প্রথম পাতা » মতামত » সংকট হোক সমাধানের উৎস

সংকট হোক সমাধানের উৎস

Crisis

দেখুন, ভোজ্য তেলের যে সংকট বাংলাদেশে চলছে, এই সংকটটা শুধু বাংলাদেশের নয়- বিশ্বব্যাপী।

ইতোমধ্যে ইংল্যান্ড তেলের ব্যবহার সীমিত করেছে, ভোজ্য তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক ভারতে লিটার প্রতি মূল্য ২০৫+, জার্মানির অবস্থা অনেক বেশিই খারাপ। এই হচ্ছে মোটামুটি বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দামের ধারণা।

তেলের দাম হটাৎ বৃদ্ধি পেলো কি-না?

না। তেলের এই অস্বস্তিকর মূল্যবৃদ্ধি কিন্তু হটাৎ নয়! বাড়ছে গত এক বছর ধরে। বিশ্ববাজারে এক বছর ধরেই তেলসহ নিত্যপণ্যের অনেক কিছুর দাম বাড়তির দিকেই ছিলো। বিশেষ করে ২০২০ সালের শেষ দিকে এসে গোটা বিশ্বেই এই প্রবণতা দেখা যায়। এটার কারণ হিশেবে কোভিড-১৯ মহামারিকে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

তবে এই উদ্ভূত পরিস্থিতির সবথেকে বেশি অবনতি হয়েছে এবছর ফেব্রুয়ারি থেকে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে। এই দুটি দেশ থেকে তেল সরবরাহে ঘাটতি হওয়ায় বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাপক চাপে পড়ে পাম ও সয়াবিন তেল আমদানির উপর।

আমরা যখন একদিকে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা নিয়ে উন্মাদনায় মাতোয়ারা, তখন অন্যদিকে এই দুই দেশ বিশ্ববাজারে ছড়ি ঘুরাচ্ছে ভোজ্য তেল নিয়ে। বাংলাদেশ মূলত সয়াবিন তেল আমদানি করে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা থেকে। কিন্তু এবার সেখানে প্রচন্ড খরা, যার কারণে উৎপাদন কম। এর ফলে রাতারাতি বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধিতে এই দুই দেশ বিশাল ভূমিকা পালন করছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অনেকটা ক্ষতি পোহাতে হচ্ছে পাম তেলের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী দেশ ইন্দোনেশিয়াকে। এবছর এপ্রিলের শেষের দিকে তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয় তারা। ইন্দোনেশিয়ার তেল রপ্তানি বন্ধের ঘাটতি এখন হাড়েহাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশের বাজারে।

আপাতত ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধির পেছনে এগুলোই হতে পারে মূলকারণ। আমার দেশের বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী মধ্যবিত্ত ও দারিদ্রসীমার নিচে বাস করায় তেলের দামটা আপাতদৃষ্টিতে অনেক বেশিই মনে হতে পারে। তবে বিশ্ববাজারের কথা চিন্তা করলে এই মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক কিছু নয়, তবে এটি নিঃসন্দেহে যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যই অস্বস্তিকর।

তেল নিয়ে অন্য দেশের মতো বাংলাদেশও অনেকটা বেকায়দায় পড়তে যাচ্ছে! যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে আমার দেশের নির্দিষ্ট এক শ্রেণির মানুষ সর্বাগ্রে দোষারোপ করে সরকারকে। তেলের দাম বৃদ্ধিতেও তার ব্যত্যয় ঘটতে দেখছিনা। বরাবরের মতো তেল ইস্যু নিয়ে এখানে-ওখানে, পাড়ার অলিতে-গলিতে, হাটে-বাজারে, আড্ডাখানায়, এমনকি দ্বিতীয় সংসদ ভবন খ্যাত চায়ের দোকানগুলোতে ছোড়াছুড়ি হচ্ছে পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের কথা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারকে দোষারোপ আপনি করতেই পারেন; তবে সেটা হতে হবে যৌক্তিক। আপনাকে দোষ দেওয়ার আগে পারিপার্শ্বিক সার্বিক দিক বিবেচনায় আনতে হবে, আপনাকে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে হবে- তারপরেই হতে পারে যৌক্তিক আলোচনা। আপনি সরকারের ভিতরে থাকা আপত্তিকর সিস্টেমের পরিবর্তন দাবি করতে পারেন। সিস্টেম পরিবর্তনের বদলে আপনি যদি সরকার উৎখাত বা সরাসরি সরকার পতনের আগ্রহ প্রকাশ করেন, তখন আপনার উদ্দেশ্যটা ভিন্নার্থ বহন করে।

অবশ্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ইদুল ফিতরের আগেই দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার ইদের কথা বিবেচনায় রেখে সেই সিদ্ধান্তে যায়নি৷ সরকার ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব গ্রহণ না করায় হয়তো তেল বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ করা হয়নি। যার কারণে বাংলাদেশে সম্প্রতি হটাৎ করেই বিশ্ববাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। আর তার সঙ্গে এই নাইনটি টুয়ের দেশের ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় বাড়তি মূল্য যোগ করবেনা, কৃত্রিম সংকট তৈরি করবেনা- এমনটা তো আশা করা যায়না।

কোনো সংকট এলে আমরা সেটা নিয়ে যতটা সময় হাহুতাশ করে কাটায়, ততটা সময় যদি বিকল্প উপায় খুঁজে পাওয়ার পেছনে দেওয়া যেত, তাহলে সংকট হতে পারতো বিকল্পপন্থা নিরূপণের মাধ্যম। কৃষি প্রধান দেশ হিশেবে সয়াবিন কিংবা পাম তেলের বিকল্পে আমরা বিভিন্নরকমের তৈলজাত ফসল চাষে ঝুঁকতে পারি৷ হতেপারে সেটা সরিষা, তিল, বাদাম, সূর্যমুখী কিংবা অন্য কোনো উদ্ভিদ। এখন তো ধানের কুড়া থেকেও তেল উৎপাদন হচ্ছে, যা শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত। ছোটোকালে মামাবাড়িতে ভেন্নাগাছের তেল ব্যবহার করতে দেখেছি৷ এই ভেন্না তেলের পুষ্টিগুণ কিন্তু সয়াবিন তেলের থেকে কোনো অংশেই কম নয়! ভেন্না বললে অনেকেই চিনবেনা, এটির ইংরেজি নাম ‘ক্যাস্টর অয়েল’। অবশ্য এই ভেন্নাগাছ এখন বিলুপ্তির পথে, খুব একটা দেখা মেলেনা বললেই চলে।

এই যে তেল নিয়ে এত কথা- এত প্রসঙ্গ, অথচ আপনাকে তেল খেতেই হবে এমনটা কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়! বিশ্বে তেল না খেয়ে মরার নজির নেই, তবে তেল খেয়ে মরে যাওয়ার নজির আছে। বরং যারা তেল খায়না, তাদের গড় আয়ু অন্যদের তুলনায় বেশিই হয়ে থাকে। জাপান কিন্তু সেরা উদাহরণ হতে পারে! (জাপানিরা ভোজ্য তেল ব্যবহার করে, তবে অত্যধিক কম।) তেল বাদেও কিংবা কম পরিমাণ তেল ব্যবহার করেও রান্না করা যায়- আমাদের মধ্যে এ ধারণা ও অভ্যাস গড়ে তোলাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।

পৃথিবীর বয়স যত বাড়বে, সমস্যার পরিমাণ ততই বাড়তে থাকবে। বুদ্ধিমান তাঁরাই, যারা সমস্যাকে এড়িয়ে নয়- সমস্যার সমাধান করে বাঁচে এবং অন্যকে বাঁচায়৷ শত-সহস্র সংকটের মধ্য থেকেই আমাদের খুঁজে নিতে হবে সমাধান। সংকট হোক সমাধানের উৎস৷

লেখক : শিক্ষার্থী

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *