নাটক বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি হলেও নাটক আর বাস্তবজীবন যে সমান্তরাল নয়, মনে হয় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির অলোক্সন্দ্রোভিচ জেলেনেস্কির চেয়ে খুব কম লোকই এটা অনুভব করতে পেরেছেন। কমেডি আর প্রহসনমূলক নাটকের অভিনেতা জেলেনেস্কি বিশ্বরাজনীতির প্রহসনমূলক নাটকের ট্রাজিক নায়কে পরিণত হয়েছেন। একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস।
সিনেমা নাটক অভিনয় আর প্রডাকশন নিয়ে বেশ ভালোই ছিলেন জেলেনেস্কি। হাস্যরস আর উপহাস-পরিহাস ছিল জেলেনেস্কির অভিনয়ক্ষেত্র। তাঁর প্রযোজিত জনসেবক বা Servant Of the People (২০১৫ থেকে ২০১৯) টিভি সিরিজ ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। জেলেনেস্কি এতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় অভিনয় করেন। প্রসঙ্গত, কেউ চাইলে অনিল কাপুর অভিনীত হিন্দি সিনেমা ‘নায়ক’ দেখতে পারেন। জনসেবকের স্বাদ পাবেন। ইউক্রেনের মানুষ তাদের কাঙিক্ষত প্রেসিডেন্টের স্বরূপ দেখতে পায় জেলেনিস্কির চরিত্রে। ২০১৮ সালে এই নাটকের নামেই (Servant Of the People) একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ২০১৯ সালে তিনি বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। রূপালি পর্দার প্রেসিডেন্ট বাস্তবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। ন্যাটোমুখী হওয়ার কারণে দ্রুতই প্রতিবেশী রাশিয়ার রোষানলে পড়েন তিনি। তাঁর সর্বশেষ অবস্থা আমরা সবাই জানি।
একদিকে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে রাশিয়া। তিনি প্রতিবেশীর আধিপত্য-বলয় থেকে দূরে থাকতে চয়েছিলেন। এর পেছনে তাঁর দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদী চেতনা অবশ্যই আছে। কিন্তু শক্তিধর প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক রক্ষার কৌশলে তিনি আনাড়িপনা দেখিয়েছেন। পুতিনের মতো মাথাখারাপ একনায়ক যে দেশটির নিরঙ্কুশ নেতা তার থাবা থেকে নিজেকে রক্ষার উপায় তার জানা নেই বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লড়াই করে আত্মাহূতির মাধ্যমে জাতীয় বীরের মর্যাদা লাভের সুযোগ তার আছে। তিনি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন নাটকের মঞ্চ আর রাজনীতির মঞ্চ এক নয়। ন্যাটো এবং আমেরিকার আশ্বাসে বিশ্বাস করা তাঁর জীবনের বড় ভুল। তাঁর যখন সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দরকার তখন আমেরিকা তাঁকে দেশান্তরী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। ভণ্ডামি আর কাকে বলে! তবে তিনি দেশ ছাড়তে নারাজি জানিয়েছেন। এটা তাঁর বীরত্ব ও দেশপ্রেমের প্রমাণ।
জেলেনেস্কির প্রতি আমার একটা মোহ আছে। আমি তাঁকে নিয়ে ফেবুতে লিখেছি। তিনি প্রেসিডেন্ট হবার পর সরকারি কর্মকর্তাদের অফিসে প্রেসিডেন্টের ছবি টানানোর বদলে পিতামাতার ছবি টানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। পিতারমাতার মুখের দিকে তাকিয়ে সততা রক্ষার কথা বলেছিলেন, পিতামাতার যত্ন নিতে অনুরোধ করেছিলেন। বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
অনেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাড়িপোড়ার সুবাদে আলুপোড়া খাওয়ার মতো অবিবেচক মানুষের অভাব নেই আমাদের সমাজে। অনেকে আবার রাশিয়ার পক্ষে সাফাই গাইছেন। এরাও অবিচেক। বিশ্বযুদ্ধ হচ্ছে না। জেলেনিস্কি গেলেই ল্যাঠা চুকে যায়। আমার ধারণা জেলেনিস্কিকে যেতে হবে। অথবা তাঁকে রাশিয়ার বশ্যতা স্বীকার করে থাকতে হবে।
মাথাপিছু আয় অনুযায়ী ইউক্রেন ইউরোপের সবচেয়ে গরিব দেশ কিন্তু আয়তনের দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম। এ দেশের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক লেনদেন খুব বেশি নয়। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশকে ভোগাবে মনে হয়। বাংলাদেশ বিশ্বে ৫ম বৃহত্তম গম আমদানিকারক দেশ। গম রপ্তানিতে বিশ্বে রাশিয়া প্রথম ও ইউক্রেন চতুর্থ। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি গম আমদানি করে রাশিয়া থেকে। বৈশ্বিক আর্থিক লেনদনের মাধ্যম সুইফট রাশিয়ার অনেকগুলো ব্যাংককে তাদের নেটওয়ার্ক থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশের আমদানি-রপ্তানি লেনদেনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। গমের দাম বাড়তে পারে। ফলে আটার দাম বাড়বে নিশ্চিত। তেলের দাম হুহু করে বাড়ছে। দেশের শেয়ার বাজার কুপোকাত।
অতএব সুদূর সাইবেরীয় অঞ্চলে কী হচ্ছে এ নিয়ে না ভাবলেও চলবে, এমনটা ভাবা হবে বোকামি।
ছবি : Servant of the People সিরিজের পোস্টারে জেলেনিস্কি।