প্রথম পাতা » মতামত » বাঙালি নারীর মন

বাঙালি নারীর মন

girl

‘ভাগ্যবানের বৌ মরে, অভাগার মরে গরু’ – এটি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে খনিজ সম্পদের মতো অন্তর্লীন একটি প্রবাদ। এই ভূ-খণ্ডে সিনেমার নাম হয় ‘তুমি বড় ভাগ্যবতী’! নায়িকার এই সৌভাগ্যের কারণ আবার ভাগ্যের জোরে ‘সিংহপুরুষ’রূপী নায়ককে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়া! আহা! পুরুষের আধিভৌতিক মর্যাদা প্রকাশের কী কুহকী কৌশল! এই কৌশল কেবল পূর্ণদৈর্ঘ্য রূপালি জগতেই সীমাবদ্ধ নয়, বাংলার ঘর-সংসারেও বিস্তৃত। বাঙালি নারীর দুই প্রহর কাটে ‘রান্নার পরে খাওয়া, আর খাওয়ার পরে রান্নার চক্রে’ ঘুরে। তার আরেকবেলা কাটে ‘স্বামী সোহাগে সোহাগিনী’ হওয়ার সূত্র খু্ঁজতে গিয়ে।

মাতা-ভগ্নী-জায়া, নারীরূপের ত্রি-কায়া। এছাড়া নারী সহকর্মী, নারী এখন সহযাত্রীও। সহকর্মী- সহযাত্রী হিসেবে নারী তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছে সব ক্ষেত্রে। কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা আছে, তবে নারীকে স্বীকৃতি দিচ্ছে পুরুষ। নারীর সেই স্বীকৃতি যোগ্যতা-কর্মনিষ্ঠতা-সৃজনশীলতা দিয়েই অর্জন করে নিচ্ছে। নতুন বাংলা বিনির্মাণে নারীর এগিয়ে চলার গতি অপ্রতিরোধ্য-দীপ্তিময়। তবে নারীদিবসটি শুধু বাংলার শিক্ষিত, কর্মজীবনে বর্ণিল বাঙালি নারীর জন্য নয়। রাজনীতিতে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত নারী তাঁদের জন্যও নয়।

আসলে, বাংলায় নারীদিবস একদিনে পালন করা সম্ভব নয়; কারণ বঙ্গোপসাগরের সব জল এক গ্লাসে রাখা যায় না!

বাঙালি নারী কতটুকু অরক্ষিত তা তাদের জন্য সংরক্ষিত ব্যবস্থাই বলে দেয়। বাঙালি নারীর সুরক্ষার জায়গাটি নির্ভেজাল, নিশ্চিত নয় বলেই তাদের জন্য আজো সংরক্ষিত ব্যবস্থা প্রচলিত। এদেশ থেকে ‘নারীর জন্য সংরক্ষণ’ ব্যবস্থা উঠে গেলে কার্যত ‘নারীদিবস’ পালন যথার্থ ও সফল মনে হবে। তবে, নারীর অদম্য এগিয়ে চলার গতি বাংলাদেশকে পাল্টে দিয়েছে অনেকটা- একথা আর কুকথা নয়।

বাংলার রহিমুদ্দি, সলিমুদ্দির ঘরে নারীর অবস্থা কেমন? কেমন আছে আমাদের রহিমা, আমেনা, জমিলা, গুনাইবিবিরা? তাদের জন্য নারীদিবস কী বার্তা নিয়ে আসে সেটাও আমাদের ভাবতে হবে। তাদের ভালোলাগা- মন্দলাগা, কামনা-বাসনা, মতের স্বাধীনতা কতটুকু? সন্তান উৎপাদনের কল ছাড়া সংসারে তার অবস্থান কতটুকু বিস্তৃত? সে কি ব্যক্তির কাছে এখনো কামিনী? সংসারে কি গৃহিণী? সমাজে কি বন্দিনী? তার মূল্য আর মুক্তি কোথায়- সমাজে? সংসারে? প্রেমে? কামে? এসব জিজ্ঞাসার উত্তর জানা প্রয়োজন।

বেশ কয়কবছর গ্রামেই আছি। দেখছি প্রান্তিক, মধ্যবিত্ত বাঙালি নারী এখনো পুরুষের ইচ্ছায় আবর্তিত হয়। সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, ভয়ের বাধা এখনো আছে। নারী অস্তিত্বের সূক্ষ্মতর সংকট এখনো কাটেনি। তবে তাদের অনেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। নারীর অবলা কিংবা অবরুদ্ধতার রূপ অনেকটা কেটে গেছে। তবে সংখ্যাটা অতি নগণ্য।

প্রাণকে পূর্ণতা দেয় নারী- রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি তাৎপর্যপূর্ণ। রক্তকরবী- নাটকে নন্দিনী প্রাণের প্রতীক হয়ে উঠেছে। তাঁর ‘অপরিচিতা’, ‘পয়লা নম্বর’, ‘ল্যাবরেটরি’, ‘রবিবার’, ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে নারীরূপের নবনির্মাণ নতুন পথের ইঙ্গিত দেয়। নারীর ব্যক্তিসত্তার বহু গল্প, কবিতা, উপন্যাস তিনি লিখেছেন। তবে তাঁর নারীরূপের ‘অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা’ উক্তিটির মধ্যে নারীসত্তার স্বীকৃতি খেই হারিয়ে যায়। নজরুল নারীকে নিয়ে বিশাল কবিতা লিখেছেন। তিনি হুঙ্কার দিয়েছেন- “স্বর্ণ রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী /করিল তোমায় বন্দিনী বল কোন সে অত্যাচারী?” এই কবি প্রেমে আপ্লুত হয়ে লিখেছেন- “হে মোর রাণী, তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে/ আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ তলে এসে।” আবার প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি লিখেছেন- এরা দেবী এরা লোভী যত পূজা পায়/ এরা চায় আরো/ ইহাদের অতি লোভী মন/ একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে খুশি নয়/ যাচে বহুজন। (পূজারিণী)! জীবনানন্দ দাশ তো বনলতা সেনের পিঁছে ঘুরে জীবননাশ করেছেন। দেখা পেয়েছেন শেষে কিন্তু তখন অন্ধকার ছিল। মুখোমুখি ছিলেন, তবু তাকে দেখেন নি। নাকি ইচ্ছা করেই দেখা দেননি নিজেকে সেটাও প্রশ্ন। তিনি নাকি ‘কুরূপা'(?) ছিলেন! সুরঞ্জনা এক যুবকের সাথে কথা বলায় তার হৃদয়ে ঘাসলতাপাতা কী সব দেখেছেন! মেয়ে মানুষকে ভালোবেসে ধরা খেয়েছেন তিনি- “উপেক্ষা সে করেছে আমাকে, ঘৃণা করে চলে গেছে” – এই হলো সিদ্ধান্ত।

বাঙালি নারীদের মনের হদিস আমাদের প্রধান সাহিত্যিকরাও খুঁজে পাননি। আমি পাব সেই আশা করে আপনারা আমার লেখা পড়লেন? আমি দুঃখিত। আমার একটা বৌ আছে। তার দিকে ফিরে শুইলে তার এক মনের দেখা পাই, পাশ ফিরে শুইলে আরেক মন! এই ‘দ্বিমনরূপীতার’ মীমাংসা করতেই আমার রাত কেটে যায়! বাঙালি নারীর মনের খবর আমি জানব কেমনে? বাঙালি পুরুষের মনের মতো হলে নারীর মন ভালো, আর না হলে তা কালো! বঙ্কিম সুন্দর করে বলেছেন- ‘বাঙালি পুরুষের কাছে নিজের বৌ অধিকতর লজ্জাশীলা কুলবধূ হইবেক, অপরের বৌ অধিকতর নির্লজ্জ হইবেক।’

হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন- “মেয়েরা মায়াবতী। মায়াবতীর কোনো পুরুষবাচক শব্দ নেই।” নারীর মাতৃরূপের কোনো ধোঁয়াশা নেই। সকল নারীর মাতৃরূপের জয় হোক। বাংলায় নারীদিবস অর্থবহ হোক।

জয় মাতা-ভগ্নী-জায়া।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *