একুশ চেতনা ও কিছু প্রায়োগিক দিকসমূহের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। মনে, মননে, কাজে ও ভাষা প্রয়োগের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষার যথাযথ অবস্থান ও স্বতঃস্ফর্ত মর্যাদা নিশ্চিত করতে আমরা আজও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছি কি? বিষয়টি কয়েকটি ধাপে বিচার করা যেতে পারে। যথা :
১. ভাষা পরিকল্পক মহলের তৎপরতার অভাব;
২. বাংলা ভাষাপ্রযুক্তিতে অনগ্রসরতা এবং
৩. কালচারাল ও সাইক্লোজিক্যাল কনসেন্ট উৎপাদনে অনগ্রসরতা।
বাংলা ভাষাকে এর প্রতিবেশগত আসপেক্ট স্টাডি করে একটি গ্রহণযোগ্য, পূর্ণাঙ্গ ও নিঁখুত ফরমেট (ভাষা পরিকল্পনা) প্রদান করার গুরু দায়িত্ব কিন্তু বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির। অনেকে মনে করেন বাংলা ভাষার তো একটি ফরমেট ও উন্নত ব্যাকরণ আছেই- তাহলে আবার নতুন করে কীসের ফরমেট প্রয়োজন? রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের বাংলা ভাষার যে ফরমেট (ভাষা পরিকল্পনা) বিদ্যমান, তা এখনো সর্বমহলের নিষ্কণ্টক গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বাংলা বানান রীতি প্রয়োগের দ্বন্দ্বে আজও ইসলামিক ফাউন্ডেশন, কতিপয় নিবন্ধিত প্রকাশনা সংস্থাকে নিয়ে বাংলা একাডেমি এখনো দ্বিধা-বিভক্ত। বিবিধ অমীমাংসিত বিষয়ে বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট, কলকাতার বাংলা আকাদেমি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, এনসিটিবি, নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রকাশনা সংস্থাসমূকে যুক্তির ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। এটি এখন সময়ের দাবি- এই কথাটিও এখন অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। এ বিষয়-সংশ্লিষ্ট সকল বিতর্ক নিরসন করে বাংলা ভাষার শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করতে বাংলা একাডেমিকেই মন্সিয়ানার পরিচয় দিতে হবে।
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত সর্বমোট ধ্বনি ও বর্ণ সংখ্যা কয়টি ও কী কী- এর পূর্ণাঙ্গ তালিকা স্পষ্ট করা জরুরি। কেউ বলছেন বাংলা স্বর ধ্বনির সংখ্যা ১১টি, কেউ বলছেন ০৭টি, কেউ বলছেন ১৮টি আবার কেউ দেখিয়েছেন ৩২টি ইত্যাদি- এমন সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ার হার নিতান্তই কম নয়। বাংলা ধ্বনি ও বর্ণের পারস্পারিক দ্বন্দ্ব মিটিয়ে প্রয়োজনীয় নতুন বর্ণের সংযুক্তি ও অপ্রয়োজনীয় বর্ণকে তালিকা থেকে অপসরণ করে কার্যকর তালিকা প্রণয়ন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা লক্ষণীয়। বাংলা বর্ণের প্রকৃতরূপগত পরিচয় এখনো সুনির্দিষ্ট নয়, যা সত্যি দুঃখজনক। প্রত্যেকটি ইনডিভিজুয়্যাল বর্ণের আঁচড় পরিচিতির ব্যাপারে তেমন কাউকে সরব দেখতে পাওয়া যায় না। যা বর্ণ চর্চা ও বর্ণের আকৃতিগত পরিচয়কে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। প্রতিটি বর্ণের আকৃতি, আঁচড় সংখ্যা ও আঁচড়ের গতিপথসহ সুনির্দিষ্ট বিবরণ সম্বলিত গেজেট প্রকাশ আমাদের বর্ণমালার কাঙ্ক্ষিত দৃঢ়তা প্রদান করবে।ভাষার আসপেক্টসমূহের কার্যকরিতা স্টাডি করে আশু পদক্ষেপ প্রয়োজন। বাংলা একাডেমি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের যেন আর কিছুই করার নেই।
একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অনলাইনে বাংলা ভাষার ব্যবহার দক্ষতায় আমরা জাতীয়ভাবেই দরিদ্র অবস্থায় আছি। উইন্ডোস, লিনাক্স, ম্যাক, অ্যান্ড্রয়েডসহ বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেমে বাংলা ভাষার যথাযথ মর্যদার ব্যবস্থা আমরা এখনো করতে পারিনি। গুগল, বিংসহ অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর অন্যান্য প্রভাবশালী ভাষার দৌঁড়ে কাঙ্ক্ষিত অবস্থান ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারিনি। বাংলা ভাষাভিত্তিক একমাত্র সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’কে আমরা ফেলে রেখেছি পরম অবহেলায়। অনলাইন ও অফলাইন অ্যাপসসমূহে বাংলা ব্যবহার রীতি, ব্যাকরণ ও অভিধান ডাটাবেজ সন্নিবেশ এখনো করতে পারিনি আমরা। ফলে বাংলা অটো কারেকশন সুবিধা নিশ্চয়নে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক বৈশ্বিক ভাষা প্রতিযোগে আমাদের উপস্থিতি শূণ্যের কোঠায় রেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি হরহামেশাই। এ সকল পশ্চাদপদতাকে বিবেচনায় এনে বাংলাদেশ সরকারের এ টু আই প্রজেক্ট এর আওতায় বাংলা ভাষাপ্রযুক্তি উন্নয়নবিষয়ক কর্মতৎপরতার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে মাত্র। এই উদ্যোগের ফল এখনো দৃশ্যমান হয়নি। এ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিতমাত্রায় বেসরকারি উদ্যোগ এখনো চোখে পড়েনি।
ইতিহাস পাঠে আমরা জানতে পারি যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করতে বাংলা ভাষার মর্যাদায়নের চেষ্টা প্রধান নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। বিদেশি কালচারের উৎপাতে আমাদের বাঙালির নিজস্ব মন মগজ উৎখাতের উপক্রম। ফলে আনমনে, সূক্ষ্মভাবে বুদ্ধি ও ধূর্ততার সাথে বিদেশি কালচার চর্চা আমাদের মনে এমন ইনফ্রিয়র ভ্যাক্সিন পুশ করেছে যে, আমাদের নিজস্ব বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে ফকিন্নি ভাষা ও ফকিন্নি সংস্কৃতি জ্ঞান করে নিজেদেরকে স্মার্ট ও আপগ্রেডেড মনে করছি। ব্যাপারটি খুবই দুঃখজনক। কালচারাল ও সাইক্লোজিক্যাল কনসেন্ট উৎপাদনে আমাদের এখানেই প্রধান অনগ্রসরতা। আমরা এই অনগ্রসরতা যতদিনে টের পেয়েছি ততদিনে পানি অনেক দূর গড়িয়েছে।
মোদ্দাকথা, কেবল বায়বীয় একুশ চেতনা নয় বরং বাস্তবিক ও প্রায়োগিক অর্থেই বাংলা ভাষার মর্যাদায়ন নিশ্চয়নে প্রয়োজন সাইন্টিফিক মেগা প্রজেক্ট। আর এই প্রজেক্ট আত্মীকরণ ও বাস্তবায়নে সত্যিকারের একুশ-চেতনা ৭১ এর মতোই আমাদেরকে আবারো পথ চেনাবে, বাঁধা মাড়িঁয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং পরম প্রেষণা দিয়ে সফলতার পরশ পাথর হিসেবে ভূমিকা রাখবে।