প্রথম পাতা » মতামত » বিবর্ণ স্বাধীনতা!

বিবর্ণ স্বাধীনতা!

independence

যদিও আমি এক ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’ তবু আমার অনুভবে স্বাধীনতা প্রতিনিয়তই সুবর্ণ। কিন্তু গত কিছু দিনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতায় ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি : আমাদের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা’ বিষয়ে ভাবছিলাম। কলেজে এ বিষয়ে একটি রচনাও লিখতে দিয়েছিলাম। তেমন নতুন কিছু পাওয়া যায়নি। ছেলেমেয়েরা আগ্রহ নিয়ে লিখেছে, পুরস্কার জিতেছে, ব্যস। ঘটনা এখানেই শেষ। কিন্তু মন থেকে বিষয়টি যায়নি। তাই একটু লিখতে বসা।

গত দশকে দেশে প্রচুর কালভার্ট, ব্রিজ, রাস্তা, বিদ্যুৎ পরিষেবার বিস্তার হয়েছে। আমাদের গাভীরা প্রচুর দুধ দিয়েছে। শাক সবজির ফলন বাম্পার। ছাদকৃষি অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে গিয়েছে। আর বাতাবি লেবুর ফলন হয়েছে প্রচুর। কিন্তু পরপর চার বাজার হালি হালি লেবু কিনেও আমি পাইনি একফোঁটা রস। সবুজ শাক সবজি এতো ফলেছে কিন্তু মানুষের হৃদয়ে দেখেছি পাষাণসম প্রখরতা। গরুর দুধ কিনে কয়েক লিটার ফেলে দিয়েছি। মুখে তোলা যায়নি। বিষ মনে হয়েছে। ছেলেরা দুধের জন্য কেঁদেছে। আমি ওদের মুখে বিষ দিতে চাইনি। আমি এখনো বাজারে শিশু খাদ্যের নিরাপত্তা পাইনি। ওদের মুখে একটি করে খাবার তুলে দিই আর বলি : বাবারা কম খাও। বিষ এতো খেতে নেই। ওদের জন্য তেমন কোনো বিনোদন – ব্যবস্থা নেই। ওদের জন্য নাটক নেই, সিনেমা নেই, বই নেই, কোনো লেখক নেই, কার্টুন নেই। ওরাও বড়দের সিনেমা দেখে। নায়ক নায়িকার লদকা লদকি দেখে। বড় ছেলে প্রশ্ন করে : ‘এইটা কী হইল বাবা?’ আমি জোরে ধমক দেই : চুপ থাক বদ পোলা। চ্যানেল ঘোরায়া দে…!

সমস্যা তাতে কমে না। বরং বাড়ে। গত দশকে দেশে ধর্মান্ধতার চাষ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। যে মেয়েটি বরাবর কলেজে ফার্স্ট হয়, আবৃত্তি করে ভালো, বক্তৃতায় দিগ্বিজয়ী! সে হঠাৎ মাদ্রাসায় ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয় ইসলামের খেদমতের জন্য। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চায় না। সে জেনেছে ইসলাম কেবল এদেশের মাদ্রাসাগুলোতেই আছে। আর কোথাও ইসলাম নেই। বাজারে প্রচুর বোরখা বিক্রি হয়। কলেজে সবাই প্রায় বোরখা পরেই আসে। বাজারে গেলে হঠাৎ মেয়েরা চিৎকার করে সালাম দেয়। আমি চমকে উঠি : তুমি কে? ‘স্যার, আমাকে চিনলেন না? আমি অমুক’! কস কী? তোরে তো দেখি নাই। কলেজে তো হিজাব পড়স। বাজারে এভাবে কেন? পার্লারে গেছিলাম স্যার। বেড়াইতে যামু তো! তাই বোরখা পরি নাই! ‘অ আচ্ছা।’ কোনো এক হাজি সাব নতুন হজ করে এসেছেন। তিনি ঘোষণা দিলেন : আমাগো বউ বাজারে যাইব। সবাই সইরা যান। বৌয়ের পর্দা যেন নষ্ট না হয় সজন্য চেষ্টা ! মানুষ এখন লোকদেখানোতে বিশ্বাসী। যা মনে আছে তা বাইরে নাই, যা বাইরে আছে তা মনে নাই। মানুষ এখন আচারসর্বস্ব ছাড়া আর কিছু নয়।

মানুষের মাঝ থেকে ধৈর্য, সহনশীলতা, সহমর্মিতা বিষয়গুলো ওঠে গেছে। এন্ড্রয়েড মোবাইলের গতিতে সবাই সব চায় অতি দ্রুত। গতকাল আর আজকে বাইক এক্সিডেন্টে আমার তিনজন সাবেক ছাত্র মারা গেলো! আহা জীবনের কী নির্মম অপচয়! গত এক সপ্তাহে সামান্য কারণে চারজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো আমাদের আশে পাশে । এরা আমার পরিচিত! সবাই ঠাণ্ডা প্রকৃতির। তারা হত্যাগুলোও করলো ঠাণ্ডা মাথায়। অতি সতর্কতার সাথে একজনকে সেদিন জবাই করা হলো! একেবারে নীরবে। বিসমিল্লাহ বলে ছুরির ধার দেখলো। গলায় চালানোর পর জোরে আল্লাহু আকবারও বলেছে কয়েকবার। লোকটা কোরবানির গরুর মতো ছটফট করতে করতেই মারা গেলো। মানুষের কণ্ঠে কী আশ্চর্য পশুর রব!

এখন রাজনীতির পোয়া বারো। কেউ আর ভিন্নদলে নাই। সবাই এখন আওয়ামীলীগার। কেউ কেউ তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বড় নৌকাপ্রেমী। বঙ্গবন্ধুর তেজি আদর্শের সৈনিক তারা। সেদিন যুবলীগের কোনো এক সভায় নারায়ে তাকবির ধ্বনিতে নাকি প্রকম্পিত হলো আকাশ বাতাস! এটি নিয়ে অনেকে হাসল দেখলাম। কেন বঙ্গবন্ধুর দলের সবাই কি নাস্তিক নাকি? বঙ্গবন্ধু কি ইসলামের খেদমত করেন নাই? এদেশে ইসলামের প্রসারে তাঁর অবদান নেই? যুবলীগের কেউ কি কখনো তাকবির দেয় না? আসল কথা হলো ‘নারায়ে তাকবির’ যারা বলে তারাও মন থেকে বলে না আবার ‘জয় বাংলা’ এখন যাদের মুখ থেকে বের হয় তাদেরও অনেকের এই স্লোগানে বিশ্বাস নেই। আহারে মোনাফেকি! হাইব্রিড রাজনীতিবদেরা!!!

সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা দেশে নেই। গ্রামে, স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোথাও নাটক নেই, শিল্প নেই, গান নেই, সংস্কৃতিকর্মী নেই। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে কাজ চললে রক্তমাংসের শিল্পীকুশলিদের দরকার কী? এদের লাগে শহিদ মিনারের অনশনে, মুক্ত মঞ্চের প্রতিবাদে, শাহবাগের প্রতিরোধে। রাজার সিংহাসনে বলি হয় এইসব জগতের বিনোদনদাতা, সমাজ সংস্কারের হাতিয়াররূপী নিরীহ মানুষগুলো। এখন এদের কদর নেই। এরা এখন টিসিবির লাইনম্যান! লজ্জা লজ্জা!!!

একদিন হয়তো আমরা আড়ম্বরে স্বাধীনতার শতবর্ষও পালন করব। কিন্তু কেমন হবে সেদিনের বাংলাদেশ? উঠন্ত মুলা পত্তনেই বুঝা যায়। এ জাতির ভিতরটা ভেঙে নতুন করে গড়তে না পারলে আমাদের শতবর্ষের স্বাধীনতা বিবর্ণ রঙ ধারণ করবে- এ কথা বলার জন্য জ্যোতির্বিদ হতে হয় না।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *