প্রয়াত নাট্যকার মান্নান হীরা রচিত নব্বই দশকের একটি নাটক ‘ফুটপাত’। এটি একটি পথনাটক। দর্শককে সরাসরি কাছে টানার শক্তিশালী একটি মাধ্যম পথনাটক। বাংলাদেশে পথনাটকের পথিকৃৎ নাট্যকার মান্নান হীরা। ‘ফুটপাত’ নাটকটি তিনি সরাসরি ‘থিয়েটার মহলা’র হাতে তুলে দেন। গুণী নাট্যকার, নির্দেশক এমএবি সুজন নাটকটিকে দুর্দান্ত নির্দেশনায় দর্শকের হৃদয় কাড়েন। আমার জানা মতে ঢাকা শহরে নাটকটির দুই শতাধিক মঞ্চায়ন হয়েছে। পরে এই নাটকটি গ্রন্থভুক্ত হলে অন্যরাও মঞ্চায়ন করেছে। ঢাকার ফুটপাতকে হকারমুক্তকরণে পুলিশি জটিলতা, স্থানীয় রংবাজদের দৌরাত্ম্য এবং ফুটপাতকে কেন্দ্র করে অসহায় মানুষদের বেঁচে থাকার সংগ্রামী চেতনা নাটকটিকে করেছে প্রাণবন্ত। হকারি করার জন্য ফুটপাতে একটু জায়গা চেয়ে নিরন্ন মানুষের গভীর আকুতি শিল্পকুশলতায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। নাটকের শেষদিকে একটি ছেলে তার বাবার মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট শো করে স্থানীয় রংবাজ ও পুলিশের কাছে। তার বাবা বলেছিল এই সার্টিফিকেট দেখলে শহরের লোকজন তাকে ইজ্জত করবে, কাজ দিবে। শেষে এটি দেখিয়ে ফুটপাতে একটু জায়গা চায় সে। এক গভীর আকুতি ভেসে আসে : নেবেন নাকি ভাই, নেবেন? ফুটপাতের জায়গার বদলে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট…. নেবেন নাকি ভাই????
এটি নব্বই দশকের আকুতির কথা। মুক্তিযোদ্ধা এবং তার পরিবারের গভীর ক্রন্দনের কথা। আমরা অবাক হই ৭৫ পরবর্তী সময়ে এদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কেউ বলে সিপাহি বিপ্লব কেউ আবার বলে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা- ইতিহাস পাঠ খুব জটিল। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা যাঁর কাছ থেকে খেতাব নিল তাঁকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করলো ! কর্নেল তাহেরের বীরত্ব কে না জানে? তাঁকেও ঝুলতে হয়েছে ফাঁসিতে ! কর্নেল তাহেররা আটভাই রণাঙ্গনের যোদ্ধা ! তাঁদের মমতাময়ী মা বীর প্রসবিনী আশরাফুন্নেসা। শহিদ রুমীর মা জাহানারা ইমাম। তিনি জনতার আদালত বসিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী ফাঁসি দিয়েছিলেন জনতার রায়ে। কাদের মোল্লাসহ অন্যদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার জন্য ২০১৩ সালে শাহবাগে আন্দোলন করে হাজারো তরুণ ‘শাহবাগী’ নাম ধারণ করে নিয়ত গালি খেয়েছে। ইতিহাস কী নির্মম! ১১ বছর পর সেখানেও তরুণরা আবার জড়ো হয়েছে চাকরিতে কোটাপ্রথার বিরুদ্ধে ! এদের লোকজন এখন কী নামে ডাকবে? নুহ নবির নৌকার ক্যালেঙ্কারির মতো অবস্থা মনে হচ্ছে।
উপরে দুজন মহীয়সী জননীর কথা বলেছি। তাঁরা কিছুটা বিত্তশালী ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের নয় মাসের রক্তসংগ্রামে যাঁরা রক্ত ঝরিয়েছেন তাঁদের ৯৯ শতাংশ মায়ের ছেলেরা অশিক্ষিত, বাউন্ডুলে প্রকৃতির যাদের ভূতও ছিল না, ভবিষ্যতও ছিল না। ফলে অনেকে তো ভাবেইনি যে দেশ কোনোদিন স্বাধীন হবে আর এর সার্টিফিকেট দিয়ে নাতিরাও চাকরি পাবে ! কতোজন এই সার্টিফিকেট নেওয়াটাও জরুরি মনে করেনি। তখন আসলে এতকিছু ভাববার মতো পরিস্থিতি হয়নি। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কী পাবে না পাবে তারও হিসাব কষেনি। নয় মাসে যে একটা যুূ্দ্ধ শেষ হতে পারে এবং স্বাধীনতাও আসতে পারে এটি ছিল মিরাকল। ফলে সুবিধাবাদীরাই সুযোগটা নিয়েছে বেশি। কোনো এক সিনেমায় হুমায়ূন ফরিদী পুরো সময় রাজাকার থাকে। ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে চৌকির নিচ থেকে বেরিয়ে ইট দিয়ে নিজের মাথা নিজেই ফাটিয়ে পতাকা মাথায় বেঁধে জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে চলে যায় রেসকোর্সের দিকে ! নয় মাসের রাজাকার হয়ে গেলো বীর মুক্তিযোদ্ধা !
এদেশে অসহায় মানুষ যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল তারা দীর্ঘসময় পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার বাইরে ছিল। ‘ফুটপাত’ নাটকের শেষের আর্তিটি মিথ্যা নয়। বরং ভুয়া নাম দিয়ে সুযোগগুলো লুটপাট করেছে একদল সুবিধাবাদী যারা আসল মুক্তিযোদ্ধা নয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিজে অশিক্ষিত থাকার কারণে চাকরি নিতে পারেনি। সংসারে অভাব থাকার কারণে ছেলেমেয়েদেরও তেমন পড়াতে পারেনি। ফলে চাকরির ক্ষেত্রে তারা তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির পোস্টে কিছু সুযোগ পেয়েছে। তাহলে এতো এতো মুক্তিযোদ্ধা এলো কোথা থেকে? প্রথম আলোর রিপোর্ট ৃতে, ৫৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ১৯৭১ এর পরে ! কী ভয়ঙ্কর কথা ! আরো ভয়ঙ্কর তথ্য হলো মুক্তিযোদ্ধার সঠিক তালিকা প্রকাশের কাজ চলমান আছে ! মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ! করোনার সার্টিফিকেটের মতো এটিও কেনা যায় ডায়াগোনস্টিক সেন্টার থেকে? ৫৩ বছরেও একটা প্রকৃত ও নির্ভুল তালিকা আমরা পেলাম না !
আমার এলাকায় তিনজন সার্টিফিকেটধারী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার একজন দীর্ঘদিন ঢাকায় লেবার খেটেছেন। কবে কীভাবে মারা গেছেন আমরা জানি না, তার নিকটাত্মীরাও জানে না। বাকি দুইজন কোনোমতে বেঁচে আছেন। সরকারি ভাতায় চলছেন। তাঁদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানো দরকার।
আজকের তরুণরাই ২০১৩ সালে শাহবাগ কাঁপিয়েছিল। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করতে হয়েছিল। কিন্তু আজকের তরুণরা কেন কোটাবিরোধী আন্দোলন করছে যেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০%! সব মুভমেন্টকে স্বাধীনতাবিরোধী তকমা দিয়ে উড়িয়ে দিলে চলবে না। যে কোনো আন্দোলনের চাওয়া, দাবি এবং এসবের কার্যকারণ গভীরভাবে স্টাডি করতে হবে। ২০২৪ সালে ১৭৫৭ সালের আবেগ নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। লক্ষ লক্ষ ছাত্ররা রাস্তায় রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে না খেয়ে রাজপথে কেন এসেছে? সবাই একসাথে দেশদ্রোহী হয়ে গেলো ! এদের নিয়ে একবার বসা দরকার না?
মুক্তিযোদ্ধারা এদেশটা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। এখন দেশটা গড়বে তরুণরাই। তাই তাদের দাবিকে যৌক্তিকভাবে বিবেচনা করতেই হবে। ৭১ এ ছিল স্বাধীনতার প্রশ্ন, আর এখন হবে দেশকে গড়ে তোলা এবং টেকসইয়ের নিশ্চয়তা প্রদানের প্রশ্ন। ৫৩ বছরে দেশ যে গড়ে উঠেনি সেই ব্যর্থতার সিংহভাগ তো রাজনীতি যারা করেন তাদেরই।
তরুণদের ওপর ভর করেছে হতাশা, ক্লান্তি, দেশের শীর্ষ পর্যায়ের দুর্নীতি, লুটপাট, পুকুরচুরি, ছাগলচুরি, আবেদআলি, পিএসসি, বেনজির, মতিউর আর যারা এখনো মাঠে নামে নাই- রাজউক, ওয়াসা, বিমান, বিদ্যুৎ…!
কোটা আন্দোলনের সবচেয়ে লজ্জাকর বিষয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি (এটা কেউ কেউ করছে। সবাই না।) এটা যারা করছে নিশ্চিত অন্যায়। এ আন্দোলন যত দীর্ঘায়িত হবে এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা ততই শরমিন্দা হবেন। তাই দ্রুত একটা যৌক্তিক সমাধানে আসা উচিত।
আমার মতে, হাজার হাজার লুটেরার যে সম্পদের পাহাড় পাওয়া গেলো সেগুলো বরং রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করে সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা সর্বনিম্ন এক লক্ষ টাকা করা যেতে পারে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫-৭ %সহ অন্যান্য মিলে সর্বোচ্চ ১৫% কোটা রাখা যেতে পারে।
আন্দোলনকারীদের বলি, মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে খাটো করে দেখার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। ৭১ এর আবেগকে বুঝতে হলে হুমায়ূন আহমেদের অন্তত একটি সিনেমা দেখুন : আগুেনের পরশমণি/ শ্যামলছায়া।
এরপর দেখবেন দেশের প্রতি তিল পরিমাণ মমত্ববোধ থাকলে আপনি মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করে কথা বলতে পারবেন না, আমি নিশ্চিত।
দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, তরুণ প্রজন্ম এগুলো রাগ ক্ষোভ অভিমানের বিষয় নয়। সকলকে নিয়েই দেশকে গড়তে হবে। চোররা সব চুরি করে কলিজা ভরাক। তারপর চোরের বাচ্চারা এদিক ওদিক পালিয়ে চলে যাক দেশ ছেড়ে। এরপর আমরা সাধারণ মানুষরাই এদেশকে গড়ে তুলবো আমাদের মতো করে, ইনশাল্লাহ।