আমার এক বন্ধু ছিল। নিজেকে সে পরিচয় দিতো ‘আকাশ’ নামে। সে ড্রাইভারি করে। পূর্বে সড়কে এক যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন। গণরোষের কারণে যাঁকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। নামে কিবা আসে যায়। গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক সে গন্ধ ছড়াবেই। আবুল ডাকলেও গোলাপ গন্ধ ছড়ায়। আমার বন্ধুর নামটি মনে হয় তার পছন্দ ছিল না। তাই সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়স্বরে উচ্চারণ করতো – আমি আ-কা-শ।
যাই হোক,আকাশের পড়ালেখা ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। একদিন, অনেকদিন পর তার সাথে দেখা। আমাকে বললো তার একটা এইট পাসের সার্টিফিকেট দরকার। ড্রাইভারির লাইসেন্স করবে। বন্ধুটির কাছে আমি ঋণী। ফলে তার অন্যায় আবদারেও ‘না’বলতে পারলাম না। তখন নীলক্ষেতে নিয়মিত যাই। এক কম্পিউটার দোকানে গেলাম। ঘটনা বললাম। দোকানদার চরম বিরক্ত হলো। আমার মতো বোকা সে জীবনে দেখে নাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম কারণ কী? সে বললো-
আপনে টেকা দিয়া সার্টিফিকেট বানাইবেন। এইটের ক্যা?এসএসসির টা নিয়া যান। ডিগ্রিরটা আরও সস্তা। এইটের সার্টিফিকেট দিয়া করবেন কী!
বন্ধুকে ফোনে জিগাইলাম – কীরে ডিগ্রিরটা নিবি? সে জবাব দিল – হালারপো আমারে বিপদে ফালাইবা? ডিরগির সার্টিফিকেট লইয়া রাস্তায় নামলে যদি ট্রাফিকে পড়া জিগায়? তহন তো আরেক মামলা দিব। তুই এইটেরটা নিয়া আয়। আমি আর দোকানে গেলাম না। এয়ারপোর্টের বাস ধরলাম।
বাংলাদেশে সার্টিফিকেট বিক্রি নতুন না। মহান মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটও বিক্রি হয় এই দেশে! মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক সচিব মহোদয়ের মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটও নাকি কেনা!
মৃত্যু নিয়েও নানা কেনাবেচা আছে এই সোনার বাংলায়।এরই ধারাবাহিকতায় দেশে চলেছে করোনার সার্টিফিকেট বিক্রি! তবে পজিটিভ না,নেগেটিভ।
করোনা এক আজব শিক্ষা দিয়ে গেলো গত দশকে । সব বিষয়ে পজিটিভ ভালো না করোনা তা বুঝিয়ে দিয়েছিল। এই প্রথম বাঙালি একটা ভালো কাজে নেমেছিল সেবছর :
‘বাংলাদেশে করোনার নেগেটিভ সার্টিফিকেট পাওয়া যায়’ – এই সংবাদে পুরো বিশ্ব একবার নড়েচড়ে বসেছিল তখন।
অনেকদিন আগে পাকিস্তান ক্রিকেট দল এসেছে মিরপুর স্টেডিয়ামে৷ সাকিব আল হাসান তখন কেবল নিজের জাত জানান দিচ্ছে। স্কোয়াডে সাকিবের নাম না দেখে তৎকলাীন অধিনায়ক সম্ভবত ইনজামাম উল হক সাকিব দলে নাই কেন জিজ্ঞেস করলেন। বলা হলো- সাকিবের ইন্টার পরীক্ষা চলছে। আজ তার পরীক্ষা তাই দলে নাই! তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন- বল কী! সাকিবকে একটা সার্টিফিকেট তোমরা এমনিতেই তো দিতে পারো! দেশের জন্য সে সম্মান বয়ে আনছে!
অধিনায়কের এমন আবালমার্কা কথায় সারা স্টেডিয়াম তখন দাঁত কেলিয়ে হেসেছিল। বাংলার সার্টিফিকেট এতো সস্তা! লোকটা বলে কী? পরীক্ষা ছাড়া একজনকে সার্টিফিকেট দিব আমরা? সে বিশ্বজয় করলেই কী? বিদেশিদের নির্বুদ্ধিতা কতো ভয়ঙ্কর!
এদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি রান্নাঘর আছে। এখানে সার্টিফিকেট রান্না করা হয়। একদিন ক্লাস না করেও, বই না কিনেও, পড়ালেখা না করেও ঝুলে থাকলে কোনো না কোনোদিন সার্টিফিকেট পাওয়া যায়! এখানে ইনকোর্স বলে একটি পরীক্ষা আছে। কোনো পরীক্ষার্থী ২০ এ ০০ পেলো। আপনি এন্ট্রি দিলে তা অটো ৮ হয়ে পাশ নম্বর হবে! এমন ম্যাজিক সফটওয়্যার পৃথিবীর কোনো শালা আজ পর্যন্ত বানাতে পারেনি!
এদেশে একটি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কেউ কেউ বলে গোলমাল! চাকরিতে একটি কোটা ছিল মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতিদের জন্য। তখন দেশে আন্দোলন হলো। কোটার জন্য মেধাবীরা চাকরি পায় না। কোটা তুলতে হবে।তারপর কোটা তুলে দেওয়া হলো। চাকরিগুলো মুক্তিযুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্ত হলো!
ইদানিং বিভিন্ন জায়গায় সার্টিফিকেট পুড়ানো, ছেঁড়ার একটি হিড়িক চলছে। কেউ কেউ ছিঁড়েও সাফল্য পাচ্ছে। আগে তো জেনেছি মুক্তিযোদ্ধা কোটার জন্য মেধাবীদের চাকরি হয় না। এখন তো কোটা নেই।
এখন মেধাবীরা কী ছেঁড়ার জন্য সার্টিফিকেট ছিঁড়ে???