প্রথম পাতা » অন্যান্য » মরণপানি

মরণপানি

১৯৯৮ সালের বন্যার সময় আমি বোধহয় ক্লাস থ্রি কিংবা ফোরে পড়ি৷ সেবারকার বন্যায় পাকুটিয়া বাজারেও পানি উঠে গিয়েছিল৷ পাকুটিয়া গ্রামটা এমনিতে বেশ উঁচু, সহজে বন্যার পানি উঠে না৷ ১৯৮৮ সালের বন্যার পর সর্বশেষ ১৯৯৮ সালেই পানি উঠেছিল৷ ৮৮ সালের বন্যার সময় অনেক পরিবারের মতো আমাদের পরিবারও পাকুটিয়া জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল৷ ৯৮ সালের বন্যায় জমিদার বাড়িতে আশ্রয় না নিতে হলেও প্রায় সবাই পানিবন্দী হয়ে পড়েছিলাম৷ পাকুটিয়াসহ আশেপাশের প্রায় সব গ্রামেই কয়েক সপ্তাহ হাট বাজার বসা একদম বন্ধই ছিল বলা যায়৷ হাট বসলেও হাটুরে খুব কম৷ যাদের খুব দরকার তারা দূর- দুরান্ত থেকে কলাগাছের ভেলায় করে হাটে আসতো৷ বাড়ির ডিমপাড়া বা ওমের মুরগি কিংবা মাশকলাইয়ের ডাল বিক্রি করে কিনে নিয়ে যেতো নিত্য দরকারি সদাইপাতি৷

যাদের অবস্থা মোটামুটি ভালো তারা ভাতটাত খেয়ে কোনমতে দিন পার করতে পারলেও যারা দিন এনে দিন খায় তারা কিছু না পেয়ে কলাগাছের মোচা সিদ্ধ করে খাওয়া শুরু করলো৷ কলাগাছ কেটে বানানো হতো ভেলা আর কলাগাছের মোচা মেটাতো পেটের জ্বালা! ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী পদ্যময়৷ কলাগাছের ভাদাইল পর্যন্ত রেহাই পেতোনা ক্ষুধা থেকে৷ ভাদাইলের পোশাকি নাম কলার থোড়৷ সেটাও খাল থেকে ধরা ছোটছোট ইচা (চিংড়ি) মাছের সাথে চচ্চরি করে খেয়ে নিতো৷ ভাদাইল হল কলাগাছের পেটের একেবারে ভেতরের নরম সাদা অংশ৷ কলাগাছের মজ্জা৷

“নামটি আমার কলাগাছ- যেথায় সেথায় বাড়ি,
আদর কিংবা লাঞ্ছনায় বেঁচে থাকতে পারি।”

কিন্তু বন্যার সময় কলাগাছের বেঁচে থাকা বেশ কঠিন ব্যাপার৷ কলাগাছ কেটে ভেলা না বানালে গ্রামের মানুষের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া একেবারেই অসম্ভব৷ আর ভাদাইল খাওয়ার ব্যাপারতো আছেই৷ টাংগাইল মানিকগঞ্জের দিকে কলাগাছের ভেলাকে বলে ভুড়্যা৷ তবে দুই চার ঘর যাদের নৌকা আছে তাদের কথা আলাদা৷

এভাবে শাক কচুঁ ঘেচুঁ এসব খেয়েই মানুষকে দাঁতে দাঁত চেপে দিন কাটাতে হতো আর পানি কবে নেমে যাবে তার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে হতো৷ ভাত পানির কষ্ট, সব মিলিয়ে যাকে বলে ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয়৷ তার উপর মানুষগুলোর রাতে শান্তিমতো ঘুমানোরও উপায় ছিল না৷ সাপখোপ এসে আশ্রয় নিতে চাইতে পারে৷ এরকম এক বন্যার সময় একদল লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে কলাগাছের ভেলায় করে আউটপাড়া গ্রামের কাছাকাছি একটা জায়গায় গেল সাপ মারতে৷ চারপাশে থৈথৈ পানির মধ্যে এখানে সেখানে ছোট ছোট দ্বীপের মতো কিছু জায়গা৷ নানা রকম কাঠগাছ আর জিগাগাছ দিয়ে ভরা৷ সেসব গাছে কিলবিল করছে দাঁড়াশ সাপ৷ দারাজ বা ধারাজ সাপ নামেও এরা পরিচিত৷ দলবেধে লাঠিসোঁটা নিয়ে গেলেও দুই একটার বেশি সাপ মারতে পারেনি৷ কয়েকটা সাপ গাছ থেকে লাফ দিয়ে নাকি ভেলায় উঠে পড়েছিল৷ ভয়ে ভেলা থেকে অনেকেই পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল৷ সাপের কামড় কেউ খায়নি৷ সাপ না মেরেই তাই ফেরত আসতে হয়েছিল সবাইকে৷ কেনইবা তারা দলবেঁধে মহা উল্লাসে সাপ মারতে গিয়েছিল তা আমার জানা নাই৷

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে শুনি আরেক ঘটনা৷ একটা শিয়াল ধরে বাজারের গোলচত্বরের উঁচু জায়গায় বেঁধে রাখা হয়েছে৷ গরু ছাগল বেঁধে রাখার জিনিস কিন্তু শিয়াল ধরে বেঁধে রাখার ব্যাপারটা বেশ আগ্রহোদ্দীপকই হওয়ার কথা৷ গিয়ে দেখলাম সোনালী রঙ এর বেশ নাদুশনুদুশ একটা শিয়াল গলায় দড়ি দিয়ে বাঁধা৷ পাশের গ্রাম পেত্নীপাড়ার সব বাড়ির মুরগি নাকি সাবাড় করেছে এই শিয়াল পরিবারটি৷ শুধু একেই ধরা গেছে৷ পরিবারের বাকি সদস্যগুলোকে ধরা যায়নি৷ গর্তে পানি ঢুকে যাওয়ায় একটা উঁচু জায়গায় ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল৷ আশ্রয় না নিয়ে গর্তের মধ্যে ডুবে মরলেই ভালো হতো! ওকে ধরতে নাকি সবাইকে বেশ নাকানি চুবানি খেতে হয়েছে৷ সারা পেত্নীপাড়া গ্রামের জলে স্থলে সাঁতার কেটে আর দৌড়াদৌড়ি করে তবেই তাকে ধরা গেছে৷

বিপদ আপদ সবাইকে একই কাতারে এনে দাঁড় করায়৷ প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ এর একটি গল্পে বন্যায় আক্রান্ত মানুষ আর পশুপাখির দূর্দশার বর্ণনা পড়েছিলাম ক্লাস এইটের বাংলা বইয়ে মনে হয়৷ সাপ, মুরগি, শিয়াল, কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল মানুষ সবাই একসাথে বসবাস করছে৷ কেউ কারও ক্ষতি করছে না৷ সাপ আশ্রয় দিতে গিয়ে সাপের কামড় খেলে আমি কি তার দায়িত্ব নেব? মানুষেরই আশ্রয় নাই! মাটিতে বাস করা জীবন পানিতে বন্দী হয়ে পড়লে এর চেয়ে তড়পানির বিষয় আর হয় না!

তবে, সিলেটে যে ভয়ঙ্কর চেহারার বন্যা হচ্ছে তার তুলনায় আমার বন্যার অভিজ্ঞতা কিছুই না। একদম কিছুই না। গ্রীষ্মকালীন অবকাশ শেষ করে গতকাল ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল আসলাম। বাসে বসে সিলেটের বন্যাকবলিত মানুষের দূর্দশার অনেকগুলো ভিডিও দেখে মনের মধ্যে খুব বড় ধরণের তড়পানি হতে লাগলো। তবে এটা ঠিক, সিলেটের বন্যার খবর আর ভিডিও দেখে টাংগাইলের শুকনা টনটনা সন্তোষে বসে বানভাসী মানুষের দুঃখ কষ্ট কিছুটা উপলব্ধি করা গেলেও পুরোপুরি বুঝা যাবে না৷ পুরোপুরি না বুঝাই ভালো! সবটা বুঝতে পারলে অসহায়ত্বের যে তীব্র জ্বালা মনে জ্বলতে থাকবে তা নেভাতে গেলে টাংগাইল থেকে সিলেটের বন্যাক্রান্ত মানুষের কাছে চলে যেতে হবে৷ যতোটা পারা যায় সাহায্য করতে হবে৷ খাবার, পানি, ঔষধ, নৌকা যা দিয়ে যেভাবে পারা যায়৷ দূরে থেকে যে কিছুই করা যাবে না তা নয়। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে অর্থসাহায্য পাঠানো যায়।

মানুষ পানিতে সাঁতার কেটে সংসারের জিনিসপত্র যতোটুকু পারা যায় সরিয়ে নিচ্ছে৷ সরাবেই বা কোথায়! ভিডিও দেখে মনে হলো নূহের (আঃ) মহাপ্লাবন, এক বিঘাও শুকনো জমি নাই, পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নেয়া ছাড়া মনে হয় উপায় নাই! ঘরের খাট, চৌকি ভেসে যাচ্ছে। খড়ের গাদা পানির তোড়ে ডুবতে ডুবতে চলে যাচ্ছে, মুরগিগুলো ভাসমান খড়ের গাদার উপর আশ্রয় নিয়েছে, যতক্ষন খড়ের গাদা ভাসবে ততোক্ষণই জীবন। টিনের ঘর ভেঙ্গে পানিতে ভাসতে ভাসতে তলিয়ে যাচ্ছে,ইটের ঘর-দেয়াল বালুর বাঁধের মতো ধ্বসে পড়ছে। বড় বড় গাছপালা পায়ের নিচে মাটি হারিয়ে অসহায়ের মতো মুখ থুবড়ে পানিতে আছড়ে পড়ছে। কয়েকদিন ধরে না খাওয়া শরীর নিয়ে বৃদ্ধ আর শিশুদের পাজাকোলা আর কোলে করে নৌকায় উঠাচ্ছে। অনেকেই টিনের চালের উপর আশ্রয় নিয়েছে, আসমান থেকে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মতো বৃষ্টি পড়ছে,উপরে নিচে সব জায়গায় পানি, মানুষ যাবে কোথায়! এসব ফিরিস্তি অসহায়ত্ব কিছুটা হজম করার জন্য লিখলাম৷

মানুষের পাশাপাশি গরু ছাগল, কুকুর বিড়াল সবাই পড়েছে মহাবিপদে। একটা ছবিতে দেখলাম তিনটা গরু কাদায় মাখামাখি হয়ে পেট ফুলে মরে পড়ে আছে। কিছু কিছু জায়গায় বানের পানি নেমে গেছে আর বের হয়ে আসছে এরকম ভয়াবহ ছবি। আরেকটা ভিডিওতে দেখলাম দুইটা গরু বাছুরসহ একটা ডুবতে বসা রাস্তায় আটকা পড়েছে। রাস্তার ঐপাশ থেকে এই পাশে আসার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। হঠাত করে রাস্তার পাড় ভেঙ্গে বাছুরটা পানিতে পড়ে স্রোতের টানে হারিয়ে গেলো। তাই দেখে মা গরুটা লাফ দিয়ে পানিতে নেমে গেলো। অন্য গরুটাও দেখাদেখি লাফ দিল পানিতে। কিছুক্ষন মাথা ভেসে থাকতে দেখা গেলো, তারপর তিনটাই ডুবে বিলীন হয়ে গেলো পানির স্রোতে। প্রতিটা জীবন পড়ে গেছে সীমাহীন কষ্টে। মানুষগুলো সাংবাদিকদের মাইকের সামনে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ছে, না খাওয়া গলা দিয়ে কথাও বের হতে চাইছে না, ভিজে চুপচুপে হয়ে শরীরের চামড়া ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, সব হারিয়ে এমনকি কান্নাও হারিয়ে ফেলেছে মানুষগুলো। কি আর বলার আছে! যে যার জায়গা থেকে যতোটুকু পারা যায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই।

অন্যান্য থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *