প্রথম পাতা » জীবনযাপন » ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে একজন বুদ্ধিজীবীর কথা

‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে একজন বুদ্ধিজীবীর কথা

Martyred Intellectuals Day

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী দরজা খুলে হাসিমুখে বললেন- কেমন আছ বাবা? (তিনি ধরেই নিলেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটি তাঁর ছাত্র)

কলিমউল্লাহ বলল- স্যার ভালো আছি। আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন স্যার? (তিনি তাকে চিনতে পারেন নি। চিনতে পারার কথাও না)

তারপরও হাসিমুখে বললেন- চিনতে পারবনা কেন? চিনেছি। (মিথ্যা বলার কারণ হলো তিনি অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, যতবার কোনো ছাত্রকে দেখে তিনি না চেনার কথা বলেছেন, ততবারই তারা ভয়ঙ্কর মনে কষ্ট পেয়েছে । এক ছাত্র তো কেঁদেই ফেলেছিল)

ধীরেন্দ্রনাথ রায় বললেন- বাবা, তোমার নামটা যেন কী?

– কলিমউল্লাহ ।

– হ্যাঁ, তাই তো। কলিমউল্লাহ। এখন পরিষ্কার মনে পড়েছে। তুমি কি খাওয়াদাওয়া করেছ?

– জি না স্যার।

– এসো আমার সঙ্গে চারটা ভাত খাও। আয়োজন খুব সামান্য। ভাত, ডিম ভর্তা। ঘরে আরো ডিম আছে। তোমাকে ডিম ভেজে দেব। ঘরে এক কৌটা ভালো গাওয়া ঘি ছিল, কৌটাটা খুঁজে পাচ্ছি না….

কলিমউল্লাহ বলল- এখন খেতে পারব না। আপনার কাছে আমি একটা অতি জরুরী কাজে এসেছি।

– জরুরী কাজটা কী ?

– মিলিটারির এক কর্নেল আপনার সাথে কথা বলতে চান।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় বিস্মিত হয়ে বললেন- আমার সাথে মিলিটারির কী কথা?

– আমি জানি না। তবে স্যার আপনার ভয়ের কিছু নেই। আমি সঙ্গে আছি।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় বললেন- তুমি আমার কোন ব্যাচের ছাত্র বলো তো?

– কথা বলে সময় নষ্ট করতে পারব না। মিটিংটা শেষ করে আসি, তারপর গল্প করব।

– দুইটা মিনিট অপেক্ষা করো, ভাতটা খেয়ে নিই। আমি খুব ক্ষুধার্ত। সকালে নাশতা করিনি।

– ভাত খাবার জন্যে অপেক্ষা করার সময় নাই স্যার।

– তাহলে দাঁড়াও, পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে আসি। আমার সঙ্গে কি কথা বুঝলাম না। সে আমার ছাত্র না তো? করাচি ইউনাভার্সিটিতে আমি দু’বছর মাষ্টারি করেছি। প্রফেসর সালাম সাহেব সেখানে আমার কলিগ ছিলেন।

কলিমউল্লাহ বলল- আপনার ছাত্র হবার সম্ভাবনা আছে।কর্নেল সাহেব যেভাবে বললেন “স্যারকে একটু নিয়ে আসো”… তাতে মনে হচ্ছে উনি আপনার ছাত্র।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী গাড়িতে উঠে দেখলেন.. গাড়ি ভর্তি মানুষ। তারা সবাই চিন্তায় অস্থির। ধীরেন্দ্রনাথ রায় তাদের দিকে তাকিয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলেন। ভুলে তিনি চশমা ফেলে এসেছেন বলে তাদের কাউকে চিনতে পারলেন না। চোখে চশমা থাকলে এদের অনেককেই তিনি চিনতেন। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা সেই গাড়িতে বসেছিলেন। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে বধ্যভূমিতে।

(জোছনা ও জননীর গল্প : হুমায়ূন আহমেদ)

হায়রে অভাগা দেশ! আলাভোলা মানুষগুলোই আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান, যাদের নরপিশাচদের হাতে তুলে দিয়েছিল এদেশেরই বেজন্মারা ! এ লেখাটি যতবার পড়ি চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না!

জীবনযাপন থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *