফিটনেস, মেধা কি পররাষ্ট্রের সাথে যায় না? নব্বই ও তৎপরবর্তী দশকে সরকারি চাকরিতে এতোটা ক্রেজ ছিল না। একটা বিসিএসের চাইতে প্রাইভেট ব্যাংকের কদর ছিল বেশি। তখন সেখানে চারগুণ বেশি বেতন দেওয়া হতো। ২০০৬ সালে সরকারি চাকরির নবম গ্রেড শুরু হতো ৬০০০+! ভাবা যায়! সাকুল্যে ১০/১২ হাজার টাকা একজন পুলিশের এএসপির বেতন! সরকারি চাকরি এখনো এমন মোহনীয় কিছু না যদি সেখানে চুরি না থাকে! বেনজির, মতিউর না হলে সরকারি চাকরির বেতনে একালে চলা তো আরো কঠিন! তাই অনেকেই সরকারি চাকরির পরিবর্তে ব্যবসায় মনোযোগী হচ্ছে বেশি। তাহসানদের কাল ছিল প্রাইভেট সেক্টরের কাল! এখন হচ্ছে এসি, এএসপির কাল! কারণটা আর বললাম না!

তাহসানের মায়ের অপরাধ কিন্তু এখনো প্রমাণিত হয়নি। অথচ মায়ের কারণে তাকে নিয়ে ট্রল করা হচ্ছে। তার জীবনকে বিষিয়ে তোলা হচ্ছে। আমার মতে এটা চূড়ান্ত রকমের ক্রাইম। এই ক্রাইমে বাঙালি বরাবরই সিদ্ধহস্ত। মানী লোককে খাটো করে বাঙালি পরমানন্দ পায়। এই জাতি বরাবরই তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জীবিতকালে অবহেলা করে মরার পর মেডেল নিয়ে কবরের পাশে দাঁড়ায়।

হে মোর দুর্ভাগা দেশ,
যাদের করেছো অপমান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।।

জীবনযাপন থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *