প্রথম পাতা » মতামত » চায়না-ইরান চুক্তি বদলে দিতে পারে এশিয়ার ভূ-রাজনীতি

চায়না-ইরান চুক্তি বদলে দিতে পারে এশিয়ার ভূ-রাজনীতি

China-Iran Treaty

যুক্তরাষ্ট্রকে তোয়াক্কা না করে চায়না ও ইরান তাদের মধ্যে ২৫ বছরের একটি ‘কৌশলগত সহযোগিতা’ চুক্তি চূড়ান্ত করার পরিকল্পনা করে ফেলেছে বলে জানা গেছে।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ জানিয়েছেন, ইরানের মন্ত্রিসভা চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদন করেছে। বাকি রয়েছে দুই দেশের পার্লামেন্টের অনুমোদন এবং দুই প্রেসিডেন্টের সই। খবর বিবিসির।

পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য ডজন-খানেক মিডিয়ায় বিভিন্ন নিবন্ধে বিশ্লেষকরা বলেন, চায়না ও ইরানের এ চুক্তি মধ্যপ্রাচ্য তথা এশিয়ার বিরাট একটি অংশের ভূ-রাজনৈতিক চালচিত্র বদলে দেবে।

চায়না ও ইরানের সরকার এখনও এ চুক্তির বিস্তারিত কিছু ভেঙ্গে না বললেও, নিউইয়র্ক টাইমস এবং হংকং-ভিত্তিক এশিয়া টাইমসসহ বেশ কিছু শীর্ষ সারির মিডিয়া বলছে তারা ১৮-পাতার খসড়া চুক্তিটি দেখেছে।

সে সূত্রে এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত নানা তথ্যের ভিত্তিতে যা জানা গেছে তাতে ইরানের তেল-গ্যাস, ব্যাংকিং, টেলিকম, বন্দর উন্নয়ন, রেলওয়ে উন্নয়ন এবং আরো কয়েক ডজনখানেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে চায়না ব্যাপক বিনিয়োগ করবে।

এ বিনিয়োগের পরিমাণ আগামী ২৫ বছরে কমপক্ষে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ হতে পারে।

সে সাথে প্রস্তাবিত চুক্তিতে সামরিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ‘যৌথ প্রশিক্ষণ, মহড়া, গবেষণা, যুদ্ধাস্ত্র তৈরি এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের কথা রয়েছে।

মিডল-ইস্ট আই নিউজ ওয়েবসাইটে একটি রিপোর্টে লেখা হয়েছে, চুক্তির আওতায় চায়না তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষায় ইরানে পাঁচ হাজার পর্যন্ত সৈন্য মোতায়েন করতে পারবে।

সুতরাং এ চুক্তি সই হলে মধ্যপ্রাচ্যে প্রথমবারের মতো সরাসরি চাইনিজ সামরিক উপস্থিতির সম্ভাবনা তৈরি হবে।

বিনিয়োগের বদলে জ্বালানি কেনার ক্ষেত্রে চায়নাকে অনেক ছাড় দেবে ইরান। বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে তেল-গ্যাস পাবে চায়না এবং চাইনিজ মুদ্রায় সে দাম পরিশোধ করতে পারবে।

মিডিয়ায় ফাঁস হওয়া চুক্তির এসব শর্ত নিয়ে ইরান বা চায়নার সরকারের পক্ষ থেকে খোলাসা করে কিছু বলা হয়নি। তবে সোমবার ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্বাস মুসাভি এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘(চায়নার সাথে প্রস্তাবিত এ চুক্তি) ইরানের কূটনীতির জন্য গর্ব করার মত একটি অধ্যায়।’

ইরান কেন এই পথে?

ওয়াশিংটনে আরব গালফ স্টেটস ইন্সটিটিউটের সিনিয়র ফেলো আলী আলফোনেহ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ইরান এখন অস্তিত্বের স্বার্থে চায়নার দ্বারস্থ হচ্ছে।

জ্বালানি তেল ও গ্যাস মজুদের হিসাবে ইরান দুনিয়ার অন্যতম শীর্ষ দেশ হলেও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় জ্বালানি বিক্রি করা তাদের জন্য দুরূহ কাজ হয়ে পড়েছে। সে সাথে বিনিয়োগের অভাবে তেল ক্ষেত্র উন্নয়নের পথও কার্যত বন্ধ হয়ে পড়েছে।

চীনা বিনিয়োগ তাদেরকে সে ‘মহাসঙ্কট’ থেকে বের করে আনতে পারবে। জ্বালানি খাতের জন্য বিশেষ সাময়িকী পেট্রোলিয়াম ইকোনমিস্ট গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশ করে যে ইরানের তেল, গ্যাস এবং পেট্রো-কেমিক্যাল খাতে ২৮০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে চায়না।

ওই সাময়িকী সে সময় বলে, ‘চায়না ও ইরানের এ চুক্তি দুনিয়ার তেল ও গ্যাস খাতের ভারসাম্যে মৌলিক পরিবর্তন আনবে যেখানে লেনদেনের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।’

তবে অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, চায়না ও ইরানের মধ্যে সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়েনি। নব্বইয়ের দশকে থেকেই এ দুই দেশ সহযোগিতা নিয়ে কথা বলছে। ২০১৫ সালে ইরানের সাথে করা পারমাণবিক চুক্তি থেকে এক তরফা ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া এবং ইরানের একের পর এক নিষেধাজ্ঞায় এ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে।

চায়নার স্বার্থ কি?

২০১৬ সালে চায়নার প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ইরান সফরের সময় ২৫ বছরের একটি ‘কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি’ নিয়ে দুই সরকারের মধ্যে প্রথম প্রাথমিক একটি বোঝাপড়া হয়। গত চার বছর ধরে তা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে।

কুয়ালালামপুরে মালয় ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউ অব চায়নার প্রফেসর ড. মাহমুদ আলী বলেন, ইরানকে তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের মধ্যে শক্ত ভাবে আনার জন্য চায়না অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছে।’

তিনি বলেন, ‘মলাক্কা প্রণালী দিয়ে তাদের বাণিজ্য, বিশেষ করে জ্বালানি সরবরাহের নির্ভরতা কমানোর জন্য চায়না বহুদিন ধরে উদগ্রীব, কারণ ওই সমুদ্র রুটটির নিয়ন্ত্রণ এখনও যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের হাতে, সুতরাং ইরানকে পাশে পেলে সমুদ্র রুটকে পাশ কাটিয়ে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা চায়নার জন্য অনেক সহজ হবে।’

অবশ্য চায়না ও ইরানের মধ্যে সরাসরি রেল লিংক রয়েছে। এ রেল রুট ‘নতুন সিল্ক রোড নামে’ পরিচিত, যা শিনজিয়াং থেকে কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিস্তানকে যুক্ত করে তেহরান পর্যন্ত ২ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। তবে এ রুটকে আরো সংহত, আধুনিক ও কার্যকরী করতে উদগ্রীব চায়না।

সহযোগিতা চুক্তি হবার আগেই চায়না ইরানের রেল অবকাঠামোর উন্নয়নের কাজে জড়িয়ে পড়েছে। চাইনিজ কোম্পানি সিনোম্যাক পশ্চিম ইরানে নতুন একটি রেল লাইন তৈরির চুক্তি সই করেছে।

তবে বেইজিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রকল্প তেহরান এবং মাশাদের মধ্যে ৯২৬ কিলোমিটার রেল লাইনের বিদ্যুতায়ন। তেহরান-কোম-ইস্পাহানের মধ্যে একটি দ্রুতগতির রেল লাইন নির্মাণ নিয়েও কথা হচ্ছে চায়নার সাথে। এসব রেল প্রকল্প ‘নতুন সিল্ক রোডে‘র অংশ হবে।

চায়না-ইরান এ সম্পর্কের প্রভাব কি হবে?

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি গবেষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক শিরিন হান্টার মিডল-ইস্ট আইতে এক নিবন্ধে বলছেন, ইরানের সাথে চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে চায়নার অবস্থান সংহত করবে। ‘সে সাথে ইরানের অর্থনীতির প্রভূত উন্নতি হবে। ফলে তাদের রাজনীতিও স্থিতিশীল হবে।’

হান্টার মনে করেন, ইরানের সাথে সংঘাতের ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের মধ্যে আগ্রহ কমবে। ‘এমনকি উপসাগরের অনেক দেশ চায়নার সাথে এ ধরণের বিশেষ চুক্তিতে আগ্রহী হয়ে ওঠতে পারে।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেছেন কাবেহ আফছার সারসাইয়াবি। হংকংয়ের দৈনিক এশিয়া টাইমসে এক নিবন্ধে তিনি বলছেন, ইরান যদি চায়নার বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয় তাহলে ওই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির কৌশলগত সমীকরণ বদলে যাবে।

তিনি বলেন, ‘খুব ধীরে হলেও নিশ্চিত ভাবে চায়না-ইরান এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি কৌশলগত জোট দানা বাঁধছে, যার সাথে অদূর ভবিষ্যতে যুক্ত হবে আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া।’

তার মতে, নতুন এ ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, তার মিত্র ইন্ডিয়ার জন্যও নিঃসন্দেহে মাথাব্যথার কারণ হবে!

লেখক: গল্পকার, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

সাইয়েদ ইকরাম শাফী
I'm a common man with deference. I have written Little Story, Poem, Novel, History, and Various Topics of National And International Politics.

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *