প্রথম পাতা » মতামত » বাংলা সাহিত্যে ‘মাওলানা’ চরিত্রের স্বরূপ

বাংলা সাহিত্যে ‘মাওলানা’ চরিত্রের স্বরূপ

bigoted

“এইসব লুতুপুতু সাহিত্য পাবলিক আর খায় না। যৌনাচার, ব্যাভিচার, নারীর বক্ষ, উন্মুক্ত নিতম্বের গাজাখুরি গল্প এদেশে আর চলবে না। এদেশে ইসলাম জিন্দা আছে, থাকবে। বইমেলা পুরোটা দখল করে নিতে হবে। এদেশের সাহিত্যে সেক্যুলারের নামে ইসলাম ধর্মকে অসম্মান করা হয়েছে। দাড়ি-টুপিকে বেইজ্জত করা হয়েছে। সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। মূলধারা নামে খ্যাত এইসব নষ্ট-ভ্রষ্ট বস্তাপঁচা সাহিত্য বাজার থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। ইনশাল্লাহ, আমাদের বিজয় শুরু হয়েছে। এদেশে কালেমার পতাকা উড়বেই।”

‘রকমারি’ নামের অনলাইন বইয়ের দোকানের হিসাব মতে এবারের বইমেলার বেস্ট সেলার হিসেবে আসা দুটি ধর্মীয় বইয়ের বাম্পার হিটের প্রতিক্রিয়ায় উপর্যুক্ত কমেন্টগুলো একটি গ্রুপ থেকে পেয়েছি।

বাংলা সাহিত্যে এম.এ করেছি। এম.ফিলও করলাম। ‘লুতুপুতু’ নামে কোনো সাহিত্য আমি পড়িনি। সাহিত্য জীবনের কথা বলে। মানবজীবন কি নারীর বক্ষ, নিতম্বকে অস্বীকার করেছে? আর আমি তো কোথাও এতো খোলা বুক, উন্মুক্ত নিতম্ব দেখলাম না! এরা এগুলো কোথায় পেলো? এরা কি চটপটির কারিগর রসময় গুপ্তকে মূলধারা ভেবে ভুল করলো নাকি? আফসোস!

ইসলাম ধর্মকে বেইজ্জত করা হয়েছে এমন একটা গল্প, উপন্যাস, নাটকের নাম শুনতে ইচ্ছে করছে। একটা কবিতাও কি ইসলামকে কটাক্ষ করে নজরুল-জীবনানন্দ-রবীন্দ্রনাথরা কোনোদিন ভুলেও লিখেছিলেন? আহারে! এরা যদি রবীন্দ্রনাথ পড়তো তাহলে বুঝতে পারতো তিনি কোন ধর্মকে অন্তরে লালন করেছিলেন! দাড়ি-টুপির মাহাত্ম্য এই জাতি একাত্তরে তো দেখেছে। এদেশে সুদখোর মহাজনের দাড়ি নেই? টুপি মাথায় অন্যের জমি দখল করে না এলাকার হাজিসাব? এগুলো সিনেমায় এলে, গল্পে এলে কি দাড়িটুপির অসম্মান হয়! আমার একটা মাদ্রাসায় পরপর দুইবার ধান চুরি করে ধরা খেয়েছে দুইজন হাফেজ-মাওলানা! আমি রাতের আঁধারে তাদের চলে যেতে বলেছি এলাকা ছেড়ে। অসম্মানতো করিনি। প্রকৃত আল্লাহওয়ালা হাফেজ কি চোর হতে পারে? ”লালসালু”র মজিদরা কি আপনার আশেপাশে নেই? সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কি মজিদকে স্বপ্নে পেয়েছিলেন? নাকি গ্রামবাংলায় তিনি হাজারো মজিদকে দেখেন নি?

বাংলা সাহিত্যে ‘মাওলানা’ চরিত্রকে নাকি অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আপনার মসজিদের ইমামকে আপনি কোন চোখে দেখেন? ধরেন, সে মাঠগরম করা ওয়াজ জানে না। আপনি বলেন না- ‘এইসব মেন্দামার্কা হুজুর চলব না। এরে পাল্টান’। ভিলেজ পলিটিক্সতো বুঝেন। গ্রামে গিয়ে দেখেন এলাকার মসজিদে বছরে কয়বার ইমাম বদল করা হয়! কেন করা হয়! এইসব কথা গল্পে বললেই দোষ!

বাংলা সাহিত্যে একজন কিংবদন্তিতুল্য সাহিত্যিক আছেন। নাস্তিকতার জন্য যাঁর লেখা আপনারা পড়েন না। অথচ, একটা বাক্য পাবেন না যাতে তিনি নাস্তিকতার জন্য দোষী হতে পারেন! তাঁর একটা সিনেমা আছে- শ্যামল ছায়া। এই সিনেমায় একটি মাওলানা চরিত্র আছে। সিনেমাটি দেখলে বুঝবেন সে কীভাবে অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। একজন দেশপ্রেমিক মাওলানার প্রতি দর্শকের মায়া কতোটা প্রবল হয়ে উঠে, অনুধাবন করেন। এদেশের মাওলানারা যদি আফগান কিংবা পাকিস্তানপ্রেমী হয় তাকে গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে বলেনতো! এই দেশে থাকবেন অথচ করাচিতে শীত লাগলে এখানে কম্বল নামাবেন তা কী করে হয়! অহ, সিনেমা না দেখলে এই নামে উপন্যাসও পাবেন। পড়তে পারেন।

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্পে’ দেখেন একজন মাওলানা চরিত্র পাবেন ইরতাজউদ্দিন নামে। তাঁর প্রভাব, প্রতিপত্তি, দেশপ্রেমের গল্প পড়লে বুঝবেন বাংলা সাহিত্যে ভালো মাওলানা চরিত্র আছে কি না!

হুমায়ূন আহমেদের গল্প ‘পাপ’ পড়েন। একজন মাওলানা পাপ-পুণ্যের মীমাংসা খুঁজতে কতোটা মরিয়া হয়ে উঠেছে দেখেন। সমাজে তাঁর গুরুত্ব, সম্মান, অবস্থান সবিস্তারে বলা আছে। তাঁর স্ত্রীর একজন পাকিস্তানি মেজরকে বাঁচানোর আকুতি এবং মাওলানার কারণে বাঁচাতে না-পারার মর্মজ্বালা তাঁকে কতোটা বিপর্যস্ত করে তুলেছে পড়ে দেখেন। মাওলানা মানুষ খুঁজে বেড়ায় কোন এথিক্স থেকে তা বুঝার চেষ্টা করেন। খালি ‘কতল’ করার মধ্যে জান্নাতি সুবাস থাকে না। মানুষ হয়ে উঠার শিক্ষাটাও প্রয়োজন।

‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে একজন মাওলানা আছে। সে নিজের ভুলে স্ত্রীকে হারায় এবং শেষে পাগল হয়ে পড়ে। error of judgement বলে একটা বিষয় আছে। এর দ্বারা নিজের ভুলে নিজের ট্রাজিক পরিণতি রচনা করাকে বুঝায়। এমন ভুলতো মাওলানারা গত মাসেও করলেন। তবে, এ ভুলে বৌ হারায়নি কেউ, উপরন্তু কয়েকটার সন্ধান পাওয়া গেছে! এই আরকি!!

আরাকানে মুসলমানরা সাহিত্য রচনা করেছেন কুরআন থেকে কাহিনি নিয়ে, ফারসি কাহিনিকে অবলম্বন করে। সেটা মধ্যযুগে। শাহ মুহম্মদ সগীর গংরাও নারীর রূপ এঁকেছেন, লুতুপুতুর গীত গেয়েছেন। বক্ষ, নিতম্ব সবই খুলে দিয়েছেন। যুগের চাহিদাকে তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন নি। সেই লেখকদের একজন কুরাইশ বংশের! কোরেশী মাগন ঠাকুর নাম তাঁর।

ধর্মাশ্রিত সাহিত্য মীর মশাররফ হোসেনও লিখেছেন। তবে, আমাদের রবীন্দ্রনাথে বিচরণ করতে হয়েছে এর বৈধতা দিতে- “যা ঘটে, তার সব সত্য নয়। কবি, তব মনোভূমি/ রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো”। একসময় বাঙালি মুসলমানের ঘরে ঘরে ‘বিষাদসিন্ধু’ শোভা পেতো।

সাহিত্যের বাজারে কে টিকবে, কে টিকবে না তা সময়ই বলে দেবে। কাল হলো সাহিত্য বিচারের সবচেয়ে বড় নিয়ামক। দুই চার বইমেলা দিয়ে সবকিছু বিচার করা যায় না। তবে, বাংলা সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি, আঙ্গিক, বিষয় যদি নতুনকে ডিজার্ভ করে তাকে স্বাগত জানাতেই হবে। একসময় সব ভেঙে মাইকেল এসেছেন, বিদ্রোহের রণতূর্য নিয়ে এসেছেন নজরুল, নিভৃতে একলা চলেছেন জীবনানন্দ এমন আরো কতোজন তার হিসেব করাও দুরূহ ব্যাপার।

সাহিত্য দিয়ে পতাকা পরিবর্তনের গীত গায়েন না। ইসলামকে নিজেদের সম্পত্তি মনে করে সাহিত্যে যদি ‘ইসলামি উপযোগিতাবাদ’কে আনতে চান তবে এর সব কালি আপনাদের মুখেই পড়বে।

বাংলা সাহিত্যের জয় হোক।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *