প্রথম পাতা » মতামত » বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন সংগ্রামে অসাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ

বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন সংগ্রামে অসাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ

Sheikh Mujibur Rahman

বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ এবং তাঁর আদর্শিক চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা এক এবং অভিন্ন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে, জিন্নাহর সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই তিনি অসাম্প্রদায়িক বাঙালির বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে, ভাষণ বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে হুঙ্কার তুলেছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিলেন। ক্ষমতার চেয়ে তার বাইরে গিয়ে বেশিরভাগ সময়ই তিনি ব্যয় করেছেন, ঔপনিবেশিকতা, অনিয়মতান্ত্রিকতা এবং সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে। প্রথমে তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা এবং পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম করেছেন এবং  এ ক্ষেত্রে তাঁকে জীবনের অধিকাংশ সময়ই তাঁকে জেলে কাটাতে হয়েছে। তাঁর এই সংগ্রামী জীবনের মৌল আদর্শ অসাম্প্রদায়িকতা, যা ভাষণ, বিবৃতি এবং সাম্প্রতিক প্রকাশিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থসমূহের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। আলোচ্য অংশে বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ কিভাবে হয়েছে তার উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হবে।

১.

বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পিছনের বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শিক ভিত্তি চালকের ভূমিকা পালন করেছে তা হলো অসাম্প্রদায়িকতা, অপর দিকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থাপতি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি শুরু হয়েছিল মুসলিম লীগের হাত ধরে, এমনকি সাম্প্রদায়িকতার ফল পাকিস্তান আন্দোলনেও তিনি ছিলেন। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তিনি কিভাবে অসাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে আর্বিভূত হলেন এবং বাংলার আপামর জনগোষ্ঠী আবার তা গ্রহণ করলেন। প্রথমত তাঁর প্রাথমিক সামাজিকীকরন হয়েছিল মুসলিম পরিবারে, স্বাভাবিকভাবেই এটা ধরে নেয়া হয় প্রাথমিক সামাজিকীকরনের প্রচ্ছন্ন ছাপ পরবর্তী জীবনে লেপ্টে থাকে, যদি না কোন ব্যক্তির মধ্যে বড় ধরনের কোন পরিবর্তন আসে। তাছাড়া সামাজিকীকরন একটি সমগ্র জীবন ব্যাপী প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পারিপার্শ্বিকতার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান এবং এর সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায়, তাঁর জন্ম এমন পরিবারে যার সাথে বহুদিন পূর্ব থেকেই ইসলামিক ভাবধারা এবং সংস্কৃতির মিল বন্ধন ছিল, যা তাঁর আত্মজীবনীতেও উল্লেখ রয়েছে,

“টুঙ্গিপাড়ার শেখ বংশের নাম কিছুটা এতদঞ্চলে পরিচিত। শেখ পরিবারকে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার বলা যেতে পারে। বাড়ির বৃদ্ধ ও দেশের গণ্যমান্য প্রবীন লোকদের কাছ থেকে এই বংশের কিছু কিছু ঘটনা জানা যায়। আমার জন্ম হয় এই টুঙ্গিপাড়ার শেখ বংশে। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গোড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে। … ইংরেজরা মুসলমানদের ভালো চোখে দেখত না। প্রথম ঘটনা, রাণী রাসমণি হঠাৎ জমিদার হয়ে শেখদের সাথে লড়তে করতে শুরু করলেন, ইংরেজও তাকে সাহায্য করল। কলকাতার একটা সম্পত্তি ও উল্টোডাঙ্গার আড়ত শেখের সম্পত্তি ছিল। এই সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন শেখ অছিমুদ্দিন। …একবার দুই পক্ষে খুব মারামারি হয়। এতে রাসমণির লোক পরাজিত হয়। শেখদের লোকেদের হাতে তমিজুদ্দন আহত অবস্থায় ধরা পড়ে এবং শোনা যায় যে, পরে মৃত্যুবরণ করে। মামলা শুরু হয় শেখদের সকলেই গ্রেফতার হয়ে যায়। পরে বহু অর্থ খরচ করে হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পায়”(রহমান, ২০১৫, পৃ. ২-৫)।

এমন বংশীয় উপসংস্কৃতি(Sub-Culture) তাঁর সামাজিকীকরনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে বলে ধরে নেয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত। তাঁর মধ্যে এর মাধ্যমেই ব্রিটিশ এবং জমিদারি প্রথা বিরোধী মনোভাবের জন্ম নেয়াটা স্বাভাবিক। এখানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, “আমাদের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক ঘেঁষে একটা সরু খাল চলে গেছে, যে খাল মধুমতী ও বাইগার নদীর সংযোগ রক্ষা করে এই খালের পাড়েই ছিল বড় কাচারি ঘর। আর এই কাচারি ঘরের পাশে মাস্টার পন্ডিত ও মৌলভি সাহেবদের থাকার ঘর ছিল। এরা গৃহ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত এবং তাদের কাছে আমার আব্বা আরবি, বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক শিখতেন” (হাসিনা, ২০১৯, পৃ. ২৬)|

Mujib 7th March

বঙ্গবন্ধু একদিকে যেমন মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন, পাশাপাশি তিনি পারিবারিকভাবে আরবি শিক্ষা ও শিক্ষকদের সান্নিদ্ধ্যে এসেছিলেন। যার ফলে মনোজগতে প্রথমে ব্রিটিশ বিরোধী, জমিদারী প্রথা বিরোধী মনোভাব বিকশিত হয়, পাশাপাশি দরিদ্র মুসলিম জনোগোষ্ঠীর দুর্দশা তাঁকে ব্যথিত করতো, যার ফলে তিনি হয়তো চাইতেন যে, জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে অভাবগ্রস্থ মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভাব হতে পারে মুসলিম লীগের হাত ধরেই। তাছাড়া কৈশরের সমাপ্তি লগ্নে রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে। তাই প্রাথমিকভাবে তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু এর পাশপাশি তাঁর মধ্যে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারণা জন্ম নিচ্ছিল এবং তাঁর মধ্যে কখনোই সাম্প্রদায়িকতা লালনের নজির পাওয়া যায়নি। অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন,

“১৯৩৮ সালের ঘটনা। শেরে বাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তাঁরা গোপালগঞ্জে আসবেন। বিরাট সভার আয়োজন করা হয়েছে…আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে। পরে দেখা গেল, হিন্দু ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়তে লাগল। এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেও ছাত্র, সে আমাকে বলল, কংগ্রেস থেকে নিষেধ করেছে আমাদের যোগদান করতে। যাতে বিরূপ সম্বর্ধনা হয় তার ও চেষ্টা করা হবে…আমি এখবর শুনে আশ্চর্য  হলাম। কারণ আমার কাছে তখন হিন্দু মুসলমান বলে কোন জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। এক সাথে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ান-সবই চলত”(রহমান, ২০১৫, পৃ, ১০-১১)।

আলোচ্য ঘটনার বর্ণনার মাধ্যমে তাঁর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মনোভাবই প্রকাশ পায় বা এ কথা বলা আরও যৌক্তিক হবে যে তাঁর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার জন্মই হয়নি। আবার তিনি বলেছেন যখন তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বক্তৃতা শোনেন তখন, তিনি চঞ্চল হয়ে ওঠেন। যা মুসলিম লীগের আদর্শের সাথে তাঁর দ্বান্ধিকতাই প্রকাশ পায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিত রচিত হয়েছিল দেশ বিভাগের বহুকাল পূর্বেই। নৃতত্ত্ব, ভাষা বা ইতিহাস সকল দিক থেকেই এই ভূখন্ডের অধিবাসীরা বাঙালি এবং তাদের ভাষা বাংলা যা সরল সত্য এবং বাস্তব ব্যাপার কিন্তু হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নে এই সরল সত্যটি খুব কুন্ঠার সাথেই প্রকাশ পেয়েছে। এখানে ধর্মের প্রশ্নে  দ্বিধাবিভক্ত হয়ে এক বাঙালিই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে; হিন্দু বাঙালি এবং মুসলমান বাঙালি অথচ সবার ইতিহাস এক এবং অভিন্ন। এক সময় এই বিভক্ত অচথ উভয়ই এক নিজেদের কলহের কারণে এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীকে প্রশ্ন করেছিল, “আপনি কি বাঙালি না মুসলমান?” এক্ষেত্রে হিন্দুরা যেমন দায়ী ততোধিক মুসলমানরাও দায়ী। এই সুযোগ জিন্নাহরা অত্যন্ত আকুন্ঠভাবে গ্রহণ করেছিল এবং সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন ঘটে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই, “এ যুগে অবাঙালি অধ্যুষিত পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সহ-অবস্থান করতে গিয়ে বাঙালি মুসলমানকে ভাবতে হচ্ছে যে, সে বাঙালি। স্বাধীনতা পূর্বকালের তুলনায় এ চেতনার প্রকৃতি পৃথক: তখন হিন্দুদের সাথে সহ-অবস্থান করতে গিয়ে তাকে ভাবতে হতো সে মুসলমান; স্বাধীনতার যুগে অবাঙালি পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহ-অবস্থান করতে গিয়ে স্বার্থ-সংঘাতের তাড়নায় তাকে ভাবতে হচ্ছে সে বাঙালি। এ ভাবনার জলন্ত উদাহরণ হচ্ছে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন”(হক, ২০১৭, পৃ. ১৭-১৮)। বঙ্গবন্ধু এই অনুভূতিকে সহজেই অনুধাবন করেছিলেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিলেন। প্রথমে তিনি পাকিস্তান আন্দোলন করলেও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মূলত বাংলা। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে অন্নদাসঙ্কর রায় প্রশ্ন করেছিলেন,

“‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এল।’ ‘শুনবেন?’ তিনি [মুজিব] মুচকি হেসে বললেন, সেই ১৯৪৭ সালে। আমি সুহরাবর্দী [সোহরাওয়ার্দী] সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির একদেশ। বাঙালিরা এক হলে কী না করতে পারত। সারা জগৎ জয় করতে পারত। They could conquer the world. বলতে বলতে তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। তারপর বিমর্ষ হয়ে বললেন, ‘দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সুহরাবর্দী ও শরৎ বোস। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি নয় তাদের প্রস্তাবে। তারা হাল ছেড়ে দেন। আমিও দেখি যে আর কোনো উপায় নেই। ঢাকায় চলে এসে নতুন করে আরম্ভ করি। তখনকার মতো পাকিস্তান  মেনে নিই। কিন্তু আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা। সে স্বপ্ন কেমন করে পূর্ণ হবে এ আমার চিন্তা। হবার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। লোকগুলো যা কমিউনাল। বাংলাদেশ চাই বললে সন্দেহ করত। হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে। ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন একদিন আসে যেদিন আমার দলের লোকদের জিজ্ঞাসা করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে, পাক বাংলা, কেউ বলে পূর্ব বাংলা। আমি বলি, না বাংলাদেশ। তারপর আমি স্রোগান দিই জয় বাংলা। তখন ওরা বিদ্রূপ করে বলে, জয় বাংলা না জয় মা কালী! কী অপমান! সে অপমান আমি সেদিন হজম করি। আসলে ওরা আমাকে বুঝতে পারেনি। জয় বাংলা বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলুম বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয় যা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে’”(মামুন, ২০২০)।

এখানের প্রতিটি বাক্য সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী, তিনি পাকিস্তান মেনে নিয়েছিলেন তাও বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করা জন্য। অন্যদিকে মুসলিম লীগে তিনি যাদের অনুসরণ করতেন বা যার হাত ধরে তাঁর মুসলিম লীগে প্রবেশ সোহরাওয়ার্দীসহ অন্যান্য নেতারা উদারপন্থী অংশের। এখানে উল্লেখ্য ভাষার প্রশ্নে অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতারাই পাকিস্তানিদের মত মনোভাব পোষণ করতেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুই অন্যতম রাজনীতিক যিনি সদ্য কলকাতা ফেরত হলেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার লক্ষ্যে ধর্মঘটে অংশ নিয়েছিল। এমন কি তাঁর ঘনিষ্ঠ এবং আদর্শিক নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও ঊর্দুর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন: “যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তদানুসারে ঊর্দ্দুই হইবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু তাঁকে কিছুকাল পর বিভ্রান্তি থেকে বের করে আনার চেষ্টা করেছিলেন এবং পরে সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটান(রফিক, ২০১২, পৃ. ৬৬-৬৭)। অপরদিকে মুসলিম লীগে কট্টোরপন্থী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারকদের সাথে তিনি ছিলেন না। এমনকি ১৯৪৬ সালে কোলকাতাসহ বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নিয়েছেন। ১৯৪৮ সালের ঢাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বঝায় রাখতে তিনি অকৃত্রিমভাবে কাজ করেছেন সোহরাওয়ার্দীর সাথে। ১৯৪৯ সালে তিনি মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন, যাকে তিনি পরবর্তীতে শুধু আওয়ামী লীগে রূপ দিয়েছিলেন। সুতরাং বলা যায়, তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি মুসলিম লীগের মাধ্যমে হলেও তিনি প্রথম থেকেই অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, যদিও তা মুসলিম লীগের আদর্শের বিরোধী এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সম্পুর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক আদর্শের ধারক হিসেবে আর্বিভূত হয়।

২.

পাকিস্তান সৃষ্টির পর বঙ্গবন্ধু সর্বতোভাবে অসাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে আর্বিভূত হয়, যেখানে তাঁর আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে জাতি, ধর্ম এবং বর্ণ নয় বরং বাঙালিই প্রধান হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সাল থেকে আমৃত্যু এই দর্শনকে ধারন করেছেন এবং বাঙালিকে এর ছায়াতলে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন। আলোচ্য অংশে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহি:প্রকাশের উপর দৃষ্টিপাত করা হবে, যেখানে মূলত তাঁর প্রদত্ত ভাষণ এবং বিবৃতির উপর গুরুত্বরোপ করা হবে।

১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে ইতিপূর্বে গঠিত আইনসভাই পাকিস্তানের গণপরিষদের মর্যাদা লাভ করে। সে হিসেবে এ গণপরিষদের উপরই শাসনতন্ত্র রচনার ভার অর্পিত হলেও, পরিষদ তা করতে সম্পূর্ণরূপে অক্ষম ছিল। ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও নানা অযুহাতে শাসকগোষ্ঠী তা বিলম্বিত করে, ফলে ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন অনুযায়ী প্রাদেশিক আইনসভা চলছিল। এখানে উল্লেখ্য নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ের আশঙ্কা থেকেই নির্বাচনে শাসক গোষ্ঠী বিলম্ব করছিল। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা তখন পর্যন্ত কার্যকর ছিল। মোট ৩০৯ টি আসনের মধ্যে ২২৭ টি আসন (৯ টি মহিলা আসনসহ) মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য এবং ৭২ টি আসন অমুসলিম (৬ টি মহিলা আসনসহ) সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত ছিল(রশিদ, ২০০১, পৃ. ১৮৫-১৮৬)।  এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়, যেখানে তাদের নির্দিষ্ট কোন কর্মসূচি ছিল না বরং তারা যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে “ইসলাম বিপন্ন,” “পাকিস্তান বিপন্ন,”   “কমিউনিষ্ট,” “ভারতীয় চর” প্রভৃতি অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল, অন্যদিকে যুক্তফ্রন্ট অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক “বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদান” সহ ২১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে অভূতপূর্ব জয় পায়। এ নির্বাচনের ভিত্তিতেই গণপরিষদ নতুনভাবে গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন এ নবগঠিত গণপরিষদের অন্যতম সদস্য। পাকিস্তানের জন্য একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু এই গণপরিষদ ও ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ভিত্তিতে আইনসভার সদস্য হিসেবে যে বক্তব্য পেশ করেছিল, তা মূলত তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনারই বহি:প্রকাশ। প্রত্যেকটি বক্তৃতায় তিনি ইসলামিক ভাবধারা ব্যবহার করে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য শাসক দলের সদস্যদের অভিযুক্ত করেন। তিনি দৃঢ়চিত্তে ইসলাম ধর্মকে অপব্যবহার করার কথা ঘোষণা করেন ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের সভায়। উক্ত সভায় আনীত গভর্ণরদের বেতন সম্পর্কিত সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাবে কথা বলতে গিয়ে ধর্ম ব্যবহারের বিষয়টি তুলে ধরেন। উক্ত বক্তৃতায় তিনি তির্যকভাবে গভর্ণরদের ৬,০০০ রূপী বেতনের সাথে ইসলামিক নীতির তুলনা করে একে জনগণের সাথে প্রতারণা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এছাড়া তিনি সমাজতান্ত্রিক চীনের অবিসংবাদিত নেতা মাও সে তুং এর বেতনের সাথে এর তুলনা করেন, তাঁর বক্তব্যানুসারে পাকিস্তান ইসলামের দোহাই দিয়ে গভর্ণদের বেতন নির্ধারণ করে শুধু ধর্মের অপব্যবহারই করছে, যা একদিক থেকে ইসলামের নীতির সাথে সাংঘর্ষিক অন্যদিকে জনগণের অর্থের অপব্যবহারও বটে। তিনি পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে ধোঁকা দেয়ার বিষয়টিও উপস্থাপন করেন। তাঁর মতে,

”Why give bluff to the people of East Bengal? They(Member of United Front) have to go back to east Bengal and face the people to whom they have made this declearation. I can tell my friends that in long run truth will shine and they will be out. For a few days you can bluff the East Bengal, but not for long.” (উদ্ধৃত খান, ২০১৮, পৃ. ১৪)

তাঁর বক্তাব্য অনুসারে, জনগণকে ধোঁকা দিয়ে কিছুদিন টিকলেও পরিণামে সত্যটাই বেরিয়ে আসবে। পূর্ব বঙ্গে ফিরে গিয়ে আইন সভার সদস্যগণ তাঁদের ঘর বাড়ি থেকেও বের হতে পারবে না, কারণ তারা যা করছে তা ধোঁকাবাজি ছাড়া কিছুই নয়। তিনি এর সাথে সাথে গভর্ণদের বেতন সম্পর্কে বলতে গিয়ে পুনরায় বলেন,

”This is the position in an Islamic country. Our Ambassadors get Rs. 9,000 a month. Sir, This is the salary of our Ambassador at Washington and in that rich country of America, President Eisenhower get less than that. Sir, you cannot understand the position. I will ask my friends not to Islam any more. You have no right to talk of Islam when you are going to pay Rs. 6,000 to your Governors” (উদ্ধৃত খান, ২০১৮, পৃ. ১৬).

বঙ্গবন্ধু সহসাই নাগরিকের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন এবং ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের পক্ষে পাকিস্তান আইন সভায়ও তিনি কথা বলেছেন। ১৯৫৬ সালের ২১ জানুয়ারি খসড়া সংবিধানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন, যার মধ্যে সকল নাগরিকের সমান অধিকার, বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতিসহ নির্বতন মূলক আইনেরও তিনি বিরোধিতা করেন। এই দিনের বক্তব্যের মূল বৈশিষ্ট্যই ছিল ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নাগরিকের সমান অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, যা খসড়া সংবিধানে ছিল না। তিনি বক্তব্যের শুরুতেই ইসলামিক প্রজাতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং সংখ্যালঘু যারা মুসলমান নয় তাদের এই সংবিধানে অবস্থান কি হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন;

”Sir, this draft constitution is the embodiment of down-right treachery and sheer bluff. It begins with the name of ‘constitution for Islamic Republic of Pakistan.’ Sir, we want to make an Islamic Republic of Pakistan. The name is already here. May I ask a question my Nizam-i-Islam friends, particularly and from the members of the United Front, whether a non-Muslim can preside over the constituent assembly to frame an Islamic constitution or not?… It is, I think and I feel, that my country has given a non-Muslim the responsibility for a little while over this sovereign body and to frame a constitution for an over seven crores of the people of Pakistan, but we have started in the name of Allah, but, Sir, when we are going to make an Islamic constitution I ask whether a non-Muslim who does not believe in La ilaha Illal-Lah Muhammadur Rasulullah, who does not believe in the last Prophet of Allah, can preside over such a constitution-making body as ours?” (উদ্ধৃত খান, ২০১৮, পৃ. ২৮).

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের মৌল চেতনা অসাম্প্রদায়িকতা, তাছাড়া ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ২১ দফার দিকে দৃষ্টিপাত করলে সহজেই অনুমেয় যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধচারণই ছিল নির্বাচনী ইসতেহারের মূলমন্ত্র। একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাই, তিনি কখনোই সংখ্যালঘু অমুসলিমদের অধিকারকে খর্ব করার পক্ষপাতি ছিলেন না, বরং তাদের অধিকার এবং সাংবিধানিকভাবে যদি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হয় তাহলে এই সংখ্যালঘু যারা ইসলামিক আদর্শে বিশ্বাসী নয় তাদের অবস্থান এবং অধিকার খর্ব হওয়ার সন্ধিহান থেকেইে তিনি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র নিয়ে কথা বলেন। দৃঢ়তার সাথে তিনি আবার ঘোষণা করেন,

”I think it is an insult to speak in this fashion, we all are Pakistanis. Call everybody, every citizen, a Pakistani, irrespective of whether he is a Muslim, Hindu, Sikh, Christian or a Buddhist. Pakistan is not for Pakistani. Pakistan has not been formed for the Muslims alone. My friend says: ‘We want to make a constitution for all the Muslims of the world.’ All right, then, why are you not making constitution for the 50 crores of Muslims of entire world? You have the monopoly because, we the Pakistanis are Muslims, but there are Muslims in India, Muslims in Indonesia, we have Muslims in Iraq, in Egypt and in Turkey and other places… they want to bluff the people of Pakistan in the name of Islam. They have exploited the masses of Pakistan for the last seven or eight years in the name of Islam, in the name of Rasulullah” (উদ্ধৃত খান, ২০১৮, পৃ. ২৯).

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনায় ছিল বাংলার আপামর জনগণ কোন বিশেষ গোষ্ঠী নয়, এ কারণেই তিনি পাকিস্তানের সকল নাগরিককে পাকিস্তানি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সম্মত ছিলেন না। যেহেতু পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে এবং তা কোন নির্দিষ্ট স্থানের ভিত্তিতে বা জাতির ভিত্তিতে হয়নি, যা সময়ের বিবর্তে তাঁর কাছে এক ধরনের রাজনৈতিক ধোঁকা হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে, তাই তিনি কোনক্রমেই সকল নাগরিককে পাকিস্তানি হিসেবে সাংবিধানিকভাবে অভিহিত করতে অসম্মত ছিল। তাছাড়া তিনি মনে করতেন, পাকিস্তানি হিসেবে স্বীকৃতি সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য যেমন মুসলিম, হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান বা বুদ্ধ সকলের জন্যই অবমাননাকর। অন্যদিকে, সকল মুসলমানদের জন্য একটি সংবিধান রচনার কথা উঠলে তিনি তার যৌক্তিক সমালোচনা করেন। সার্বিকভাবে যেহেতু ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে রচিত হচ্ছে না এবং সকলের প্রতিনিধিত্ব না থাকার কারণে তিনি এই সংবিধানকে জনগণের সাথে ধোঁকাবাজি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আবার সাংবিধানিকভাবে যখন যৌথ ভোটাধিকারের ব্যাবস্থা বাতিল করা হয় তখন তিনি তার বিরুদ্ধচারণ করে বলেন:

”In East Bengal Hindus and Muslims had jointly voted and Moulana Shihab was eleceted to this House. But they say that the system of joint electorate is non-Islamic. They have raised the question of jaiz and na-jaiz on this issue. Sir, this question of jaiz and na-jaiz is very dangerous because for the last eight years of the existence of Pakistan we have been voting in every election of Municipaity. District or Union Board, etc. Here also in the election of Municipal corporation of Karachi, the people voted jointly but nobody obected then or no Moulana raised the question of its charaterbeing un-Islamic. What has happened to the recent election to the interim West Pakistan Legislature? Why did they not raise a voice this election was non-Islamic? Sir, Mr. Khuhro was returned and saved because of the votes of Hindus. It is because of system of joint electorate that he got himself returned” (উদ্ধৃত খান, ২০১৮, পৃ. ৩৬).

Sheikh Fazilatunnesa Mujib

সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু সর্বতো সতর্ক এবং সজাগ ছিলেন, শুধু তাই নয় বরং যৌথ ভোট ব্যবস্থা যখন বাতিল নিয়ে ফতুয়া জারি করে এবং একে ইসলাম বর্হিভূত হিসেবে অভিহিত করার পাশাপাশি যৌথ ভোটাধিকার ব্যবস্থা যদি বলবৎ করা হয় তাহলে মুলসমানরা কাফির হয়ে যাবে। এমন প্রশ্নের উদ্রেগ হলে, বঙ্গবন্ধু গণপরিষদে এর বিরুদ্ধে কথা বলেন। তাঁর মতে, পূর্ব বাংলার মানুষ ইউনিয়ন থেকে শুরু করে মিউনিসিপালিটি নির্বাচনে যৌথভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে, এমনকি করাচিতেও যৌথ নির্বাচন ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে, আর যৌথ নির্বাচনে যদি মুসলমানরা কাফের হয়ে যায়, তাহলে ইতিমধ্যে পাকিস্তানের সবাই কাফের হয়েছে, কারণ পূর্ব থেকেই তারা যৌথভাবে নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করছে। বঙ্গবন্ধুর এমন উক্তির মূল কারণ মূলত: সার্বজনীন ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, যাতে সংখ্যালঘু শ্রেনি কোনভাবে নির্যাতিত বা অধিকার ক্ষুন্ন না হয়। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানে সাংবিধানিকভাবে সাম্য প্রতিষ্ঠা। আবার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে ধর্ম বা আদর্শ নির্বিশেষে সকল রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক রাখার পক্ষপাতি ছিলেন কিন্তু পাকিস্তান সংবিধানে যখন তা প্রাধান্য পাচ্ছিল না, তখন তিনি এর বিরোধিতা করেন এবং তা সংশোধনের জন্য ৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৬ সালের গণপরিষদের অধিবেসনে উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে তাঁর মত ব্যক্ত করেন;

”Sir, I support the ammendment and draw your attention to the fact that sometimes in internatioanl matters a country can make friendship with any other country of the world. Sir, if we catagorically say that we are Muslim state, then definitely we must make relations with other Muslim countries more cordial. Sir, might be if there is a war between Afghanistan and Pakistan or other non-Muslim countries might help us. I do not think that anywhere in any constitution of the world, it is written that the state shall eneavour to promote friendly relations with particular countries; no doubt we will do it, but why write in the constitution. For example, in the U. N. O. in Kashmir issue, there are so many non Muslim countries that are friendly to us, we have to play politics. There is the Muslim country of Indonesis which is friendly to India. Saudi Arabia is a kingdom: it is not a democratic country; no doubt we should be friendly with Saudi Arabia. There is Egypt and Iran. Naturally we should be on friendly terms with them; we should promote friendly relations with them all, but why write in the constitution. Today we may not be on good terms with India, but tomorrow we can be friendly with her. We can get more help from India than from any other country… This is politics, you have to play it” (উদ্ধৃত খান, ২০১৮, পৃ. ৪৫-৪৬).

একটি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার সাংবিধানিক নীতি অনেকাংশে প্রভাবিত করে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এই বিষয়টি মাথায় রেখেই ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ কে পররাষ্ট্র নীতির মৌল কাঠামো নির্ধারণ করেছিলেন। বস্তুত বঙ্গবন্ধু কোন রাষ্ট্রের ধর্মীয় আবরণকে বিবেচনায় না নিয়ে বরং জাতীয় স্বার্থকে বরাবরই প্রাধান্য দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রনয়নেও তিনি এই মতবাদকে প্রাধান্য দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন, কিন্তু তৎকালীন শাসকরা মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সাথে সুসম্পর্ক বঝায় রাখার বিষয়টিকে সাংবিধানিক ভিত্তি দিতে চাইলে, তিনি তা সংশোধনের প্রস্তাব করেন। তাঁর মতানুসারে একটি রাষ্ট্রের ধর্ম দ্বারা তার সাথে সম্পর্ক কিরূপ হবে তা নির্ধারিত হতে পারে না এবং বিশ্বের কোন দেশ এমন নীতি গ্রহণ করে না বলেই তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক্ষেত্রে তিনি দাবি করেন, এমন সময় আসতে পারে যখন আফগানিস্তানকে পাকিস্তানের আক্রমন করতে হবে, কারণ তারা পাকিস্তানের ভূমিকে নিজের বলে দখল করতে চায়, তখন শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হবে। তাই তিনি রাষ্ট্রের ধর্মীয় অবয়ব নির্বিশেষে সকল রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক রাখার পক্ষপাতি, এমনকি তিনি দাবি করেন যে, যদিও ভারতের সাথে পাকিস্তানে সুসম্পর্ক নেই কিন্তু সময়ে বিবর্তনে এর পরিবর্তন হতে পারে। তাছাড়া কাশ্মীর ইস্যুকে নির্দেশ করেন যে, জাতিসংঘ কাশ্মীরকে সমর্থন করছে, যেখানে অধিকাংশ রাষ্ট্রই মুসলিম নয়, কিন্তু শুধু মুসলমান রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক রাখার বিষয়টি যদি সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়, তাহলে ভবিষ্যতে জাতীয় স্বার্থ বিনষ্ট হতে পারে। সার্বিক বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তানি শাসকদের ধর্মের ব্যবহারকে সম্পূর্নরূপে প্রত্যাক্ষাণ করেন, যা কালের পরিক্রমায় তাঁকে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে।

অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেমন আন্দোলন করেছেন এবং আমরণ অনশন করেছেন, তেমনি তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ভাষা করার জন্য গণপরিষদে জোড় দাবি করেন। এখানে উল্লেখ্য, বাংলা ধর্ম, বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সকলের ভাষা যার কোন ধর্মীয় রূপ নেই, কারণ এই বাংলায় যেমন একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী কথা বলে তেমনি খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এমন কি একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বিরাও কথা বলে, যে কারণেই ভাষা আন্দোলন অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃত। এই আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু একজন অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন এবং গণপরিষদে তিনি পাকিস্তানিদের কু-মতলবের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলেন। ১৯৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়রি আইন পরিষদের অধিবেশনে খসড়া সংবিধানের অর্ন্তগত ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে তাঁর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন যে, পূর্ববঙ্গে সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। খসড়া সংবিধানে রাষ্ট্রীয় ভাষা বলতে যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল তার বিপক্ষে তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেন:

”I would like to draw your attention to the cluse of the draft constitution itself. It says: ‘It should be the duty of the Federal and Provincial governments to take all possible measures for the development and growth of a National Language.’ At another place they have again said that: ‘The official languages of the Islamic Republic of Pakistan shall be Urdu and Bengali.’ But you will notice. Sir, that in the present clause under consideration they say that all possible measures for the development and growth of a National Language will be taken by Federal and Provincial governments. I would specially like to draw your attention to the words ‘a National Language’ and, Sir, this seems to be very dangerous. Sir, the other day the foreign minister went to Dacca and he declared in a press conference that the official language means state language…We in Bengal, by official language do not mean state languages…We must take all necessary steps immediately for the development and growth of these two(Bengali and Urdu) state languages” (উদ্ধৃত খান, ২০১৮, পৃ. ৪৮-৪৯).

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করা নিয়ে পাকিস্তানিদের যে কু-মতলব ছিল, সে সম্পর্কে তিনি সর্তক সজাগ দৃষ্টি দিয়ে এর বিপক্ষে আইন সভায় খসড়া সংবিধানের সংশোধনের কথা বলেন। পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে, একথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে ধোঁকাবাজি বন্ধ করার কথা বলেন এবং ঘোষণা করেন, পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে, বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক যার মাধ্যমে তিনি আবার অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দেন কারণ বাংলা কোন নির্দিষ্ট ধর্ম বা বর্ণের নয় বরং সকলের ভাষা।

সার্বিক বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত অসাম্প্রদায়িকতার চেতনাকে পাকিস্তান আইনসভায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। যেখানে তিনি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতা থেকে শুরু করে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার, যৌথ ভোটাধিকার ব্যবস্থা প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণে ধর্মের প্রাধান্য কে অস্বীকার এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতির প্রদানের উপর গুরুত্বারোপের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে পুনরায় তাঁর আত্ম পরিচয় জাতির সম্মুখে তুলে ধরেন।

৩.

রাজনীতির গতিময়তার ধারায় রাজনীতিবিদরা আপন স্থান দখল করে নেয় তাদের কর্ম এবং মতাদর্শের দ্বারা এবং এর বহি:প্রকাশ ঘটে অধিকাংশ সময়ই তাদের অনুসৃত ভাষণ এবং বিবৃতির মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুও এর বিপরীত নয়, কারণ তাঁর আদর্শিক ভিত্তি তথা মতাদর্শ প্রকাশ পেয়েছে অধিকাংশ সময়ই তাঁর প্রদত্ত ভাষণ এবং বিবৃতির মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর মুসলমান পরিবার এবং সমাজে প্রাথমিক সামাজিকীকরন হওয়ার কারণে এবং সোহরাওয়ার্দীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলিম লীগের সাথে সম্পৃক্ত হলেও তিনি কখনোই সাম্প্রদায়িকতাকে ধারন বা লালন করেননি বরং ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তার বিরুদ্ধচারণসহ সম্প্রীতি রক্ষার নিমিত্তে তিনি কাজ কাজ করেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন, এমনকি সোহরাওয়ার্দীকেও বাংলা ভাষা বিরোধী অবস্থান থেকে বাংলার পক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার বাহক মুসলিম লীগ থেকে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সাথে সম্পৃক্ত হয় এবং পরবর্তিতে তাঁর উদ্যোগেই মুসলিম শব্দটি বাতিল করে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে জন্য একে উন্মুক্ত করার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহি:প্রকাশ ঘটান। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন এবং পাকিস্তান আইন সভায় গণপরিষদের সদস্য হিসেবে পাকিস্তানি শাসকদের রাজনীতিতে ধর্মের দোহাই এবং বাঙালিদের সাথে ধোঁকাবাজির বিরুদ্ধচারণ করেন এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য শাসনতন্ত্র প্রনয়নের জোর দাবি জানান, যেখানে তিনি রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ইসলামিক ভিত্তি প্রদানের বিরোধী; জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান অধিকার; বৈদেশিক নীতিতে শুধু মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক নয়, বরং সকল রাষ্ট্রের সাথে সম্প্রীতির সম্পর্ক রাখার পক্ষে কথা বলেন; ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মীয় বিভাজনকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং যৌথ ভোটাধিকার ব্যবস্থা প্রনয়নের পক্ষে কথা বলেন এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জোর দাবি জানান। আবার ১৯৫৩ সালে কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা, ১৯৫৪ সালে আদমজী পাট কলে বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে দাঙ্গার বিরোধিতা করে সকলের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষার জন্য কাজ করেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা থেকে শুরু করে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ৭০ এর নির্বাচনে, এমনকি ১৯৭১ সালের প্রাককালে প্রদত্ত সকল ভাষণ এবং বিবৃতিতে তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বাক্ষর রেখেছেন, এক্ষেত্রে ৭ মার্চের ভাষণ এক অনন্য দলিল। সার্বিক বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু এমন একজন আদর্শিক নেতা যিনি তাঁর আজন্ম লালিত অসাম্প্রদায়িক চেতনার দ্বারা সকল বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে হাজার বছরের নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ করে দিয়ে বিশ্ব দরবারে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, যা আজ সকলের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস।

তথ্যসূত্র:

খান, মহিউদ্দিন আহমেদ (সম্পা) (২০১৮) বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ১০০ ভাষণ, প্রথম স:, ঢাকা: মুক্তদেশ।

মামুন, মুনতাসির (২০২০) “অহিংস অসহযোগ আন্দোলন মহাত্মা ও বঙ্গবন্ধু,” যুগান্তর, ১৭ মার্চ ২০২০                     Available at:https://www.jugantor.com/todays-paper/b100/289997 অহিংস-অসহযোগ-আন্দোলন-মহাত্মা-ও-বঙ্গবন্ধু (Accessed: 9 December 2021)

রশিদ, হারুন-অর (২০১৮)বাংলাদেশ রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন (১৭৫৭-২০১৮), ঢাকা: অন্যপ্রকাশ।

রফিক, আহমদ (২০১২) ভাষা আন্দোলন ও নেতাকর্মীদের ভূমিকা, প্রথম, ঢাকা: গণপ্রকাশনী।

রহমান, শেখ মুজিবুর (২০১৫) অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পঞ্চম স:, ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।

হক, আবদুল (২০১৭) বাঙালী জাতীয়তাবাদ এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমি স:, ঢাকা: বাংলা একাডেমি।

হাসিনা, শেখ (২০১৯) শেখ মুজিব আমার পিতা, নবম স:, ঢাকা: আগামী প্রকাশনী।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Avatar photo
মোঃ আল-আমিন
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *