হুমায়ূনের ভুবনের সাথে পরিচয়ের শুরুটা কবে মনে নেই। আমি অজপাড়াগাঁ থেকে কেবল রাজধানীর অনতিদূরের একটি মফস্বলে গিয়েছি নব্বই দশকের শুরুতে। তখন সবেধন নীলমণি ‘বিটিভি’র স্বর্ণযুগ। যা দেখায় তা-ই ভালো লাগে। বাতাবি লেবুর চাষও যে এতো সিনেমাটিক হতে পারে তখন তা ভেবে অবাক হতাম ! কুলসন সেমাই, ম্যাগি নুডলস, সোয়ান ফোমের এ্যাডগুলোও তো কতো ভালো লাগতো! এইসব এ্যাডের অভিনেতাদের সবাইকে প্রতিদিন পর্দায় দেখতাম তাই আপন মনে হতো আমাদের কাছে। বাকের ভাই, বাকের ভাই বলে একটা রব উঠছে তখন এখানে সেখানে। গলায় চেইন, চোখে সানগ্লাস পড়ে পাড়াতো নয়া মাস্তানরা তখন ঘুরে বেড়াতো। মুখে গান : হাওয়া ম্যায় উড়তা যায়ে….! ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাই জেলে গেলেন। খুনের মামলায় তার সাজা হলো মৃত্যুদণ্ড। শহরের রাস্তায় মিছিল হলো : “বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে/ বাকের ভাইয়ের মুক্তি চাই, কুত্তাওয়ালির ফাঁসি চাই!” একদিন রাতে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হলো। পুরো দেশ নিস্তব্ধ! একজন লেখকের নিষ্ঠুরতায় দর্শকেরা ব্যাপক বেকুববনে গেলো! এই নাটকের নির্মাতা সম্পর্কে বলার কিছু আছে? একদিন এক বৃদ্ধ ফুলার রোড দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। হুমায়ূনের সাথে দেখা। তিনি বৃদ্ধকে বললেন : “স্যার, আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি হুমায়ূন, আপনার ছাত্র।”
বৃদ্ধ ভালোভাবে লক্ষ করলেন এবং বললেন : “তুই হুমায়ূন না। তুই হুমায়ূন আহমেদ।” হুমায়ূন হয়ে উঠলেন হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা নাটকে তখন উজ্জ্বল একটি নাম হুমায়ূন আহমেদ- বাদশাহ নামদার হুমায়ূন!
নহাশ চলচ্চিত্র এবং হুমায়ূন আহমেদ নামটিই ছিল প্রতিদিনের বাংলাদেশের পারিবারিক নির্মল হাসির উৎস। রাতে সকলে একসাথে বসে হুমায়ূনের নাটক দেখার ছিল অন্য এক অনুভূতি। আমরা সেই অনুভূতির মধ্য দিয়ে যেতে পেরেছি বলে নিজেদের একটা ভাগ্যবান প্রজন্ম মনে করি। ‘যে সন্তান তার বাবার সাথে বসে রাতের খাবার খায় সেই সন্তান কখনো বিনষ্ট হয় না।’ বিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদের নাটকগুলোর রাতে অন্তত আমাদের প্রজন্মটা বাবাদের সাথে রাতের খাবার খেতে পেরেছে। ‘আজ রবিবার’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘অয়োময়’, ‘জোছনার ফুল’ আমাদের শৈশব ও কৈশোরের সুর। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। যিনি স্বাতন্ত্র্যস্বরে আমাদের মনোজগতকে করেছিলেন আন্দোলিত, বিমোহিত।
হুমায়ূনের লেখায় গভীরতা নেই, অপন্যাসটাইপ লেখা বলে অনেক বড়ো বড়ো সাহিত্যবোদ্ধা একসময় নাক কুঁচকাতো। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে যাঁদের লেখায় গভীরতা আছে মনে করা হয় তাঁদের বই সাহিত্যের ছাত্র ছাড়া শতকরা কতজন পড়ে তা হিসাবের জন্য পাঠকশুমারি প্রয়োজন। কিন্তু আপনি নব্বই দশকের দুপুরবেলায় মফস্বলের পুকুরঘাটেও দেখবেন মীরা, নবনী, এশারা বসে আছে। শহরের অলস দুপুরে দেখবেন বাদল, হিমু, মিসির আলীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। হুমায়ূন আহমেদের একটি বই শুরু করেছেন কী শেষ না করে ওঠার উপায় নেই। একটি মোহনীয় আবেশে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা এগিয়ে যাবে। শেষ করে আপনি হয়তো বলবেন আমি কী শিখলাম? আপনি গল্পের বই পড়ে যদি শিখতে চান তবে এদেশে কোটি কোটি স্কুল কলেজ মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয় আছে কোন কামে? আপনি যদি নির্ভেজাল পাঠের আনন্দ পেয়ে থাকেন তবেই লেখকের সার্থকতা। লেখকের কলম গুরুর হাতের বেত নয় যে আপনাকে তা থেকে শিখতে হবে? বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ উপন্যাস আপনাকে কী শিখিয়েছে? এই গভীর উপন্যাসটির কয় পৃষ্ঠা আপনি নিঃস্বার্থভাবে পড়েছেন বলেন তো? ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ তো আরো গভীর। পড়েছেন? বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে গভীরতর সাহিত্যিক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। চাকরির পরীক্ষার্থী এবং সাহিত্যের ছাত্র ছাড়া তাঁর নাম বঙ্গবাসী কেউ শুনেছে বলে তো মনে হয় না। ‘জীবনের সাথে জীবন যোগ করা না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।’ হুমায়ূন আহমেদ বাংলার একটি শ্রেণিকে তাঁর গল্পের উপজীব্য করেছেন। সর্বসহায়হারা মধ্যবিত্তশ্রেণি! হুমায়ূনের মধ্যবিত্তরা আজ অবশ্য প্রান্তে বাস করা জনগণ! তিনি বেঁচে থাকলে এদের কথকতা নির্মাণ করতেন। জীবন চালাতে খেই হারিয়ে ফেলা এইসব লোকজন তাঁর নাটক সিনেমায় ওঠে আসতো।
বাংলা একাডেমির বইমেলাকে প্রায় একাই চালিয়ে নিয়েছিলেন তিনি! ভাবা যায় একটি দেশের প্রকাশনাশিল্পকে বিদেশি প্রভাবমুক্ত করে দেশজ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়েছেন। হুমায়ূনের মতো নাট্যকার নেই বলেই ঘরে ঘরে একটি কলমের কালি শেষ হওয়ায় ফিজিক্সে ৯৮ পাওয়া মেয়েটির গল্প শুনে বাংলার ঘরে কান্নার রোল! বাংলাদেশের নাটকের সংলাপ শুনেছেন? আর কয়দিন পর খালি টুট টুট শুনবেন! সংলাপ পাবেন না!
হুমায়ূন আহমেদ বাজার ধরতে পেরেছিলেন। তাঁর একটি পাণ্ডুলিপি পেতে বাজারের ব্যাগে করে নগদ টাকা লাগতো দশ লাখ! সুতরাং তিনি ‘বাজারি’ লেখক ছাড়া আর কী? হুমায়ূন কি কখনো অপরিমিত স্বপ্ন দেখিয়েছেন কাউকে? কেন একটা প্রজন্ম এভাবে তাঁর প্রতি সম্মোহিত হলো এটাটা গবেষণার বিষয়! কী জাদু তিনি জানতেন যে তরুণ তরুণীদের মাতাল হাওয়ায় ভাসালেন? সাবলীল সংলাপেই তো মানুষ হেসেছে, কেঁদেছে। আরোপিত কিছু তো ছিল না কখনো।
হিমু নাকি জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো উদ্ভ্রান্ত এক যুবক! আশি- নব্বই দশকের হস্তশিল্পের কালে কেমন ছিল আমাদের যুবকেরা? একটু রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক গবেষণা করে দেখবেন। হিমু কেন সংসারী হলো না, নাকি হতে পারলো না! আর জীবনের মোকাবেলা করেই বা লাভ কী? বেশি বুঝলে গ্রাম ছাড়া লাগে, আর এদেশে জীবনের মোকাবেলা করতে গেলে হিরো থেকে জিরো হতে হয়! মুদির দোকানে বসতে হয়! হিমু তো খারাপ করে নাই। জীবনে সবাই কি বিলগেটস হয়? সবাই কি আইনস্টাইন হয়!
হয়তো এখন বলা হবে- হুমায়ূনের লেখা কয়দিন টেকে দেখেন। আমি বলি কার লেখা কয়দিন টেকে সেটা লেখকের সক্ষমতার সাথে সাথে একটি জাতিরর রুচির ওপরও নির্ভর করে। আমাদের পাঠের রুচি, দেখার রুচি কোনদিকে যাচ্ছে সেটাও তো ভাবতে হবে।
হুমায়ূন আহমেদকে একবার জিজ্ঞেস করা হলো : আপনাকে অনেকে বাজারি লেখক বলে, সস্তা লেখক বলে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন : আমার বইগুলো বেশি দামি না। একশ, দেড়শ টাকার মতো! সুতরাং সস্তাতো বলাই যায়! আর বাজারি লেখক বলাটাও যুক্তিসঙ্গত। কারণ আমার বই বাজারে হরহামেশাই পাওয়া যায়!
যে লেখকের বই একটি বইমেলায় এক লক্ষ কপি বিক্রি হয় তাঁকে ‘বাজারি’ লেখক না বলে উপায় কী? তাঁর লেখায় গভীরতা পরখ করার জন্য ‘চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক’, ‘অচিনপুর’, ‘গৌরিপুর জংশন’, ‘একাত্তর’, ‘মধ্যাহ্ন’ ‘রূপার পালঙ্ক’ আর গল্পসমগ্র পড়ে দেখবেন।
কালোত্তীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা উদ্ধৃত করে বলেছিলেন : “আমি যতদিন আছি, তুমিও থাকিও প্রিয়!”
বাংলা সাহিত্যে টাকার জন্য প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন জীবনানন্দ, নজরুলসহ অনেকেই! হুমায়ূনকে সে পথে হাঁটতে হয়নি। প্রকাশকরাই তাঁর দ্বারে গিয়েছেন চটের ব্যাগভর্তি নগদ টাকা নিয়ে! একটা পাণ্ডুলিপির জন্য অপেক্ষা করেছেন বছরের পরর বছর!
এই লেখক অবশ্যই ‘বাজারি’ লেখক!