প্রথম পাতা » মতামত » ভ্যাক্সিন নিয়ে কিছু কথা

ভ্যাক্সিন নিয়ে কিছু কথা

vaccine

ভ্যাক্সিনের ইতিহাস আমার জানা নাই বললেই চলে৷ স্কুলে পড়ার সময় শুনেছি লুই পাস্তুরের কথা আর কলেরার টিকার কথা৷ আর হাজার বছর ধরে উপন্যাসে পড়েছি গ্রামের পর গ্রাম ওলা বিবি কিভাবে উজাড় করে দেয় তার কথা৷ ওলা বিবি সাদা কাপড় পড়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ঘুরে বেড়ায়, আস্তানা বানায় আর সাবাড় করে গ্রামের সব মানুষ৷  আমি প্রথমে ওলা কে ভাবতাম বসন্তগুটি উঠা৷ পরে বুঝলাম এটা কলেরা রোগ৷ ওলা বিবি, বসন্ত বিবি আর যক্ষা বিবি তিন বোন৷ তাদের এক প্রাণ৷ যেখানে যেতো এক সাথে নাকি যেতো৷ বোনের জন্য বোনের ভালবাসা আর মানুষের জন্য সর্বনাশ৷ যাই হউক, পাস্তুরের পদ্ধতির কারনে এখন আর কলেরা নিয়ে ভাবতে হয় না৷

চিকেন পক্স, স্মল পক্স এসবের কথাও সবার জানা৷ হাজার হাজার মানুষ মারা যেত৷ শরীর পঁচে গন্ধ বের হতো৷ কলাপাতায় শুয়ায়ে রাখতো পক্স উঠা মানুষকে৷ যেন পঁচা চামড়া কিছুর সাথে আটকে না যায়৷ পক্স উঠলে কেউ কেউ মারা না গেলেও অনেক ক্ষতি করে যেত পক্স৷ কারো সারা মুখে পক্স হতো গভীর ক্ষত নিয়ে৷ বেঁচে যেতো হয়তো কিন্তু দাঁত আর মাড়ির সাথে থাকতো না৷ দাঁত নড়বড়ে হয়ে যেত, পড়ে যেত৷ গুটিবসন্তের কারনেই লালন ফকিরকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল৷ তারপরের ইতিহাস সবার জানা৷ ইতিহাস জানা না থাকলেও মনের মানুষ উপন্যাস বা সিনেমাটা অনেকেরই দেখা৷ যাই হউক, এখন আর পক্স নিয়ে ভাবতে হয় না৷ কারো কারো এখনো পক্স উঠে৷ কিন্তু ভাবনার কিছুই থাকে না৷ একবার উঠে গেলে আর জীবনে নাকি হয়না৷ আমারও একবার হয়েছিল৷ আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি৷ দুই একটা পক্স উঠেছিল আর জ্বর এবং গায়ে ব্যাথা৷ কিছুদিনের ভেতরেই আরোগ্যলাভ৷ যা আগে কল্পনার অতীত ছিল৷  ভ্যাক্সিন এর ফলাফল এটা৷

পশ্চিমা বিশ্বে ভ্যাক্সিন বিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয় Edward Jenner কে৷ তিনি ১৭৯৬ সালের দিকে কাউপক্স ব্যবহার করে ১৩ বছর বয়সের এক বাচ্চা মেয়েকে স্মল পক্স থেকে সারিয়ে তুলেন৷ তারপর স্মল পক্সের টিকা আনুষ্ঠানিক ভাবে আবিষ্কার হয় ১৭৯৮সালের দিকে৷

এসবের আগেও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সাপের বিষ খেয়ে সাপের কামড় থেকে নিরাপদ থাকার চেষ্টা করতো৷ যাকে বলে বিষে বিষ ক্ষয়৷ সন্ন্যাসীদের বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হতো বা থাকতে হতো৷ তপস্যার জন্য৷ অনেক আশ্রম থাকতো গভীর বনের ভেতরে৷ সাপের কামড়ের সমূহ সম্ভাবনা থাকতো৷ অনেক সন্ন্যাসী সাপের কামড়ে মারা যেতো৷   হোমিওপ্যাথিতেও like cures like বলে তত্ত্ব আছে৷ এই তত্ত্বের এদিক-সেদিক করেই এখনো সব ভ্যাক্সিন বানানো হয়৷ আমি ভ্যাক্সিন বিশেষজ্ঞ নই৷ এই করোনার মধ্যে পড়ে জ্ঞান কিছুটা সবার মতো আমারও বেড়েছে৷

এখন প্রায় ৪০ টিরও বেশি বিভিন্ন রোগের ভ্যাক্সিন রয়েছে বিশ্বে৷ এসব ভ্যাক্সিনের মধ্যে রয়েছে কোভিড-১৯ এর টিকাও৷ কিছু ভ্যাক্সিনকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাইপ লাইন ভ্যাক্সিন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে৷ এসব ভ্যাক্সিন এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয় নাই৷

কোন একটা ভ্যাক্সিন মানুষকে দেয়ার জন্য বাজারে আসলেই সব মানুষ সেটা নেয়ার জন্য ঝাপিয়ে পড়েছে তা নয়৷ সব সময়ই দেখা গেছে যাকে বলে vaccine hesitancy বা vaccine resistance. ১৯৭০-৮০ দশকে আমেরিকাতে রীতিমতো আন্দোলন হয়েছিল ভ্যাক্সিন বিরোধিতা করে৷ এতে করে অনেক কোম্পানি ভ্যাক্সিন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়৷ পূজিবাদ লাভ -ক্ষতির হিসাব আছে জানি৷ আছে আরো নানা রকম নিকাশ৷

যাই হউক, যখন হাম, গুটিবসন্ত,  হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, পোলিও এর টিকা বাংলাদেশে আসে তখনো এসব ভ্যাক্সিনের প্রতি মানুষের ছিল ভয়, সংশয় আর অনীহা৷ আস্তে আস্তে সেটা কেটে গেছে৷ এখন মা বাবারা ভ্যাক্সিন কার্ড করে বাচ্চাদের টিকা দেয়৷ এক সময় পাঠ্যবইয়ে ধনুকের মতো বাকানো বাচ্চাদের ছবি, হামে আক্রান্ত, পোলিওতে আক্রান্ত বাচ্চাদের ছবি দেয়া হতো সচেতনতা তৈরি করার জন্য৷ ভ্যাক্সিন এর কথাও সেখানে বলা হতো৷ এটা একটা উদাহরণ৷ এখন এসব রোগ নাই বললেই চলে৷

করোনার টিকা নিয়েও আছে এই vaccine hesitancy আর vaccine resistance. থাকাটা অস্বাভাবিক না৷ আমাকে একবার আমার আগের চাকরির কাজে তানজানিয়া যেতে হয়েছিল৷ আফ্রিকার দেশ৷ আফ্রিকার দেশে যেতে হলে ইয়েলো ফিভারের টিকা নিতে হয়৷ ইমিগ্রেশনে টিকা কার্ড আর সনদ দেখাতে হয়৷ প্রথমে এই টিকা নেয়ার ভয়ে আমি তানজানিয়া যেতে দ্বিধায় পড়ে গেছিলাম৷ পরে ইয়েলো ফিভার, আর এর টিকা এসব ব্যাপারে ঘাটাঘাটি করে আশ্বস্ত হয়ে টিকা নিলাম৷ তানজানিয়া গেলাম৷

করোনার টিকা আমি নিয়েছি৷ দুই ডোজ৷ কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল৷ কিন্তু বিজ্ঞানের উপর আস্থাটাও ছিল৷ আর বাকিটা তো আল্লাহ ভরসা৷ মোট কথা সবার টিকা নেয়া উচিত৷ সব সংশয় কাটিয়ে৷ শুরুর দিকে যেরকম সংশয় আর অনীহা ছিল এখন তা অনেকটাই কেটে গেছে৷ অনেকেই টিকা নিতে আগ্রহী এখন৷ টিকাও আছে আর আসছে৷ টিকা নিয়ে অনেক অপতথ্যও কমে গেছে৷ যাই হউক, আল্লাহ ভরসা করে সবার টিকা নেয়া উচিত৷ এই আহবান যারা এখনো টিকা নেয়নি তাদের প্রতি৷ আমি আহবান করার কে সেটা আমি জানিনা৷  যেটা জানি সেটা সবাই জানে, Herd Immunity দরকার৷ যতো টিকা নেয়া হবে এই পাল হিসেবে টিকে থাকা ততো শক্তপোক্ত হবে৷

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *