আজ গল্প বলার দিন। মাথার ভিতর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতটা ঢুকিয়ে দিলেন আমার কলেজ জীবনের দুজন মহান শিক্ষক। একজন আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. উপল তালুকদার। তিনি আমাকে বা ক্লাসে এ বিষয়ে কিছু বলেন নি। আমি তাঁর ক্লাসের জন্য ছিলাম পাগল। স্যার তখন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের বাংলার প্রভাষক। আমি থাকতাম উত্তরার দিকে। তাই প্রায়ই দেরি হয়ে যেতো। আদমজী কলেজের নিয়ম কানুন খুব কড়া। কলেজের দারোয়ান ছিল ছায়া প্রিন্সিপাল ! এমনও হয়েছে আমি দৌঁড়াচ্ছি আর গেট লাগিয়ে দিচ্ছে। সেদিন আর ঢুকতে পারিনি। যদি প্রথম ক্লাসটা হতো উপল স্যারের তবে আমার চোখ ভিজে যেতো, বুক ফেটে আর্তনাদ করে বলতে ইচ্ছে করতো- ‘গেট খোল শালা।’ কিন্তু সব অব্যক্ত ব্যথা নিয়ে চলে আসতাম। ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ঘুরে বাসায় ফিরতাম। আবার কবে স্যারের ক্লাস সেই দিনের হিসেব কষতাম। স্যারের পড়ানোর ধরন, চলাফেরা, ব্যক্তিত্বে আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো। আরেকজন শিক্ষক ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কতি বিভাগের প্রভাষক সাইদুর রহমান সাইদ স্যার। স্যার আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি। আমার লেখা তিনি খুব পছন্দ করতেন। তাঁর ক্লাস ছিল অসাধারণ। ইতিহাস কী করে প্রিয় বিষয় হয় তা স্যারের ক্লাস না করলে বুঝা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্যার অনেক গল্প করতেন। সেসব গল্পে হলজীবনের নানা রোমান্স থাকতো। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। মনে মনে ভেবেছি ঢাবি ছাড়া আর যাওয়ার জায়গা কোথায়? স্কুলে আমাদের গাজী স্যার বলতেন : ‘ব্যাটা, ঢাবিতে যেসব কাউয়া উড়ে বাংলাদেশের অন্যান্য কাউয়ার চেয়ে বুদ্ধিমান।’ এন্টিলিগারদের অবগতির জন্য বলে রাখি ‘কাউয়া’ মানে কাক ! গাজী স্যার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। তিনি কাককে ‘কাউয়া’ বলতেন।
এবার একটু পেছনের গল্প বলি। প্রান্তবাসীর জনজীবনের গল্প। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রান্তিক জনপদ শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা ঝিনাইগাতী। এই উপজেলার সবচেয়ে অবহেলিত জনপদ গারো পাহাড়ঘেঁষা সীমান্ত এলাকা তাওয়াকুচা গ্রাম। এ গ্রামেই আমার জন্ম। এখানে স্যাটেলমেন্টের সময়, আমার দাদা ১৯৫৬ সালে বসতি গড়ে তোলেন। আমার দাদার আদি নিবাস আসাম। আসামের মুসলমানরা দলে দলে বাংলাদেশে চলে আসেন দেশভাগের পরপরই। আমার পূর্বপুরুষ হয়ে গেলেন সেই বীভৎস ‘ভাগের মানুষ’! তাদের ভাগ্যের নাই ঠিকঠিকানা। দাদা এখানে সেখানে করে শেষে স্থায়ীভাবে থেকে যান শেরপুরের এই পাহাড়ি জনপদে। দাদা একসময় প্রচুর জমিজমার মালিক হয়েও শেষে নিঃস্ব হয়ে মারা যান। তার দুই পুত্র এবং তিন কন্যাকে মোটামুটি দুঃখের সাগরে রেখে পৃথিবী ছাড়েন তিনি।
ভয়াবহ অভাবের সময়ে আমার জন্ম। নব্বই দশকের কিছু আগে। আমাদের এলাকার মানুষ তখন খুব কষ্ট করতো। খাওয়ার কষ্টই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। অনেক পরিবারে তিন চারদিন চুলা জ্বলতো না। কী সব হাবিজাবি খেয়ে দিন কাটতো লোকেদের। প্রচণ্ড অভাব। ভাতের অভাব। কাপড় তো তখন বিলাসী দ্রব্য। কেউ কিছুই চাইতো না। শুধু একবেলা ভাত চাইতো। অভাবে টিকতে না পেরে অনেকেই দেশ ছাড়তে শুরু করলো। রাতের আঁধারে সবাই ঢাকামুখী হতো। তখন ঢাকা যাওয়া ছিল অসম্মানের। এলাকায় টিকতে না পেরে ঢাকা যাওয়া হচ্ছে এ লজ্জায় কেউ দিনে দেশ ছাড়তো না। আমি খেলে বেড়াই। স্কুলে যাই। নদীতে লাফালাফি করি। পাইলে খাই না পাইলে ঘুরে বেড়াই। দিন কাটে পল্লির ছায়া আর মায়ার তলে। হঠাৎ এক রাতে ঘুম থেকে জাগানো হলো। জিনিসপত্র বস্তাবন্দি। বুঝলাম এবার আমরা পালিয়ে যাব! চিরচেনা সেই সোমেস্বরীর তট, পাহাড়, ঝোঁপ, জঙ্গল, বালুর মাঠ, নানা নানি সবাইকে ছেড়ে আজ রাতে আমরা চলে যাচ্ছি অনন্তের পথে। কী হাহাকার! কী ভয়ঙ্কর নিশুতি রাত। আমরা হাঁটতে লাগলাম। নদী পার হলাম। আমাদের বাড়ির সুখ দুঃখের সাথী কুকুরটা পিছু নিয়েছে। একটু পর পর সামনে দাঁড়ায় আবার ছোটে। ঘণ্টা দুই হাঁটার পর বড় গাড়ি ! জীবনে প্রথমবার বড় গাড়ি দেখে আমিতো উল্টো দৌঁড় দেবার অতিক্রম। বাইকের প্যাঁ পোঁ শুনলেই হৃৎপিন্ডে কাঁপুনি ধরে যায় ! অবশেষে গাড়ি ছেড়ে দিল। পেছনে পরে রইলো ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় আমার ছোটো গ্রাম আর দুগ্ধ স্রোতরূপী সোমেস্বরী। ভেঁপু বাজিয়ে গাড়ি চলছে, সাথে কুকুরটাও দৌঁড়াচ্ছে। এক বোবা প্রাণির হৃদয়ার্তি সেই ভোরে শুনেছিলাম আমি- ‘যেতে নাহি দিব হায়’। অনেক পরে সেই কুকুরকে আমি রবীন্দ্র সাহিত্যে পেয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথের ‘পুনশ্চ’ কাব্যের ‘ছেলেটা’ কবিতার সেই নেড়ি কুকুরটার ট্রাজেডি আজো আমার মন ভিজিয়ে দেয়। আমরা ঢাকা যাওয়ার দু মাসের মধ্যে বালুর চরে কুকুরটির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। খবরটি শুনেছিলাম এরও ছয়মাস পর।
ঢাকায় শুরুতেই আমাদের কষ্টকর ও ক্লান্তিকর জীবন শুরু হলো। কোথাও থিতু হতে পারছিলাম না। ছয়মাস ভাসানটেক থেকে চলে আসলাম দক্ষিণখান। এখানেই আমার শেকড় গড়ে উঠলো। এই এলাকার মানুষের সাথে আমার জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন তৈরি হলো। একজন মহান মানুষ অকাল প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মহসিন রেজার সান্নিধ্য আমাকে নতুন করে গড়ে তুললো। তাঁর কাছে শিখলাম সমাজের মানুষের জন্য কী করে ত্যাগী হয়ে কাজ করা যায়। সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে দক্ষিণ খানে তিনি ছিলেন অনন্য একজন। তাঁর সহাস্য কর্মচাঞ্চল্য আমাকে অনুপ্রাণিত করলো সংস্কৃতি চর্চার দিকে। আমি ধীরে ধীরে হতে থাকলাম নাট্য জগতের একজন কর্মী। এরপর আমার এই পরিচয়কে অবারিত করতে ‘থিয়েটার মহলা’র অবদান অসামান্য।
ঢাকায় গিয়ে ছয়মাস পর আমি এক প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হই। ক্লাস থ্রিতে। আমি প্রতি বছর নিয়ম করে ফার্স্ট হই আর আব্বা রেজাল্ট শুনে আপ্লুুত হয়ে বলে : ‘যাও, খেলো গা বাজান’ ! তখন খেলার এতো অর্থ ছিল না। আব্বা সত্যি সত্যিই খেলতে যেতে বলতেন।
প্রাথমিক পেরিয়ে আমি হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। আমার প্রাণের উত্তরখান ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়। বিনা বেতনে অধ্যয়নের আবেদনটা আমাকে প্রতি সেমিস্টার ও প্রতি বছরেই লিখতে হতো। এখানেও আমি দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি বছর ফার্স্ট হলাম। শিক্ষকবৃন্দের একটা মায়া ছিল আমার ওপর। কিন্তু সময় আমাকে নষ্ট করতে চাইল। আমি কুসঙ্গে চলে গেলাম। সিনেমা দেখার একটা ভয়াবহ নেশা আমাকে পেয়ে বসলো। খারাপ পোলাপানদের সাথে মিশতে শুরু করলাম। পকেটমার দু চারজন বন্ধুও জুটে গেলো কেমনে কেমনে ! একদিন এক ভয়াবহ ঘটনার মধ্যে পড়ে গেলাম। কান ধরে তওবা করলাম। এদের সাথে আর মিশবো না। কিন্তু ভালো হইতে চাইলেই সহজে তা হওয়া যায় না ! এসএসসি পরীক্ষার ছয়মাস আগে আমি ভয়াবহ রকমের ভণ্ড হয়ে গেলাম। একটি পতিত আত্মায় পরিণত হতে যা যা লাগে আমার তা-ই হলো। আমি নষ্ট সময়ের নষ্ট মানুষে পরিণত হতে লাগলাম।
একদিন মমতাজ নামের এক ম্যাডাম আমার সন্ধান পেলেন। তিনি আমাকে পড়াতে চাইলেন বিনা বেতনে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। জীবন চললো অন্য এক দিগন্তের অভিমুখে।
গল্পগুলো যত সরল ভাবে বলা হলো আসলে জীবনটা এতো সরল ছিল না। নানামাত্রিক ক্লান্তি ক্লেদে ভরা জীবনের গল্প এতো সহজ হয় না। বহুমাত্রিক জটিলতায় কতোবার থেমেছে আবার শুরু হয়েছে জীবনের গতি তার হিসেব রাখা যায়নি।
আসলেই সহজ কথা যায় না বলা সহজে !
২০০৫ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে আমরা চারজন ঢাবিতে চান্স পেয়েছিলাম। ১৪৩৯ ! এটি শুধু একটি ডিজিট বা সংখ্যা নয়। এর অর্থ বহুমাত্রিক। আমি ভর্তি হলাম ঐতিহ্যবাহী বাংলা বিভাগে। চার বছরের অনার্স, এক বছরের মাস্টার্স, দুই বছরের এম.ফিল. এই সাত বছরের গল্প এক জীবনে শেষ হওয়ার নয়। পিতৃতুল্য অধ্যাপক গিয়াস শামীম স্যার যে স্নেহ আমাকে দিয়েছেন তা শোধ করার সামর্থ্য আমার নেই। ঢাবিতে মেধাবীরা ভর্তি হয় না। সেখানে গিয়ে মেধাবী হয়ে ওঠে- একথাটাই সত্য। বহু গুণীজনের ক্লাস, জীবনাচরণ, ব্যক্তিত্ব আমাদের হৃদয়কে প্লাবিত করে পলি ফেলেছে নিস্তরঙ্গ। সেই পলির পরতে পরতে সেজেছে জীবন, বহিছে নিরবধি। আমার জীবনের সেরা অর্জন আমার বন্ধুরা, হৃদয়ের স্পন্দন।
এক দুর্ধর্ষ পতিত আত্মাকে স্বপ্নের পলে পলে নতুন জীবন দান করেছে আমার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জীবনের সকল পরিচয়ের মধ্য আজো এবং মৃত্যু অবধি এই পরিচয়কেই করতে চাই মহীয়ান- আমি একজন ঢাবিয়ান।
আজ ঢাবির জন্মক্ষণে চির কৃতজ্ঞ সেই মহীয়ান স্রষ্টার প্রতি যিনি আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এরপর কৃতজ্ঞতা সেইসব মহান মানুষদের যাঁদের নাম আমি এ লেখায় উল্লেখ করেছি। আমি চিরঋণে আবদ্ধ আমার শিক্ষকমণ্ডলীর প্রতি যাঁদের ‘ভিতরে বিষের বালি অথচ মুখবুজে মুক্তা ফলান’!
বিশ্ববিদ্যালয়টি হয়ে উঠুক জাতির মন ও মননের প্রতীক। আজ আমার শিক্ষকদের আন্দোলনে যেতে হয়েছে। তাঁদের দাবির জন্য যেতে হয়েছে সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে। এটি জাতির জন্য শোচনীয়। বৈষম্য নিপাত যাক, সাম্য হোক প্রতিষ্ঠিত। জাতির ক্রান্তুিলগ্নে বিশ্ববিদ্যালয়টি যথার্থ ত্রাতার ভূমিকা রাখবে – জাতি এমনটাই প্রত্যাশা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠুক মুক্ত মনের আঙিনা, সমাজ বদলের উজ্জ্বল বাতিঘর। পরিশেষে কৃতজ্ঞতা প্রিয় বিদ্যাপীঠ :
‘আমারে তুমি অশেষ করেছো
এমনি লীলা তব
ফুরায়ে গেলে আবার ভরেছো
জীবন নব নব। ‘
জয় ঢাবি
জয়তু ঢাবিয়ান