আমার অফিস যেন শেষ হয়েও হয় না। রাত আটটায় বের হয়ে গাড়িতে উঠে আবার ল্যাপটপ খুলে বসলাম। সেই সকালে বড় ছেলে টেক্সট করেছে তার ইউনিভার্সিটির সেমিস্টার ফি জমা দিতে হবে। কাল আবার শুক্রবার। টাকা পাঠাতে পারবো না। সোমবারের আগে হবে না। বড় ছেলেটা থাকে কানাডা। এক বছর হল টরেন্টোতে গিয়েছে পড়ালেখা করতে। যাবার সময় ভার্সিটির সমস্ত খরচ থেকে শুরু করে থাকা খাওয়া সব দিয়ে পাঠিয়েছি। যদিও আমার ছোট শালী থাকে টরেন্টোতে। কিন্তু ছেলে সেখানে থাকবে না। কারো বাসায় থাকলে নিজের স্বাধীনতা থাকবে না। এটা অবশ্য আমিও সাপোর্ট করি। আর আমার ক্ষমতা আছে কেন নিজের ছেলেকে অন্যর বাড়িতে রাখবো? তা সে যতই ওর খালা হোক। অন্যর কাছে রাখলে কথা হবেই। আর আমার স্ত্রী লিনাও এটা পছন্দ করে না। ইচ্ছা আছে আর কয় বছর পর ওখানে একটা বাড়ি কিনে বউ আর ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে দিব। আপাতত কিছু গুছিয়ে নেই। মাঝে মাঝে আমার খুব অসহায় লাগে। আমার বন্ধুরা সবাই কম বেশি তাদের পরিবার থেকে সাপোর্ট পেয়েছে। বাবার সম্পত্তি বিক্রি করে কেউ ব্যবসায় লাগিয়েছে, কেউ হয়ত বাড়ি কিনে ভাড়া দিয়েছে। আর পাশা পাশি নিজেদের আয় তো ছিলই। তারা সবাই আজ ভালো অবস্থানে আছে। আমার স্কুলের বন্ধু মাহবুব সপরিবারে আমেরিকা চলে গেছে। সেখানে দুইটা বাড়ি কিনেছে। একটাতে ও ওর পরিবার সহ থাকে অন্যটা ভাড়া দিয়েছে। তাছাড়া একটা চেইন শপ দিয়েছে। মাস শেষ শুধু ডলার ওর একাউন্টে ঢোকে।
অন্য আর এক বন্ধু, আসিফ। ঢাকা থেকে একটু দূরে আশুলিয়ার দিকে একটা ফার্ম হাউজ করেছে। ওর বনানীতে দুইটা বাসা আছে। ফার্ম হাউজটা করেছে নিজের থাকার জন্য। বাবার বাড়ি থেকে যে সম্পত্তি পেয়েছিলো সেটা বিক্রি করে বাকিটা নিজে দিয়ে এই ফার্ম হাউজ করা। দেখার মত একটা বাড়ি। কি নেই ঐ বাড়িতে! ছোট একটা পোলট্রি ও করেছে এক দিকে। দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন গাছের চারা এনে লাগিয়েছে। মাঝে মাঝেই সব বন্ধুদের দাওয়াত থাকে সেখানে। গেলে মনে হয় যেন স্বর্গে এসেছি। বিশাল বড় জায়গা নিয়ে ফার্ম হাউজটিতে এক পাশে আছে বারবিকিউ, সুইমিংপুল, প্রাইভেট পার্টি করবার আলাদা জায়গা। সারা রাত ধরে চলে পার্টি ওখানে। লোকালয় থেকে বেশ দূরে এই ফার্ম হাউজে বউ বাচ্চাদের নিয়ে গেলে তাই ওদের একটা রিক্রিয়েশন হয়। তবে ওখান থেকে প্রতিবারই বুকের ভেতরে হতাশা নিয়ে ফিরি। এখনো আমি খেটেই মরে যাচ্ছি!
লম্বা ট্র্যাফিকে বসে আছি। ড্রাইভার আকবর আমার অনেকদিনের লোক। সবসময় অনেক কথা বলে তবে আজ খুব চুপচাপ। সময়টা কাটাবার জন্য আমি নিজ থেকেই বললাম “ দেশ থেকে ঘুরে আসলে, কেমন আছে সবাই?” । আকবর একটু চুপ থেকে বলল “ ভালো আছে স্যার”। আমি ওর মুখ দেখেই বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। আমি আবার ওকে জিজ্ঞাসা করলাম “ আকবর সব ঠিক আছে তো?”
ও এবার আমাকে অপ্রস্তুত করে কেঁদে ফেলল। “ আরে কি হয়েছে বলবে তো? তুমি দেশ থেকে আসার পর থেকে এত ব্যস্ত ছিলাম তোমার পরিবারের খবর নিতেই পারি নাই।“ মনে পড়লো লিনা বলেছিল ওর ছেলেটা মারা গেছে। ডেঙ্গু হয়েছিলো, অবস্থা খারাপের দিকে গেলে আকবর ছুটি নিয়ে দেশে যায়। ছুটি থেকে আসার পর আমার এই ব্যাপারে কোন কথা হয়নি ওর সাথে।“ আকবর তোমার ছেলেটা অনেক ছোট আমি জানি কিন্তু কিভাবে এত সব হল? তোমাকে আমার জিজ্ঞাসা করা হয়নি। “
“ স্যার ছেলেটা আমার অনেক পাগল ছিল। বাড়ি গেলেও বলতো বাবা আর যাবার দরকার নাই। আমাদের সাথে থাক। আমার বউ ও বলতো আমাদের যা আছে তা দিয়ে দেশে যেন কিছু করি। কিন্তু আমার মন মানতো না। আরও ভালো থাকার আশায় আমি ওদের দেশে রেখে চলে আসি। ছেলেটার এই আট বছরের জীবনে খুব কম আমি ওর সাথে থেকেছি। আব্বা বলতো আকবর ছেলে বড় হয়ে গেলে আফসোস করবি, আমার যা আছে তা দিয়ে তুই এখানে দোকান কর, পরিবারের সাথে থাক। আর এখন দেখেন স্যার, যার জন্য টাকা কামাই করতে আসলাম সেই চলে গেলো। কি করবো এই টাকা দিয়ে? ছেলেটা অসুস্থ হয়ে বার বার নাকি বলছে আব্বা কবে আসবে? আব্বা আসলেই আমি ভাল হয়ে যাব” আমি ভাবছি সাধারণ জ্বর ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু মানুষটাই চলে গেলো। জীবনে চলতে গেলে আসলে কতো টাকার দরকার ? টাকার সেই হিসাব করতে যেয়ে আমি অনেক সুন্দর দিন হারিয়ে ফেললাম স্যার, হারালাম আমার বেচে থাকার স্বপ্নকে।“ আকবরের কথা শুনে আমি কিছু ক্ষণ চুপ করে রইলাম। আকবরের ঐ একটাই ছেলে। ও বলতো ওর ছেলেকে অনেক বড় করতে চায়। ছেলের লেখাপড়ার জন্য টাকা জমাচ্ছে।
রাস্তা একটু খালি পেতেই আবার ছুটলও গাড়ি। আমি গভীর ভাবনায় ডুবে আছি। বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। আমাদের সামনেই ছোটখাটো একটা পার্ক আছে। আমি ওকে ওখানে গাড়ি রাখতে বললাম। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে ভেতরে চলে গেলাম।আজ মনে হয় পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় সব আলোকিত। অনেক মানুষ। বেশিরভাগই হাঁটছে শরীর ফিট রাখতে। মজার বেপার হল এখন আর পঞ্চাশ বা ষাট ঊর্ধ্বরা শুধু পার্কে হাটতে আসে না , অনেক কম বয়সীদের ও দেখা যায়। এটা ভাল সবাই কম আর বেশি নিজের দিকে নজর দিচ্ছে। আমি একটু নির্জন দেখে একটা সিমেন্টে বাধানো বেঞ্চে শুয়ে পড়লাম। বড় বড় গাছের আড়াল দিয়ে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে। কি সুন্দর একটা শান্তিময় পরিবেশ। সত্যি তো বেঁচে থাকতে কত টাকার দরকার হয়? দেহ থেকে যখন আত্মাটা বের হয়ে যায় তখন তো এই বেঞ্চের সমান জায়গায় হয়ে যায়! আমার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে গেলো। গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদটাকে দেখতে দেখতে ঘুম জড়িয়ে এলো চোখে। শান্তির ঘুম।
ঠিক কতটা সময় ঘুমিয়েছি জানি না। চোখ মেলে দেখি আকবর দাড়িয়ে আছে আমার সামনে। ওর চোখে মুখে আশঙ্কা। আমি উঠে বসতেই বলল “ স্যার আপনি ঠিক আছেন তো? আপনাকে সারা পার্ক খুঁজে এখানে এসে দেখি আপনি ঘুমাচ্ছে! স্যার পার্কে তো খারাপ লোকের অভাব নাই, কেউ যদি টাকা মোবাইল নিয়ে চলে যেত? “ আমি কিছু বললাম না, চাঁদের আলো এখন যেন আর বেশি উজ্জ্বল লাগছে। রাত বাড়ছে, পার্ক ফাকা হয়ে যাচ্ছে। গাড়ী পর্যন্ত আস্তে আস্তে চোখে পড়ল চটের বস্তা পেতে অনেকেই গভীর ঘুমে। জীবনের হিসাব মনে হয় অনেক সহজ ওদের কাছে।
গাড়িতে উঠে লিনাকে ফোন দিলাম
“ আসবে কখন? ডিনার রেডি। “
বিয়ের প্রথম বছরটি ছাড়া গত উনিশ বছর ধরে লিনার সাথে আমার এই সব কথাই হয়, বিশেষ করে বড় ছেলের জন্মের পর থেকে। ওদের পড়ালেখা, ওদের ভবিষ্যৎ টাকা পয়সা, এই সব বৈষয়িক বিষয়ে আমাদের কথা আটকে থাকে। অবশ্য লিনা কিন্তু কখনই এসব নিয়ে অভিযোগ করে না অন্যদের স্ত্রীদের মত। সেও বুঝে গেছে সংসার জীবনে একটা সময় পর রোমান্স কম বাস্তবতা বেশি ঢুকে যায়, যেখানে শুধু প্রয়োজন নিয়ে কথা বলা হয়। অথবা ……আমার সাথে থাকতে থাকতে সে আমার মত হয়ে গেছে, যার কাছে একটা ফ্যামিলি ডিনারের চেয়ে শেয়ার বাজারেরে রেট দেখা বা নতুন কোন ইনভেস্টমেন্টের প্লান করা বেশি জরুরী।
“ আসছি বাবু কি ঘুমিয়েছে?”
“ না টিভি দেখছে, স্কুল বন্ধ না, তাকে তো এখন টিভির সামনে থেকে উঠানো যাবে না।“
“ চার পাঁচ দিনের জন্য আমাদের কাপড় গুছিয়ে নাও আমি এসে তোমাদের নিয়ে বের হব।“
“ মানে কি? কোন সমস্যা, কোথায় যাব আমরা? সকালে তো কিছু বললে না? লিনার কণ্ঠে বিস্ময়!
“ এসে বলছি, আর বাবু কে বলবে ওর ফুটবলটা নিতে”
ফোন রাখতেই আকবর বলল “ স্যার কোন সমস্যা? কিছু কি হয়েছে?”
“ আকবর গাড়িতে তেল লাগলে নিয়ে নাও, আমাদেরকে তুমি আমার গ্রামের বাড়ি নামিয়ে দিয়ে, গাড়ি বাসায় রেখে তোমার গ্রামে চলে যাও কিছু দিনের জন্য, তোমার ছুটি। আর বিকাশে এডভান্স বেতন পাঠিয়ে দিবো। চিন্তা কর না।“
জানালা দিয়ে আবার আকাশটা দেখলাম, পূর্ণিমার চাঁদটা যেন হাসছে। অনেক দিন ধরে আমাদের গ্রামের বাড়িটা তালা বন্ধ, আব্বা , আম্মার মৃত্যুর পর এখানে আর আসাই হয় না। অনেক ধুলো জমে আছে, যেয়ে পরিষ্কার করতে একটু কষ্ট হবে ঠিক, তবে আমরা তিনজন মিলে করে ফেলব। আর বাবুও খুশি হবে, বাড়ির পেছনের মাঠে ফুটবল খেলা যাবে। একটা পিকনিক পিকনিক ভাব, সেই ছোটবেলার মত। আহা! আমার বড় বাবাটা মিস করবে !
গাড়ি ছুটছে দ্রুত গতিতে হাইওয়েতে, লিনা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না কি হচ্ছে তবে তার চোখে একটা চাপা আনন্দের হাসি আমি দেখতে পাচ্ছি। আর বাবু! ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া শেষ, “ ফ্যামিলি টাইম, গোয়িং টু মাই ভিলেজ। কমেন্টে সবাই নাকি আফসোস করছে, বলছে “যদি তারাও এমন যেতে পারতো ! “
হা হা হা ইয়াং জেনারেশন!