প্রথম পাতা » জীবনযাপন » মধ্যবিত্তের বোগাস জীবন

মধ্যবিত্তের বোগাস জীবন

life and discrimination

গতকাল যে বিষয়টি ছিল টপ অব দ্যা কান্ট্রি ধীরে ধীরে তা গা-সহা হয়ে যাবে আমাদের। অতীতের অন্য সকল ঘটনার মতো এটিও বিলীন হবে আমাদের চিন্তার জগতে। আমাদের সামনে আবার নতুন বিষয় আসবে। আমরা মেতে উঠব নতুন বাতচিতে। আমরা শিল্পের কথা বলব, জীবনের স্তুতি গাইব, ন্যায়ের পতাকা উড়াব, সুস্থ বিনোদনের কথা ভাবব, নির্মল আনন্দের দাওয়াই দিব, ধর্মের ছবক আওড়াব…ইত্যাদি ইত্যাদি।

এগুলো বলবে কারা? বাংলাদেশের সবচেয়ে নিষ্পেষিত, নিগৃহীত, চটুল, চিরঅভাবী এক শ্রেণির নাম মধ্যবিত্ত! এরা না-পাওয়ার যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত দগ্ধ হয়। রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম এই শ্রেণিকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করে। মুখবুজে সহ্য করা ছাড়া এদের কোনো উপায়ও নেই। এদের বিত্ত নেই, বৈভব নেই। এরা ‘আঙুর ফল টক’ মনে করা নিয়তির বঙ্গীয় এক মনুষ্যজাতি।

গতকালের ঘটনাটি অবজার্ভ করলাম। পরিচিত, অপরিচিত যাদের আলোচনা, সমালোচনা চাউড় হলো; হাবভাবে বুঝলাম এদের জীবনের সাথে আমার তেমন পার্থক্য নেই। বাংলাদেশের একজন প্রথম শ্রেণির নাগরিক আমি। কয়েকটা হিসাব মেলাতে চাইলাম-

আমি নমব গ্রেডের একজন কর্মকর্তা। রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণির নাগরিক (?)! আমার প্রাপ্ত ইদবোনাস নিয়ে বসুন্ধরায় একবার ঢুঁ মারলে সেই টাকা দিয়ে বড়জোর তিন চারটা প্যান্ট কেনা সম্ভব, দশমিনিটে পকেট আজাইর! আমি বরং জেলায় বা উপজেলার কোনো মার্কেটে গিয়ে ঐ টাকায় চৌদ্দগোষ্ঠীর ইদবাজার করব। একে শপিং বললে ভুল হবে। শপিং অন্য জিনিস!

আমার একমাসের বেতন নিয়ে হোটেল রেডিসনে একরাত্রি যাপন করা অসম্ভব ব্যাপার! সেখানে কয়েকজন বন্ধুর সান্ধ্যআড্ডার চায়ের বিলও নাকি লাখ তিনেক টাকা হতে পারে! আমি একরাত সেখানে আয়েশ করলে সারামাস আমার পুরো পরিবার না খেয়ে থাকবে।

আল্লাহ বাঁচায়ে রাখলে ২০৪৮ সালে আমি রিটায়ার্ড করব। আমার পেনশনের সমস্ত টাকা দিয়ে বসুন্ধরা সিটিতে একটা এপার্টমেন্ট কেনা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের একটি হবে।

আমি কোনোদিনও রেডিসনের বারান্দায় পৌঁছতে পারব না। আমার মা-বাবা, ভাইসহ পুরো পরিবারের একবার সমুদ্রভ্রমণে যেতে হাজার পঞ্চাশেক টাকা লাগে। আমি দুইবছর ধরে সেই টাকা জোগাড় করতে সমতলেই খাবি খাচ্ছি!

আমি মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাসে কোনোদিন সেকেন্ড হইনি। তাতে কী ঘোড়ার ডিম হয়েছে? আমার সহকর্মীদের তিনবছর ধরে নিয়মিত পদোন্নতি বন্ধ! বারো বছর ধরে লেকচারারের চাকরি করছেন আমার পরিচিত কতোজন ! সমাজ আমাকে কীভাবে মূল্যায়ন করে? আমার সৎপথের বেতনে কেনা কুরবানির গরু দেখলে পড়শিরা হাসে কারণ পাশের বাড়ির এসআইয়ের দামড়া (ষাঁড়) আমাদের বংশের কয়েক পুরুষকে টেনে নিয়ে ভাগাড়ে ফেলবে!

ড. হুমায়ূন আজাদ রাষ্ট্রের কাছে এক লক্ষ টাকা বেতন চেয়েছিলেন নব্বই দশকে! আহারে আক্ষেপ! বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এক লাখ টাকা বেতনের আফসোস নিয়ে মরেই গেলেন! অথচ, গতকাল যে ফ্ল্যাট থেকে লাশটি পাওয়া গেলো সেটির ভাড়া নাকি এক লাখ টাকা!

একটি সমাজ যখন নানামাত্রিক বৈষম্যে বিক্ষত হয় তখন সেখানে বিবিধ অপকর্ম ঘটতে থাকে। ধনবানের রক্ষিতা সংস্কৃতির বিপরীতে চলে গরিবের ধর্ষণকাণ্ড, পরকিয়া, অন্যজনের বৌ নিয়ে ভেগে যাওয়া। “সমাজে যখন বেহায়াপনা বেড়ে যায় নানারকম অচেনা রোগ – ব্যাধিতে জর্জরিত হয় মানুষ”- নবি স. এর হাদিস।

গতকালের ঘটনায় কারা বকবক করছে? একজন শিল্পপতি কি কোনো বিবৃতি দিয়েছেন? দেননি। তারা ভাবছেন লম্পট-এ-বসুন্ধরা ধরা খাইল কেমনে? এ থেকে তারা শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে কাম সারবেন। তাদের ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার সাথে সাথে আরেকটা প্রতিযোগিতা চলে অন্দরে। কার রক্ষিতা কতো সুন্দর! কে কেমন সার্ভিস দেয় এসব হয় তাদের অবসরের আড্ডার মুখরোচক সংলাপ!

কোনো মিডিয়া গুরুত্ব দিয়ে সংবাদটি প্রচার করেনি কেন – এমন প্রশ্ন করছেন কেউ কেউ। আমাদের মিডিয়া যারা চালান তারা আসলে লম্পট বাহাদুরদের জন্য হুর সাপ্লায়ার! এরা বিত্তের স্তাবক। একজন নটির তবু ধর্ম থাকে এদের সেটিও নেই। সুতরাং এদের কাছ থেকে কিছু আশা করা বাতুলতা মাত্র!

শতবছর পূর্বে ঠাকুরবাড়িতেও একজন আত্মহত্যা করেছিলেন। ঠাকুরবাড়ির ছেলেদের তাতে কী হয়েছিল? হাজার বছর পূর্বেও এমন কতোজন আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছে তাদেরও কিছু হয়নি। ঠাকুরবাড়ির আসলে কিছুই হয় না! আমরা নমশূদ্ররাই কেবল হা-হুতাশ করে মরি!

রাজরাজড়াদের হেরেমখানা নতুন কোনো বিষয় না। তাদের অর্থ থাকে। বিবেককে কিনে নেয় তারা। কৃষ্ণচন্দ্ররা চিরদিনই ভারতচন্দ্রদের বিবেককে বাজেয়াপ্ত করে টাকার বিনিময়ে। বিত্তের ঔরসে বাণিজ্যেরই জন্ম হয়, শিল্পকলার নয়। শিল্পকলাও কি বিত্ত-নিরপেক্ষ থাকতে পেরেছে কোনোদিন?

একটি পঁচনশীল সমাজব্যবস্থায় বাঙালি মধ্যবিত্তের চরম পরিণতির সাক্ষী হতে পেরে আপাদমস্তক পুলক অনুভব করছি!

জীবনযাপন থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *