প্রথম পাতা » মতামত » আশ্চর্য সৃষ্টিশীলসত্তা : জ্যোতির্ময় রবীন্দ্রনাথ

আশ্চর্য সৃষ্টিশীলসত্তা : জ্যোতির্ময় রবীন্দ্রনাথ

Rabindranath Tagore

ছিলেন বড় পরিবারের ছোট সন্তান। বিস্ময়কর তাঁর সমগ্র জীবনসত্তা, আশ্চর্য তাঁর সৃষ্টিশীলতা। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব তিনি। বাঙালির ইতিহাসে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সুদর্শন যুবক, প্রাজ্ঞ প্রৌঢ়। উপমহাদেশের যেথায় যত আলো সেখানেই ছিলো তাঁর উপস্থিতি। তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের কাছে নতজানু হয়েছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদগণ, তাঁর চিত্তের কাছে সমীহ হয়েছিলেন সমগ্র ভারতের বিত্তশীলেরা। সৃষ্টিশীল বাঙালির কাছে আজো তিনি নমস্ব, আশ্চর্য এক পরিশ্রমী প্রতিভা। বিস্ময়কর তাঁর জীবনবোধ। অর্থের মোহ, রাজনীতির কলুষতা, নারীর রূপৈশ্বর্য কোনো কিছুই তাঁকে এতোটুকু কলঙ্ক দিতে পারেনি। যদিও কোনো কোনো বাঙালির ঘরে ঘরে তাঁকে নিয়ে রয়েছে মুখরোচক গল্প! সাম্প্রদায়িকতার বিষফোঁড়া সেসব কল্পিত গল্পজুড়ে আছে ক্রিয়াশীল। আছে নষ্ট রাজনীতির বিনাশী মনোবৃত্তি, আর আছে ধর্মান্ধ মানুষের রুদ্ধ মনের প্রতিক্রিয়াশীলতার লজ্জা। রবীন্দ্রনাথের আশ্চর্য সৃষ্টিশীলতা এদের নজর কাড়েনি। বাঙালির আসরে আজো রবীন্দ্রনাথ আলেচিত-সমালোচিত। তাঁকে নিয়ে হয় আসর শুরু হয় আর না হয় শেষ হয়। ধর্মের জলসাতেও তিনি ওঠে আসেন। কূপমণ্ডুক ধর্মবেত্তাগণ তাঁকে গালি দিয়ে আরাম পান, সময় কাটান, খেপ মারেন। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বাঙালির মনোরঞ্জনে রবীন্দ্রনাথ বাকসর্বস্ব হুজুর-কেবলাদের প্রধানতম উপকরণ। এরা অবাক বিস্ময়ে রবীন্দ্রবিরোধিতার সার্ধশতবর্ষ পার করছে। কিন্তু তাঁর উপস্থিতি দমানো যায়নি। বাঙালির প্রতিদিনের জীবন থেকে তাঁকে সরানো যায়নি। জাতির সংকটে তিনিই বারবার বেজে ওঠেন অন্তরাত্মার সুর হয়ে। মানুষের ব্যক্তিক কিংবা সামষ্টিক পতনে তিনিই হয়ে ওঠেন জাগ্রত বিবেক। তাঁর কাছ থেকে বাঙালির মুক্তি নেই। তিরিশের কবিরা চেযেছিল মুক্ত হতে, ষাটের অপশক্তি চেয়েছিল তাঁকে বর্জন করতে, নষ্ট সময় চেয়েছে তাঁর বন্ধন ছিন্ন করতে। কিন্তু তিনি আছেন আষ্টেপৃষ্ঠে। শত বছর আগেও ছিলেন, পরেও থাকবেন।

🌺 রবীন্দ্রনাথ-যাঁকে বাতিলের চেষ্টা করে আসছে নষ্টরা পবিত্র পাকিস্তানের কাল থেকে; পেরে ওঠেনি। এমনই প্রতিভা ঐ কবির, তাঁকে বেতার থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয় জুড়ে বাজেন; তাঁকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয়ের কাব্যগ্রন্থে মুদ্রিত হয়ে যান, তাঁকে বঙ্গভবন থেকে বাদ দেওয়া হলে তিনি সমগ্র বঙ্গদেশ দখল করেন; তাঁর একটি সঙ্গীত নিষিদ্ধ হলে তিনি জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠেন।

প্রতিক্রিয়াশীল নষ্টরা অনেক লড়াই করেছে তাঁর সাথে, পেরে ওঠে নি; তাঁকে মাটি থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি আকাশ হয়ে ওঠেন; জীবন থেকে তাঁকে নির্বাসিত করা হলে তিনি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন জাতির স্বপ্নালোকে। নষ্টরা তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে আপ্রাণ। যদিও তিনি জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, তবুও তিনি জাতীয় কবি নন। তাঁর নামে ঢাকায় একটি রাস্তাও নেই; সংস্থা তো নেই। তাতে কিছু যায় আসেনি তাঁর; দশকে দশকে বহু একনায়ক মিশে যাবে মাটিতে। তিনি বেঁচে থাকবেন বাঙলায় ও বিশ্বে।
— হুমায়ুন আজাদ

নষ্টদের কবলে দুই কবি, জলপাই রঙের অন্ধকার।

কী অপরিসীম আত্মবিশ্বাস থাকলে একজন কবির কবিতা শতবর্ষ বেঁচে থাকার অভিপ্রায় প্রকাশ করতে পারেন :

‘আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহল ভরে!’

রবীন্দ্রনাথ বাঙালির কৌতূহলের নাম। তাঁর মুরিদানদের জন্য তিনি অপার বিস্ময়, তাঁর বিরোধীদের কাছেও ভয়ানক হিংসার নাম। কী করে একজন মানুষ এতো সৃষ্টিশীল হতে পারে? আশি বছরের পুরো সময় তিনি ভয়ানক পরিশ্রম করেছেন। কোনোদিন সকালে মনে হয়েছে আজ ওমুককে একটু লেখা দরকার। এক চিরকুটের জবাবে তিনি লিখেছেন সাঁইত্রিশ পৃষ্ঠা! কী দানবীয় শক্তি আর স্থিতধীসম্পন্ন হলে এটা সম্ভব। তাঁর সমস্ত লেখা দেখে দেখে লিখলেও একজনের কেটে যাবে চল্লিশ বছর! সৃষ্টির কী সীমাহীন বৈচিত্র্য আর সংখ্যাতীত সমগ্রতা।

৫৬ টি কাব্য, ২৯ টি নাটক, ১৩ টি উপন্যাস, ৯৫ টি গল্প, ২২০০+ গান, দুই সহস্রাধিক চিত্রকর্ম, প্রবন্ধগ্রন্থ, চিঠিপত্রের বই, শিক্ষা, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, সমাজনীতি, রাজনীতির বহুবিচিত্র লেখনীতে জীবনের কথকতা বলে গেছেন তিনি। যাদের কথা বলেননি তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বিপুলা পৃথিবীর সবকিছু একজনকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই তিনি মেনে নিয়েছেন সেসব নিন্দার কথা। নতুনের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছেন। পথ চেয়ে বসে ছিলেন সৃষ্টিশীল এক মহামানবের যে এসে পূর্ণ করবে তাঁকে, সমগ্র বাঙালিকে। সে এসেছিল কি না সেই ইতিহাস অন্য সময়ের। তবে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরাও মেনে নিয়েছিলেন রবিই ছিলেন কবিদের গুরু। নজরুল লিখেছেন :

‘পরোয়া করিনা বাঁচি কি না বাঁচি, যুগের হুজুগ কেটে গেলে
মাথার ওপর রয়েছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে
শুধু প্রার্থনা করি যারা তুলে খায় তেত্রিশ কোটি দেবতার গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ!’
– কাজী নজরুল ইসলাম, আমার কৈফিয়ত

আইনস্টাইন ছিলেন কবির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একবার কবিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের কথা। কবি তেমন কিছু বলতে পারলেন না। তিনি লজ্জা পেলেন। উপমহাদেশের একজন বিজ্ঞানীর খবর আইনস্টাইন জানেন অথচ তিনি জানেন না! এরপর সত্যেন বোসকে নিয়ে তিনি পড়ালেখা করলেন এবং লিখে ফেললেন বিজ্ঞান নিয়ে এক বিস্ময়গ্রন্থ ‘বিজ্ঞানের কথা!’ রবীন্দ্রসাহিত্য জুড়েই শুধু আলো আর আলো। তিনি অপার এক জ্যোতির্ময়, বাঙালির সমগ্রসত্তায় তাঁর প্রকাশ। অথচ এক শ্রেণির না-মানুষেরা সেই সত্তার আলোর নিচেই অন্ধকারে নিমজ্জিত কলুষ। তাঁকে নিয়ে সম্প্রতি ঢাবির আমার শিক্ষক ড. আজম বলেছেন যথার্থ এক উক্তি :

“রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এক কোটি আলাপের বিকল্প বাদ দিয়ে যারা শুধু তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন কিনা– এ বিষয়ে আলাপ তোলে, তারা এক অর্থে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তাদের জন্য আমার আফসোস হয় এই ভেবে, তারা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার রস আস্বাদনে চিরবঞ্চিত। দুনিয়ায় এত এত রস থাকতে এখানে কেবল রবীন্দ্রনাথের কথাই বলতে হলো। কারণ, এরা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে লিপ্ত অথচ মজাটা লুটতে পারছে না।”

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *