প্রথম পাতা » গল্প » ছোটবেলার ঈদ, জমিদার বাড়ি আর কিছু “বলা-বাহুল্য” কথা

ছোটবেলার ঈদ, জমিদার বাড়ি আর কিছু “বলা-বাহুল্য” কথা

eid mubarak

সারা মাস রোজা রাখতাম। কয়েকটা মাঝেমাঝে বাদ পরে যেতো। সেহরীতে উঠতে পারতাম না। আসলে আম্মা ডেকে তুলত না। দিনের বেলায় আমার রোজায় ধরা অবস্থা দেখে মায়া লেগে ডাকত না। মা বলে কথা। মাছের মায়ের মায়া নাই। মানুষের মায়ের পুত্র- কন্যা শোক ঠিকি আছে। মায়েরা বেহেস্ত -দোজখ এর তোয়াক্কা করে না। সন্তানের শুকনা মুখ দেখে তারা বেহেস্তে যেতে চাইবে না। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত এমনি এমনি আল্লাহ ঠিক করে রাখেনি ।

কিন্তু আমি ভালই রাগ করতাম কেনো আম্মা আমাকে ডেকে তুলল না। আমার আমলনামা বাম হাতে দিলে আমার বিপদ কি আর আম্মা দেখবে? হাসরের ময়দানে সবাই নাকি ইয়া নফ্সি ইয়া নফ্সি করবে। খালি মুহম্মদ (স:) উম্মতি উম্মতি করবে। আমি বিশ্বাস করি মায়েরা ঠিকি সন্তান সন্তান করবে। মাছের মায়ের মতো মায়েরা না। মানুষের মায়েরা। এতে করে ধর্মের মতের সাথে অমিল হলেও আমার ইমানে ঘাটতি আছে বলে দীনের দাওয়াত দিতে আসতে পারেন। আমি দাওয়াত কবুল করবো। তারপরও আমি মায়েদের দলেই থাকব। দল আর মত বদলাব না।

সব রোজা না রাখতে পারার কষ্ট হতো। মায়েরা কি ভেবে কি যে করে তা অতো শত বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম মায়েরা যা করে ভালোর জন্যই করে। তারপরও আম্মাকে সারা দিন ব্যাজার মুখ দেখিয়ে বেড়াতাম।

শেষ রোজা। আজকে রাতে আর তারাবি পড়তে হবে না। এটা নিয়েও প্যাচ লেগে যেতো। রোজা রাখলাম তারাবি কেনো পড়ব না? আব্বা বুঝায়, শুরুতে রোজা না রেখেই যে তারাবি পড়লি ঐটা কেনো করছিলি? হিসাব মিলল। আর ঐদিকে “রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ” বেজে যেতো বিটিভি তে।

পরের দিন সকালে নতুন জামা কাপড় পরে ঈদের নামাজ পড়তে যাব । আনন্দ। রাতে ভালো করে ঘুম আসত না খুশির চোটে । কিন্তু সকাল সকাল উঠতে হবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়তাম। ফজরের নামাজ না পড়লে ঈদের নামাজ হয় না। তাই জানতাম। আজও জানি। সকালে উঠে ফজরের নামাজ পড়তাম। তারপর এটা সেটা করে হেটে হেটে নতুন লাক্স সাবান নিয়ে জমিদার বাড়ির বড়ো পুকুরে গোসল করতে যেতাম। ঈদের গোসল নতুন সাবানে করতে হয় কিনা। গোসল করে এসে আম্মার বানানো সেমাই খেয়ে মসজিদে যেতাম। মিষ্টি খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নত এটাও তাই জানতাম।

সারা মাস রোজা রেখে দিন সকালে খেতে গিয়ে কেমন কেমন যেন লাগতো । কবরে প্রতিটা খাদ্য দানা সাপ আর বিচ্ছু হওয়ার ভয় হঠাৎ চলে আসত মনে। কিন্তু এখন ভয় নাই। এখন সেমাই আর বিষধর সাপ হয়ে কবরে আজাব দেবে না।

ঈদের মাঠে হাজির। নামাজ শেষে সমবয়সীদের সাথে কোলাকুলি করে বাসায় ফেরা। বাসায় ফেরার পথে সেভেন আপ কিনে খেতাম। এতদিন অনেককে পর্দার আড়ালে গিয়ে চা টা টা টা খেতে দেখেছি। আমি তো রোজাদার ছিলাম তাই পর্দার ভেতরে আর বাইরে আমার জন্য একই। বে-রোজাদার হলেই যে সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে কট্কটি খেয়ে বাজারে হেটে বেড়াবে তা কেনো হবে। তাহলে যে আল্লাহ দেখে ফেলবে। আর মানুষ তো দেখবেই । আল্লাহ কে বেশি ভয় নাকি মানুষ কে বেশি, বুঝা কঠিন মনে হতো তখন। এখন যে বুঝি তাও না। আর বুঝলেও জ্ঞান ফলানো অনুচিত। সবার সব কিছুর অভাব থাকলেও জ্ঞানের অভাব নাই। হাটে বাজারে, চায়ের দোকানে জ্ঞানরা চায়ের কাপে মাছির মতো পড়ে থাকে।

এক মাস পর আজকে সকালে আমি প্রকাশ্যে সেভেন আপ খাচ্ছি। পর্দার আড়ালে যাওয়ার দরকার আগেও হয় নাই এখন তো নয়ই। পর্দার আড়ালে আল্লাহ কিছুই দেখতে পারে না। আপনি যতই ছোট হউন না কেনো এটা বিশ্বাস করা অসম্ভব। আমিও বিশ্বাস করতাম না। যে আল্লাহ এর হুকুম ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না, সাগরের নিচে একটা পোকা হাটলেও পায়ের শব্দ শুনতে পায়, আর একটা পর্দার ভেতরে একজন চা আর সিগারেট খাচ্ছে তা দেখতে পারবে না এটা বিশ্বাস করলে অবিশ্বাসীর খাতায় আপনার নাম অমুচনীয় কালি দিয়ে লেখা হয়ে যাবে।

খানেওয়ালারা মনে হয় আল্লাহ এর দৃষ্টিশক্তির ক্ষমতা জানে না। জেনেও ভুলে থেকে পান -খানের আনন্দ বেশি মনে হয়। “জেনে শুনেই আদম হাওয়া গন্ধম খেয়েছিল কিনা। আদি পিতা আদি মাতা বলে কথা।” “এটা খাওয়া নিষেধ, খেও না কিন্তু।” “কি বলেন আরও বেশি করে খাবো। পর্দা লাগিয়ে খাবো। কালো পর্দা। বদ নজর ঢুকবে না।” নিজের দোষ পিতা মাতার উপর দেয়া আরেক অন্যায়।

বাসায় এসে খিচুড়ি আর মাংস খেয়ে শুয়ে শুয়ে বিটিভি দেখতাম (বিটিভি অনেক ভালবাসি তা না। অন্য কোন চ্যানেল ছিলো না) আর বিকেল হওয়ার অপেক্ষা করতাম। বিকেলে সব বন্ধুরা আসবে আর জমিদার বাড়ির মাঠে বসে থাকব। তারপর এখানে সেখানে ঘুরতে যাবো । আগেও অনেকবার গিয়েছি এমন জায়গাও নতুন করে ঘুরতে যাওয়ার বিষয় হয়ে উঠত। জায়গা একই কিন্তু উপলক্ষ আলাদা। উপলক্ষ পুরাতন জায়গাকেও নতুন করে ফেলে।

একদম নতুন জায়গায় যে যেতাম না তা নয়। গ্রামে আবার নতুন জায়গা কি!গ্রাম তো গ্রামই। গ্রাম তো আর শহর না। আমি শিশু পার্কেই যাইনি তখনো আর শহর কেমন হয় তা আমার জানার কথা নয়।

যেসব গ্রাম কম গ্রাম্য ঐসব গ্রামে যেতে চাইতাম আমরা। কিন্তু পাকুটিয়ার মতো শহুরে গ্রাম আমি কোথাও দেখি নাই। শহুরে মানে একটু এগিয়ে আর কি। গ্রাম থাকবে গ্রামের মতো। শহর হয়ে গেলে তো সর্বনাশ কারো কারো মতে। “গ্রাম হবে শহর।” আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন। আমি একমত। “গ্রামের মানুষও নাগরিক। ভোট দেয়, আঙুলে কালি লাগায়। তাহলে নগরের মানুষ শুধু নাগরিক সুবিধা কেনো পাবে?” হক কথা। কাঠ পুড়িয়ে চোখ জ্বালিয়ে রান্না কেনো করবে? গ্যাসের চুলায় রান্না করবে। এল পি জি হৌক আর ব্রডব্যান্ড লাইনের গ্যাস হৌক।

যদিও পাকুটিয়া অনেক আগে থেকেই শহুরে জামা পড়েছে । জমিদার বাড়ির গ্রাম বলে কথা। একটি নয়, দুইটি নয়, তিন তিনটা জমিদার বাড়ি। আর বড়ো মন্দির ও নাট্যমন্দির তো আছেই। অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার হতো না। ছোটবেলার ছোট ঈদ বড়ো বড়ো জমিদার বাড়ির সিঁড়িতে বসেই কাটিতে দেয়া যেতো অনেক গল্প করে। ঈদ উপলক্ষ বলে কথা। পুরান হয়ে যায় নতুন।

ঝাকে ঝাকে অন্য গ্রাম থেকে মানুষ আসত। আবার যারা শহর থেকে আশেপাশের নানা গ্রামে ঈদ করতে আসত তারা ভীড় করতো পাকুটিয়া জমিদার বাড়িতে এসে।

ঘর হতে দুই পা দুরে ধানের শিষের উপর শিশির বিন্দু পায়ে মাড়িয়ে পর্বতমালা আর সমুদ্র কেনো দেখতে যাবো!? পতেঙা সমুদ্র সৈকত অবশ্য দেখতে গিয়েছিলাম। ক্লাস নাইনে পড়ি তখন। গিয়ে ফেসে যাওয়ার মতো অবস্থা। গ্রামের এক স্পোর্টিং ক্লাব এর উদ্যোগ। চাদা নিয়েছিল ঠিকি সিট দিল না। সিট কম যাত্রী নেবে বেশি। অতো বড়ো দুরের রাস্তা কোন কান্ডজ্ঞান নাই। টাকার হাতছানিতে কান্ডজ্ঞান বটগাছের মগডালে। ফুটবল এর উপর বসে যেতে হয়েছিল মোটামুটি সারা রাস্তা। বিশ্বাস না হলে কিছুই করার নাই। অসম্ভব শুনাচ্ছে মনে হয়। কিন্তু ঘটেছে এরকম। আমার ছেলেবেলার অনেক বন্ধু এই লেখা পড়বে। তাদের মধ্যে অনেকেই গিয়েছিল “ফুটবলে বসা আর খিচুড়ির ড্যাগ এ বসা” টুরে। ওরা আমার সাক্ষী। যাওয়া -আসা আর খাওয়া -দাওয়া এর কষ্ট বাদ দিলে প্রথমবারের মতো সমুদ্র দেখার আনন্দ তো কম হওয়ার কথা না।

যাই হৌক, সব সময় শিশির বিন্দু আর ভালো লাগে না, গোটা একটা উথাল পাথাল সমুদ্র লাগে । লাগলে কাউকে দোষ দেয়া যায় না। শিশির যেমন লাগে সমুদ্রও তেমন লাগে। সময়, আওগাত আর রুচি বুঝে। রুচি যতই উপরে উঠুক আর বদ্লাক জমিদার বাড়ির আকর্ষণ উপেক্ষা করা অসম্ভব। আপনি এর আশেপাশে বড়ো হলেও অসম্ভব। তা নাহলে মাঝেমাঝেই কেনো আমরা বালিয়াটি জমিদার বাড়ি ঘুরতে যেতাম!? বালিয়াটি জমিদার বাড়ি মোটর সাইকেলে বড়জোর দশ মিনিটের রাস্তা পাকুটিয়া থেকে। গতিভেদে।

ঈদ এর কথা বলতে গিয়ে জমিদার বাড়ি করে করে মুখে ফেনা তোলার উপক্রম। “রাজার নাই যে ধন আমার আছে সেই ধন।” আমাকে আবার ঐ গল্পের চড়ুই পক্ষী ভাববেন না। জমিদার বাড়ি তো আর আমার না। জমিদার বাড়ি ঐতিহ্য । ঐতিহ্য সবার। ঐতিহ্য টিকে থাকুক। ঈদ আনন্দ বাড়ুক। করোনা দূর হৌক। ঈদ করি, আনন্দ করি সুস্থ থাকি।

ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা- EID উল্টালে হয় DIE. আনন্দের অপর পিঠে মৃত্যু । এরকম যেন কস্মিনকালেও না হয় সেটাই আন্তরিক প্রত্যাশা। এখানে এসে ঈদ মোবারাক বলতে হয়। ঈদ মোবারাক।

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *