প্রথম পাতা » মতামত » … এবং রবীন্দ্রনাথ

… এবং রবীন্দ্রনাথ

Rabindranath Tagore

এই তল্লাটের সবচেয়ে স্মার্ট, আধুনিক ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিশীল সত্তা, এক ‘বাঙালি বুড়ো’র জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখ। দিনটি নিয়ে জাতীয় উচ্ছ্বাস ও আয়োজনের তেমন কোনো দৃশ্যপট চোখে পড়েনি আজ।

বাঙালি একদা দরিদ্র ছিল। তখন রবীন্দ্র-নজরুল ছিল আমাদের ঐশ্বর্য। আজ বাঙালি উচ্চবিত্তের কাতারে চলে গেছে! তাই রবীন্দ্র-নজরুল তেমন উচ্চকিত নয়। মোটামুটি ঠেলায় পড়ে যারা বাংলা সাহিত্য পাঠ করে তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ ক্বচিৎ দুষ্টুগ্রহ আর নজরুল হ্যালির ধূমকেতু রূপে আবির্ভূত হয়। বঙ্গীয় অঞ্চলে রবীন্দ্র-নজরুল চর্চাও প্রায় জাদুঘরে।

আমরা বুঝে গেছি : চিত্তের চেয়ে বিত্ত বড়!

আমাদের রাস্তাঘাট আছে, ব্রিজ-কালভার্ট আছে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ আছে, গ্রাম হয়েছে শহর। তাই ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ’ এখন ক্লান্তিকর, সুদূরে পরাহত। আমরা আরো টাকা কামাই করব, একসময় অনেক টাকা আমাদের হবে। কিন্তু ‘মানুষ’ হওয়া হয়ে উঠবে কী না তা-ই অজানা। বুঝা গেলো বাঙালির ঘরে লক্ষ্মী আর সরস্বতীর পূজা একসাথে হয় না। বাংলা সাহিত্যের শান্ত সমুদ্র রবীন্দ্রনাথ আর সেই সমুদ্রের উন্মাতাল ঢেউ কাজী নজরুল চেয়েছিলেন বাঙালির মানস জগতকে আলোকিত ও উচ্চকিত করতে কিন্তু আমরা পড়ে রইলাম অযাচিত তর্কযুদ্ধে : কে বড় কবি? নজরুল না কি রবীন্দ্রনাথ? ‘সঞ্চিতা’ আর ‘সঞ্চয়িতা’কে দাঁড়িপাল্লায় তুললাম আমরা!

রবীন্দ্রনাথকে আমরা কখনো বুঝতে চাইনি। তাঁর প্রতি আমরা সঠিক বিবেচনা করিনি। এমনকি লালনের প্রতিও না, নজরুলকেও না। আমাদের কাছে জরুরি কার কয়টা বিয়ে, কার সাথে কার পরকিয়া, কে প্রেমিক কে বিদ্রোহী, কার কবিতা ইসলাম গ্রহণ করেছে, কারটা করেনি, কার লেখায় মুসলমান চরিত্র আছে, কারটায় নেই, কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছে, কে করেনি- এইসব হাবিজাবি প্রশ্নে ঘুরপাক খেলো আমাদের সাহিত্যচর্চা। পরনিন্দা আমাদের মজ্জাগত বলে এই তল্লাটে কেউ মুক্তি পায়নি। মনোজগতের কবিও না, রাজনীতির কবিও না। কেউ এখানে অবিসংবাদিত নয়। বিতর্কিত করাই আমাদের স্বভাব। তাই শত বছর পরেও প্রমাণিত (?) হয় মহাত্মা গান্ধী সমকামী ছিলেন! আহারে! আহারে!!

বাংলা অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথের কয়েক রকম মুরিদান রয়েছে। একদলের কাছে রবীন্দ্রনাথ সাক্ষাৎ দেবতা। এরা রবীন্দ্রাদর্শে বুঁদ হয়ে শিল্পের ভারে নুয়ে পড়া গোষ্ঠী। এরা কলেরায় যখন মরো মরো তখনও হাসপাতালের বেডে শুয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় : ‘আমার এ দেহখানি তুলে ধরো…’

একদল আছে যারা সুযোগ পেলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা (?) নিয়ে চটকদার গল্প বলে বেড়ায়। এরা ছোটবেলায় পড়েছে : “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে / বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।” রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এদের জ্ঞানও হাঁটু পর্যন্ত!

আরেকদলের কাছে রবীন্দ্রনাথ এক বিভীষিকার নাম। বাংলার কতিপয় শিক্ষার্থী শ্রেণি এ-দলভুক্ত। কোনো না কোনো ক্লাসে এই বুইড়ার কবিতা-গল্প থাকে পাঠ্য! পোলাপাইন বিমর্ষ হৃদয়ে তাঁর গল্প-কবিতা পড়ে আর পরীক্ষার হলে গিয়ে কঠিন কঠিন উদ্দীপক দেখে মনে মনে দোয়া করে : এই বুইড়া মরে না ক্যা?

আমার মতো অভাগাজনও আছে কিছু। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ রীতিমতো বিস্ময়কর এক প্রাণি। কবিতার প্রথম লাইন পড়লেই মনে হয় এ আর এমন কী? আমিও পারব লিখতে! প্রথম লাইনটা হয় কিন্তু দ্বিতীয় লাইন লিখতে গেলেই জীবন ক্ষয়! তখন বিস্ময় আরো বাড়ে! একজন মানুষ এক জীবনে এতো লেখা কীভাবে লিখেছে? এতো রকম চিন্তাও করা যায়? সাধু! সাধু!! তাঁর লেখাগুলো দেখে দেখে লিখতেও নাকি লেগে যাবে চল্লিশ বছর!!! জীবনে তাঁর কতো বড় সঞ্চয়! আর আমাদের কতোই না অপচয়!! ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টা করি নিরন্তর। কারণ কবি বলেছেন : কাব্য পড়ে যেমন জানো কবি তেমন নয়গো!

দুঃখ কাকে বলে এর প্রায় সবই কবিগুরু পেয়েছিলেন এক জীবনে। স্ত্রী মারা গেলেন কবির ৪১ বছর বয়সে। কবির ছিলো তিন মেয়ে এবং দুই ছেলে। রথীন্দ্রনাথ, শমীন্দ্রনাথ, বেলা, রাণী ও অতশী।

স্ত্রীর পর অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন রাণী। এরপর কলেরায় মারা গেলো ছোট ছেলে শমী। পুত্রশোকে কবি লেখলেন-
আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে।
কবির মনে হলো এই জোৎস্নায় কবি বনে গেলে হবে না বরং তাঁকে জেগে থাকতে হবে, যদি বাবার কথা মনে পড়ে শমীর! যদি এসে কবিকে না পায়? তিনি লেখলেন-
আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে।

রাণীর জামাইকে পাঠিয়েছিলেন কবি বিলেতে ডাক্তারী পড়তে, না পড়েই ফেরত আসলো। বড় মেয়ের জামাইকে পাঠিয়েছিলেন বিলেতে, ব্যারিস্টারী পড়তে, না পড়েই ফেরত আসলো। ছোট মেয়ে অতশীর জামাইকেও আমেরিকায় কৃষিবিদ্যার উপর পড়াশোনা করতে পাঠালেন কিন্তু লোভী এই লোক কবিকে বার বার টাকা চেয়ে চিঠি দিতো। কবি লেখলেন

– জমিদারী থেকে যে টাকা পাই, সবটাই তোমাকে পাঠাই।
দেশে ফেরার কিছুদিন পরে ছোট মেয়েটাও মারা গেলো।

সবচাইতে কষ্টের মৃত্যু হয় বড় মেয়ের। বড় জামাই বিলেত থেকে ফেরার পর ছোট জামাইয়ের সাথে ঝগড়া লেগে কবির বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। মেয়ে বেলা হয়ে পড়েন অসুস্থ। অসুস্থ এই মেয়েকে দেখতে কবিগুরু প্রতিদিন গাড়ি করে মেয়ের বাড়ি যেতেন। কবিকে যত রকম অপমান করার এই জামাই করতেন। কবির সামনে টেবিলে পা তুলে সিগারেট খেতেন! তবু কবি প্রতিদিনই যেতেন মেয়েকে দেখতে। একদিন কবি যাচ্ছেন, মাঝপথেই শুনলেন বেলা মারা গেছে। কবি শেষ দেখা দেখতে আর গেলেন না। মাঝপথ থেকেই ফেরত চলে আসলেন। হৈমন্তীর গল্প তো কবির মেয়েরই গল্প! ‘দেনা-পাওনা’র নিরুও তাই। মেয়েদের দুঃখময় জীবনকে ঠাঁই দিয়েছেন ‘হৈমন্তী’, ‘দেনা-পাওনা’ ও ‘অপরিচিতা’ গল্পে। সাথে ছিল দেশ-কাল-সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। আর তাই কল্যাণীকে আঁকলেন নতুন যুগের রোকেয়ারূপে, কল্যাণময়ী সুধা কণ্ঠধারী আদর্শ কর্মীরূপে, অনবদ্য বাঙালি নারীর সৌকর্যে, নতুন নারীর আগমনী চরিত্ররূপে।

ছেলে-মেয়েদের নিয়ে শোক কতটা গভীর হলে কবির কলম দিয়ে বের হলো – ‘নাবার ঘরে একবার ওকে সাপে কেটেছিল। তখনই যদি ওর মৃত্যু হতো তবে পিতা হিসেবে আমি বেঁচে যেতুম!’ কতো কঠিন কথা তাঁকে বলতে হয়েছে। আবার অন্যত্র বলেছেন :আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥

কবির মৃত্যু হলো অতিমাত্রায় কষ্ট সহ্য করে, প্রশ্রাবের প্রদাহে। কী কারণে যেন কবির বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শেষ বিদায়টাও পাননি। দূর সম্পর্কের এক নাতনি ছিলো কবির শেষ বিদায়ের ক্ষণে।

কবি জমিদার ছিলেন এইসব গল্প সবাই জানে। কবির দুঃখের এই জীবনের কথা কজন জানেন?

প্রথম যৌবনে যে গান লেখলেন, এইটাই যেন কবির শেষ জীবনে সত্যি হয়ে গেলো-
আমিই শুধু রইনু বাকি।
যা ছিল তা গেল চলে, রইল যা তা কেবল ফাঁকি॥

রবীন্দ্রনাথের আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন শতবছর পরের ভবিষ্যৎ বাণী : ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে পড়িছ বসি / আমার কবিতাখানি / কৌতূহল ভরে!’ তবু তাঁর সাহিত্যের কালোত্তীর্ণ সংশয়-প্রত্যয় নিয়ে তেমন উচ্চাশা ছিল না বলেই মনে হয়! এক জায়গায় কবি বলেছেন : ‘আমি যতদিন আছি তুমিও থাকিও প্রিয়!’

রবীন্দ্রনাথকে চর্চা না করলে তাঁর কিছু আসবে যাবে না বরং আমরাই চৈতন্যের দিক থেকে হয়ে যাব লেফাফা দুরস্ত। বাঙালির মন ও মননের ঋদ্ধতার জন্যই রবীন্দ্রচর্চা অতীব জরুরি।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *