তিনজনেরই নামের আদ্যক্ষর ‘হ’! তিনজনের নামই প্রতাপশালী একজন মুঘল সম্রাটের নামে- হুমায়ুন। আরবি ‘হুমায়ুন’ শব্দের অর্থ সৌভাগ্যবান, ধন্য, রাজকীয়! বাংলাদেশে অনেক হুমায়ুন থাকলেও আমি এখানে লিখছি- হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন ফরিদী ও হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে।
তিনজনই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভূ-ভাগে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনজনের দুইজন বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের ঘরে জন্মেছেন। হুমায়ুন ফরিদী অন্য দুজনের কনিষ্ঠ। ভাষা আন্দোলনের বছর তাঁর জন্ম- গাজিপুরের কালিগঞ্জে। হুমায়ূন আহমেদ জন্মেছেন নেত্রকোণায়। হুমায়ুন আজাদ জন্মেছিলেন আড়িয়ল বিলের দেশে- বিক্রমপুরে (মুন্সিগঞ্জে)। ড. আহমেদ ও ড. আজাদ দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং প্রাক্তন অধ্যাপক। হুমায়ুন ফরিদীর উচ্চশিক্ষা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে- অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর তিনি। আজাদ বাংলা সাহিত্যে আর হুমায়ূন আহমেদ রসায়নে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনজনই পরে এসেছিলেন একবিন্দুতে- শিল্পকলার চর্চায় নিযুক্ত হয়েছিলেন তাঁরা।
তিনজনই এখন পরলোকে । তিনজনই পেয়েছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক- একুশে পদক। তিনজনই বাংলাদেশকে ভালোবেসে দিয়ে গেছেন অমূল্য ও অরূপ রতন। তাঁরাও পেয়েছিলেন মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা, জনপ্রিয়তা ও শ্রদ্ধা। বাংলা ও বাঙালির গর্বের ধন ত্রিরত্ন ‘হুমায়ুন’ সত্যকার অর্থেই সৌভাগ্যবান। তাঁরা ধন্য। বাঙালির মনের মণিকোঠায় তাঁরা ছিলেন রাজকীয় সম্রাট। মুকুটহীন হলেও তাঁদের মহিমা আজো ম্লান হয়নি। তিনজনই হয়েছেন অজর, অমর।
হুমায়ুন আজাদ বেঁচেছিলেন অন্যদের সময়ে। বহুমাত্রিক লেখক, প্রতিভাধর এ গুণী মানুষটির মূল্যায়ন করার মতো সক্ষমতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তখনো ছিল না। এখনো হয়নি। কোনোদিন হবে সেটিও দুরাশা। তাঁরই উক্তি – মানুষ সিংহের প্রশংসা করলেও মনে মনে সে গাধাকেই পছন্দ করে। সত্য বলার সৎ সাহস ছিল তাঁর। সমকালে তাঁর মতো কোনো কবি উচ্চকণ্ঠে প্রচলিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে কলম ধরেননি। তিনি কাউকে পরোয়া করেননি। কোনো রাজার সভাকবি হলে রাজসিক পরিবর্তন হতো তাঁর। তিনি সে পথে হাঁটেননি। তাঁর সত্য বলার স্পর্ধা ছিল। তিনি বিনয়ী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন- বিনয়ীরা সুবিধাবাদী। তিনি কারো কাছ থেকে সুবিধা নেননি। অকপটে বলে গেছেন মৌলবাদের বিরুদ্ধে, প্রথার বিরুদ্ধে, সমকালীন যন্ত্রণার বিরুদ্ধে। তিনি কবি, প্রাবন্ধিক, ভাষাবিদ, শিক্ষক এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক। বাংলাদেশকে তিনি ভালোবেসেছিলেন। সেজন্য তিনি সৃষ্টি করেছিলেন ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’! ফলে তিনি শত্রু হয়েছিলেন প্রতিক্রিয়াশীলদের। তিনি চক্ষুশূল হয়েছিলেন একাত্তরের পরাজিতদের। যারা বাংলাকে আফগান বানাতে মরিয়া তারা হুমায়ুন আজাদদের কখনোই সহ্য করবে না এটাই সত্য। হয়েছেও তাই। ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে ফেরার সময় তিনি আক্রান্ত হলেন প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবুজ থেকে বেড়িয়ে এসেছিল হায়েনারা। অবিকল মানুষের মতো। চারপেয়ে দানবেরা হত্যার বুনো উল্লাসে মেতেছিল সেদিন সন্ধ্যায়। ড. আজাদের কাছে ছিল তখনো বইগুলো। সেদিন বইগুলোই হলো তাঁর ঢাল। প্রাণে বাঁচলেও সেই ক্ষত রয়ে গেলো তাঁর। জার্মানির মিউনিখে মারা গেলেন ২০০৬ সালে একাকী, নিঃসঙ্গ অবস্থায়। ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। বিশ্বকে চোখের সামনে তুলে ধরতেন আশ্চর্য কৌশলে। শিক্ষকতায় তাঁর স্বাতন্ত্র্য ছিল। তাঁর লেখায় ছিল কবিত্ব, বলাতেও। গদ্যেও সে কবিত্ব ধরা পড়ে। ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ কিশোর উপন্যাসটি পড়লে বুঝা যায় তাঁর গদ্যের তেজ ও সুর। ইতিহাসেও কী মায়াবী ছন্দ থাকে তা জানতে পড়ুন- ‘লাল নীল দিপাবলি’! ব্যাকরণ ও ভাষার ইতিবৃত্ত কতটা মধুর তা জানতে পড়তে পারেন- ‘কতো নদী সরোবর’!
তাঁর কবিত্ব টের পাওয়া যায় এই কবিতাটিতে :
ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।
ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।
শুভেচ্ছা- হুমায়ুন আজাদ
এছাড়া তাঁর ‘অলৌকিক ইস্টিমার’, ‘জ্বলো চিতাবাঘ’, ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’ গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ। ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, ‘আমার অবিশ্বাস’, ‘ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ’ উপন্যাসে দেশের প্রতি তীব্র ভালোবাসা ও মৌলবাদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। একটা শ্রেণি এদেশ থেকে হুমায়ুন আজাদের নাম মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে এই সাহসী বুদ্ধিজীবীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ করতেই এরা তৎপর। এরা মৌলবাদী, এরা পরাজিত নপুংসক। এরা প্রগতিশীলতাকে ভয় পায় বলেই হুমায়ুন আজাদরা এদের চিরশত্রু। কিন্তু সময়ই শ্রেষ্ঠ বিচারক। হুমায়ুন আজাদদের মূল্যায়ন নির্মোহ মহাকাল ঠিকই করছে, করবে। তারাই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে যারা তাঁর সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত।
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের বাদশাহ নামদার। রাজকীয় জীবন যাপন করেছেন লেখালেখি করে। এদেশে লেখকরা ভাত পায় না। প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন স্বয়ং নজরুল, জীবনানন্দরা। কিন্তু হুমায়ূন প্রকাশকদের ঘুরিয়েছেন। তিন বছর, পাঁচবছর আগে এ্যাডভান্সড করতে হতো একটি পাণ্ডুলিপির জন্য! বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পকে একাই বাঁচিয়ে তুলেছিলেন তিনি। তাঁর একক জনপ্রিয়তায় বইমেলা পৌঁছে গেছে বাঙালির উৎসব-আমেজে। বাংলা নাটকে তিনি অপ্রতিরোধ্য নির্মল বিনোদন সৃষ্টি করেছেন। অনেক লিখেছেন তিনি। সিনেমাও বানিয়েছেন বেশ। যেখানেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলেছে। বাঙালি মধ্যবিত্তের রুচি ও জীবনবোধ তৈরিতে তিনি অগ্রগণ্য। তাঁর অসংখ্য উপন্যাসের মধ্যে ‘মধ্যাহ্ন’, ‘অচিনপুর’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘বাদশাহ নামদার’ অনন্য। তাঁর ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমাটি আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। একটি শ্রেণি হুমায়ুন আজাদ মনে করে হুমায়ূন আহমেদকে গালিগালাজ করে, নাস্তিক উপাধি দেয়! হায়রে অভাগা দেশ!
হুমায়ুন ফরিদী অভিনয় জগতে তাঁর কালে তো বটেই অন্যদের কালেও সেরা। মঞ্চ থেকে ওঠে আসা গুণী এই অভিনেতা অসংখ্য সিনেমায় ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক মাতিয়েছেন। শুক্রবারের সিনেমার দিন আমরা বিটিভির পর্দায় তাকিয়ে থাকতাম। যখনই শুনতাম আজ হুমায়ুন ফরিদী আছে আমাদের চিন্তার সীমারেখা থাকতো না। আজকের এতো ঝামেলা মিটিয়ে নায়ক জিতবে তো! ফরিদী যে বাটপার! তাঁর ‘পালাবি কোথায়’ সিনেমাটি অনবদ্য সৃষ্টি। এছাড়া আরো অনেক সিনেমায় তিনি মনমাতানো অভিনয় দিয়ে দর্শকের মন কেড়েছেন।
তিনজনের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল? হুমায়ুন আজাদ পণ্ডিতজ্ঞ মানুষ। তিনি কাউকে হিসেবে আনতেন না। ঔপন্যাসিক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনের নামডাক ছড়িয়ে পড়ার সময় হুমায়ুন আজাদ লিখলেন- ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ কাব্য। উৎসর্গও করলেন তাঁদের দুজনকে! ইমদাদুল হক মিলন লিখলেন ‘বনমানুষ’! উৎসর্গ করলেন ড. আজাদকে! ড. আজাদ নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়েছিলেন মিলনের কর্মকাণ্ডে। হুমায়ূনের উপন্যাসকে ড. আজাদ ‘অপন্যাস’ বলতেন! সম্পর্ক কেমন ছিল বুঝে নেন!!
হুমায়ুন ফরিদীকে হুমায়ূন আহমেদ ‘মিতা’ ডাকতেন। প্রায়ই উপহার দেওয়া-নেওয়া চলতো দুজনের। হুমায়ুন ফরিদী তখনো একুশে পদক পাননি। হুমায়ূন আহমেদ গুণী এই মানুষটি যেন শিল্পকলায় একুশে পদক পান সেজন্য বহু জায়গায় আফসোস করে বিবৃতি দিয়েছেন। পরে মরণোত্তর একুশে পদক পান হুমায়ুন ফরিদী।
আমার সাথে এই তিনজনের কী? ‘নাটক আমার নামাজ রোজা, নাটক আমার পাবন পূজা’ তাই হুমায়ুন ফরিদী আমার জান-প্রাণ। লোকটার প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে তাঁর প্রতিটা সিনেমা দেখেছি। ‘ভণ্ড’ সিনেমা দেখেছি আঠারোবার! শুধু তাঁর অভিনয় দেখার জন্য। এককালে নাটক করতাম! অনেকে আমাকে হুমায়ুন ফরিদী বলতো! সেসব কথা আগেও লিখেছি। পরেও লিখব। হা হা হা।
হুমায়ুন আজাদ আমার বিভাগের শিক্ষক। আমি তাঁকে সরাসরি ক্লাসে পাইনি। তবে তাঁর আধ্যাত্মিক শিষ্য। তাঁকে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই।
বাংলায় মাস্টার্স করেছি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ সব রথী মহারথীদের পাঠ করে আমি আটকে গেছি হুমায়ূনে!!! আমি এম.ফিল. করলাম তাঁর গল্প নিয়ে। ভালোবাসার প্রমাণ আর কেমনে দিব? তাঁর কতো উপন্যাস যে আমার আনন্দময় দুপুরকে করেছে বিষাদময় কী বলব! কতো যে কাঁদিয়েছে হিমু, বাদল, শুভ্র, নবনী, মীরা, জহিররা! হিসেব নেই। তাঁর চরিত্রদের এখনো আত্মীয় বলেই ভ্রম হয়! কত যে ভালোবাসি তাঁকে, তাঁর সৃষ্টিকে! অপার বিস্ময়ে!!
আরেকটা জিনিস খিয়াল করছেন? তাঁদের নামের আদ্যক্ষর ‘হ’! আমারটা কী???
তিনজনকেই মহান স্রষ্টা আনন্দময় ভুবনে রাখুন, এই প্রার্থনা করি। জয় হোক সকলের।