আমার বাড়ি সীমান্তবর্তী এলাকায়। গারো পাহাড়ের পাদদেশ আমার পিতৃভূমি। গত কয়েকদিন আগে ভারতের দুজন রাজনীতিবিদ ইসলাম ধর্মের প্রাণপুরুষ, সারা জাহানের অদ্বিতীয় মহাপুরুষ, আমাদের প্রাণের নবি হযরত মুহম্মদ (স) কে নিয়ে কিছু বাজে মন্তব্য করেছেন। কী মন্তব্য তা আমি এখনো জানতে পারি নি। কিংবা জানতে চাইনি। সঙ্গত কারণেই আমার মতো অনেকেই হয়তো এখনো জানতে পারেননি আসলে কটুক্তিগুলো কেমন ছিল। এগুলো বারবার বললে প্রিয় নবিকে পুনরায় অপমান করা হবে বলে কেউ ওসব আর মুখে নিতে চাইছেন না।
এ বিষয়ে কিছু লিখব লিখব করেও লিখে উঠতে পারছিলাম না। আজ ভোরে অ-কারণ বন্যায় আমাদের সীমান্তবর্তী উপজেলা ঝিনাইগাতীর ৩০ টি গ্রাম যখন প্লাবিত হলো তখন ভারতকে আর ছাড় দেওয়া যায় না। তাই কিছু কথা বলতেই হচ্ছে।
জাতীয়তাবাদী চেতনা একেক দেশের একেক রকম। আপনি প্রায়ই দেখবেন আমেরিকার সি-বিচগুলোয় নারীরা তাদের অন্তর্বাস বানিয়েছে পতাকার রঙে ও ডিজাইনে। আমেরিকাও স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছে, আমরাও নয় মাস যুদ্ধ করে আমাদের পতাকাকে কিনেছি রক্তের দামে। তবু আমরা লাল-সবুজের ভালোবাসার পতাকাটিকে মাথায় ছাড়া শরীরের অন্য কোথাও ব্যবহার করার কথা চিন্তাও করতে পারিনা। তার মানে কী এই যে, আমেরিকানরা তাদের দেশকে ভালোবাসে না? অবশ্যই তারা দেশপ্রেমে প্রবলভাবে স্বার্থপর। তাদের প্রেসিডেন্টদের গায়ের রঙ আলাদা হলেও পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো বিভেদ নেই। আসলে সম্মান, শ্রদ্ধা অনেক সময়ই নিজস্ব সাংস্কৃতিক বলয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।
আমরা বাঙালি, আমরা মুসলমান। আমরা নবির দেশে না গেলেও কেউ যখন সেদেশে যায় তার কাছে কাতর স্বরে নিবেদন করি : “আমার সালামটা নবিকে পৌঁছে দিবেন। ভাই, আমার নামে দুটো বাতি নবির দরগায় দিয়ে দিবেন!” আমাদের টাকা না থাকলে আমরা আফসোস করি : “পাখি নয়তো উড়ে যাব ডানাতে ভর করি! মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায়। সালাম আমি জানাইব নবির রওজায়…!” ১৪০০ বছর আগে জন্ম নেওয়া এই মহাপুরুষের প্রতি আমাদের অতলস্পর্শী ভক্তি ও শ্রদ্ধা। অন্য কোনো ধর্ম প্রচারকের সাথে তাঁকে সমান্তরালে বিবেচনা করলে মারাত্মক ভুল হবে। অবিশ্বাসীরাই যাঁকে ‘আল-আমিন’ উপাধি দিয়েছিলেন তাঁর মর্যাদা লৌকিক কোনো বিষয় না। স্বয়ং আল্লাহ তাঁর মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন। সুতরাং তাঁকে জড়িয়ে কোনো রকম কুৎসা রটালে মুসলমানের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটা যারা বুঝেও এসব অপকর্ম করে তাদের উদ্দেশ্য রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করা। এসবই সম্প্রীতির বন্ধনে আগুন দেওয়ার মতো অপকর্ম। উপরন্তু, নিজের ধর্মে শ্রদ্ধা থাকলে অন্যের ধর্মকে অপমান করা যায় না।
বাংলা সাহিত্য পড়তে গিয়ে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’ পড়েছি। কাব্যের কৃষ্ণ আর অবতার কৃষ্ণ এক কিনা এ নিয়েও বাতচিত হতো। একজন বলেছেন : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কৃষ্ণ আছে কীর্তন নাই।’ এ কাব্যে কৃষ্ণের মহানুভবতার চেয়ে লাম্পট্যের কাহিনিই বেশি। কৃষ্ণকে নিয়ে গানও আছে অনেক। একটি গান এমন : “(রাধাকে বলা হচ্ছে) মা তুই জলে না যাইও, ও মা তুই জলে না যাইও… কদম গাছে বইস্যা আছে কানু (কৃষ্ণ) হারামজাদা!” সনাতন ধর্মে নানা মাত্রিকে দেবতাদের বয়ান এসেছে। কখনো তাঁরা লোকের ঘরে, কখনো বা লোকান্তরে। কখনো তাঁরা ইহলীলায় মত্ত, আবার কখনো জীবাত্মা-পরমাত্মার মিলনাকাঙ্ক্ষায় উন্মত্ত। হিন্দুধর্মে তাই মিথ বা পুরাণ আছে। কিন্তু ইসলাম ধর্মে আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সনাতন ধর্মের কেউ যদি তাঁদের লৌকিকতার দর্শন থেকে মনে করেন দেবতাকে ‘হারামজাদা’ বলা যায় সে বিষয়ে আমি বলতে পারব না। কিন্তু ইসলামে এমন লৌকিক-পারলৌকিক কোনো বিষয় নেই। এর পুরোটাই ঐশ্বরিক-সম্পৃক্তি। আল্লাহ, নবি, সাহাবিদের গালি দেওয়া তো দূরের কথা, চিন্তা করারওও সুযোগ নেই আমাদের।
১৯৯২ সালে যখন ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত বাবরি মসজিদে হামলা হলো তখন কেন্দ্রের ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস কিন্তু উত্তর প্রদেশে ছিল বিজেপি। এবার হযরত মুহম্মদ স. কে নিয়ে যারা কটুক্তি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে তারা দুজনই বিজেপির রাজনীতি করেন বলে জানলাম। ২ আর ২ -এ কত? আপনারা বলবেন- চার। কিন্তু সাংসদ শামীম ওসমানরা বলেন ২২! আর কিছু বলতে চাই না।
বর্তমান পৃথিবীতে অর্থনীতির দিক দিয়ে ভারতের অবস্থান পঞ্চম / তৃতীয়। দেশটিতে অসাম্প্রদায়িক যে শক্তিটি বিরাজ করে তাকে নস্যাৎ করার পায়তারা তাদের দেশের মানুষই করবে এটা সত্য। লোকে বলে : ‘পয়লা পু… মারে তালই!’ ভারত যদি শীঘ্র এসব আবর্জনা দূর না করে তবে তারা বিশ্ব-রাজনীতির খেলায় বিরাটভাবে হোঁচট খাবে। তবে গান্ধী-নেহেরুর এই রাষ্ট্রটি সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে জ্বলে পুড়বে না বলে বিশ্বাস করি।
বিজেপি মানেই ভারত নয়। পৃথিবীর বৃহত্তর গণতান্ত্রিক এ রাষ্ট্রটি দুজন রাজনীতিবিদ দিয়ে চলে না। দুজন পাগল-ছাগল দিয়ে এতোবড় একটি দেশের রাজনীতি হালে পানি পায় না। সুতরাং, নবি মুহম্মদ স. কে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছে যারা তারাই ভারতের রাজনীতি থেকে আস্তাঁকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। কারণ, মহান আল্লাহই তাঁর প্রিয় দোস্তের সম্মানের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল!
তায়েফে সত্য প্রচার করতে গিয়ে নবি স. রক্তাক্ত হয়েও তাদের ক্ষমার মহানুভবতা দেখিয়েছেন। আমরা মনে মনে কুলাঙ্গারদের ঘৃণা করে তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করি।
এ ঘটনায় বাংলার মুসলমানরা আঘাত পেয়েছে। ভারতের উচিত তাদের বক্তব্য ক্লিয়ার করা। আমাদের যৌক্তিক দাবিগুলো আমরা জানাব। কিন্তু ভারতকে বয়কট করার মতো সক্ষমতা কি আপনার আছে? আমাদের এক স্যার একদিন এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন : ইংরেজি পড় না কেন? ছাত্র উত্তর দিল : ইংরেজি ঘৃণা করি। স্যার বললেন : ইংরেজি ঘৃণা করবে ইংরেজি জানার পর।
আমাদের মাদ্রাসাগুলো থেকে কয়টা ডাক্তার বের হয়? ইঞ্জিনিয়ার? সাহিত্যিক? গবেষক? অর্থনীতিবিদ? অথবা একজন ভালো কৃষক????? এক সপ্তাহ পেঁয়াজ এলো না বলে ৩০০ টাকা কেজি পেঁয়াজ খেলেন। আর কথা নাই বার্তা নাই ভারত বয়কটের ডাক দিলেন? মধ্যপ্রাচ্যের সাথে তাল মিলান? তারাতো তেলের ওপর ভাসে। ভারত ছাড়া তাদের চলবে। আপনার চলে কি করে? আইপিলে জুয়া খেলেন! হিন্দি সিরিয়াল দেখেন! চিকিৎসার জন্য ভারত যান! ইদে কেনাকাটা করেন কলকাতায়! বাংলা সিনেমাও তো দেখেন না! হিন্দি ছাড়া? আবেগে দেশও চলে না, জীবনও চলে না! আগে নিজের সক্ষমতা নিশ্চিত করেন। ভারতকে বয়কট করা মানে তো দেওবন্দ বয়কট, কুতুবমিনার, তাজমহল বয়কট, ভারতের লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে বয়কট করবেন কীভাবে? বয়কট কথাটা যত সহজ আসলে বয়কট করা ততটাই কঠিন। সৌদি যে আজ লাফাইতেছে আমেরিকার বিপক্ষেতো আবার দেখি নাকে তেল দিয়া ঘুমায়! ও! ঐখানে তেলের ব্যবসা আছে, তাই না? সবাই রাজনীতি বুঝে, আপনি আর আমিই কেবল বুঝি না!
লেখাটা বড় হলো। শেষ করি। সকালে হঠাৎ শুনলাম বাড়িতে পানি উঠছে। এই অসময়ে পানি? কয় কী? পরে শুনি বন্যা! আকাশ থেকে পড়লাম! অনাবৃষ্টির বন্যা? খবরে দেখলাম ৩০ টি গ্রাম প্লাবিত! গত ১২ বছরে এমন পানি হয়নি। আমি টিভি দেখছি আর বিড়বিড় করছি : এমন সময়ে বন্যা? ঘটনা কী? মা ছিল পাশে। তিনি বললেন : তোরা ফালাফালি করতাছস আর ভারত ফারাক্কার বান দিছে খুইলা। এইবার চুবান খায়া মর!!!
আল্লাহ! দিলা তো তিনদিক দিয়াই দিলা!
দয়াল নবির শানে সালাম ও দুরুদ পেশ করে ইতি টানছি! শুভ রাত্রি