সিতুলি বেগমের প্রথম ছেলেটা জন্মের পরপরেই মারা গেলে সিতুলির মা আছিয়া খাতুন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে! ছেলের উপরের ঠোঁট কাটা, ঠোঁট নাই বললেই চলে। এরকম ছেলে বেঁচে থাকলে পাড়া প্রতিবেশীদের খোঁচামারা কথা সারাজীবন শোনার চাইতে গোরস্থানে থাকাই শান্তির। পাড়া প্রতিবেশীরা ছেলেমেয়ের দোষ-গুণ মাপে পিতামাতার কর্মফল দিয়ে। ছেলেটা ঠোঁটকাটা হয়েছে যেন সিতুলি বেগমের কোন গোপন দুস্কর্মের ফলে। কিন্তু সেই দুস্কর্ম আর গোপন নাই, ঠোঁটকাটা ছেলে জন্ম হয়ে সেটা প্রকাশিত হয়ে গেছে।
ছেলেটা মরে গিয়ে পিতামাতাকে গঞ্জনা থেকে রেহাই দিয়ে গেল। আছিয়া খাতুন এসব ভেবে নাতির মৃত্যুকে আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যেই করে ধরণের হিসাব মনে করে নাতির শোক কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করে। নাতিটার চোখজোড়া কি সুন্দর হয়েছিল, ঠিক ওর নানার মত। হাসমত আলী বেঁচে থাকলে খুশিতে সবাইকে শীতল ঘোষের চমচম কিনে খাওয়াত। বেঁচে নাই সেটাই ভাল হয়েছে। কাফনের কাপড়ে লজেন্সের মতো মুড়িয়ে ছোট্ট নাতিকে কবরে রাখতে তার জান বের হয়ে যেত। কিভাবে যে কবরে দুই মুঠি মাটি ছিটিয়ে দিত তা ভেবে হাসমত আলী যে বেঁচে নাই সেজন্য আল্লাহর কাছে মনেমনে শুকরিয়া আদায় করে আছিয়া – আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যেই করে।
পুটলার মতো লাশ খাটিয়ায় করে সমাজের গোরস্থানে নেয়ার সময় সিতুলির গগনবিদারী চিৎকারে পাথরের বুকেও যেন হাহাকার উঠে। হায়রে মা! মায়ের মতো আপন কেহ নাইরে! দুইদিন মাত্র বেঁচে ছিল ইকবাল। সে হিসেবে মা ছেলের সম্পর্ক ঠিক-ই দশ মাস বারো দিনের৷ সিতুলির বড় বোন রুবিয়া ইকবাল নামটি রেখেছিল। বাংলা ছবির নায়ক জাফর ইকবালের মতোই নাকি দেখতে হয়েছিল। গোলগাল ভরাট চেহারা। শুধু উপরের ঠোঁটটা কাটা। দুধ দাঁত উঠলে তিনটা দাঁত দেখা যেত৷ ছটিঘরে ইকবালের নাড়ঁ কাটার সময় আছিয়া খাতুন বারান্দায় বসে থাকা সিতুলির শ্বাশুরীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিল, “ঠোঁট কাটা তো কি হইছে? সোনার আংটি বাঁকাও ভালো।“ কিন্তু সোনার আংটি পরার ভাগ্য কারও হল না। দুইদিনের মাথায় হাসতে হাসতে ইকবাল চলে গেল। কাফনের কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকার সময় মনে হচ্ছিল ও হাসছে। ঠোঁট কাটা তাই এরকম মনে হচ্ছিল। বিধাতা সিলমোহর মারা স্থায়ী হাসি দিয়েছিল কিন্তু আয়ু দেয়নি।
ইকবালের মৃত্যুর বছর তিনেকের মাথায় জন্ম নেয় সিতুলির দ্বিতীয় ছেলে। এবারও বাংলা সিনেমার আরেক নায়কের নামে নাম রাখে রুবিয়া। নায়ক ওয়াসিম। উঁচা লম্বা চওড়া বুক। সুপুরুষ। ছেলেটাও হয়েছে রাজপুত্রের মতো। বিধাতা যেন ঠোঁটকাটা ইকবালের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছে ওয়াসিমের মধ্যে। আছিয়া নাতির মুখের দিকে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। নাক চোখ মুখ ঠোঁট সব নজর করে দেখে। খুশির ঝিলিক চমকে উঠে তার চোখে মুখে। গোবরে পদ্মফুল! রাজার ঘরের জিনিস ফকিরের ঘরে পাঠাইছে আল্লায়। এখন আল্লাহর মাল আল্লায় রাখলেই হইল। সারাক্ষন দুশ্চিন্তা নিয়ে আদর যত্ন করতে থাকে আছিয়া খাতুন। আল্লাহ যেন তার নাতিটারে হায়াত দারাজ করে।
নাতি নাতনীদের দেখভাল দাদা দাদীর চেয়ে নানা নানীরাই বেশি করে৷ এটাই যেন নিয়ম৷ ওয়াসিমের নানা নাই, নানীকেই সব ঝামেলা একা সামলাতে হয়৷ আছিয়ার আজকে যেতে হবে ইসাক ফকিরের বাড়িতে৷ ওয়াসিমের শরীর দিনতিনেক ধরে ঠিক নাই৷ মাগরেবের আজানের পরপরই নাতিটা চোখ উল্টায়ে বাড়িঘর মাথায় তুলে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়৷ আছিয়ার ধারণা কুনজর লাগছে৷ মানুষের না ভূতপ্রেতের৷ অনেকবার বলার পরেও সিতুলি তার নাতিটাকে কোলে নিয়ে গিয়ে বসেছিল কাশী বেপারীর বাড়ির পাশের তেঁতুল গাছের নিচে৷ গাছটাতে চুল প্যাঁচানী থাকে৷ সবাই সেটা জানে৷ সিতুলি কোন আক্কেলে তেঁতুল গাছের নিচে পোলারে নিয়ে গেল সেটা নিয়ে ঘন্টাখানেক মেয়ের সাথে গজগজ করল আছিয়া ৷ যাবি যা তুই একলা যা, আমার নাতিটারে নিয়ে গেলি কেন৷
তেঁতুল গাছের কাছেই একটা বড় পুকুর ছিল এক সময়৷ পরে পুকুর ভরাট করে মসজিদ বানায় পাড়ার লোকজন৷ সেই পুকুরের পাতালপুরীতেই থাকত চুল প্যাঁচানী৷ সন্ধ্যাবেলায় কেউ পানিতে নামলেই পায়ে চুল পেঁচিয়ে ডুবিয়ে মারে। সকালবেলায় শুধু কপালপোড়া মানুষটার মাথার চুল ভাসতে দেখা যায়। বিকেলবেলায় বউঝিরা সারাদিনের কাজ শেষে পুকুরে নাইতে যায়। একদিন ফইটকার বউয়ের বাড়ির কাজ সারতে সারতে একটু বেশিই সন্ধ্যা হয়ে যায় , যাকে বলে কালী সন্ধ্যা। “আইজকা আর পুকুর পাড়ে যাইস না বউ”,পাশের বাড়ির চাচি চেঁচিয়ে বলেছিল। “কাইলকাও কাজকর্মের জন্যে নাইতে পারি নাই চাচি, এক ডুব দিয়াই চইলা আহুম।“ যা গিয়া ডুইবা মর। চাচি মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিল।
এশার আজান পড়ে গেলেও বউ বাড়ি ফিরে না দেখে ফইটকা পুকুর পাড়ে যায়। কেউ নাই সেখানে। সাবানদানী আর সুবা পড়ে আছে ঘাটে। ফইটকা চিৎকার করে সবাইকে ডাকে। কিন্তু রাতের বেলায় কেউ পুকুরে নামতে সাহস করে না। “কতবার কইলাম আজকে আর নাইয়া কাম নাই তোর, বেলা অইয়া গেছে, আমার কথা হুনল না !” সেই চাচি আক্ষেপ করে বলে। ফইটকার আর মন মানে না। ঝাঁপ দেয় পুকুরে। অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও ফইটকা আর ডুব থেকে উঠে না। হইচই আরও বেড়ে যায়। দুই তিনজন দৌড়ে গিয়ে বাড়ি থেকে ঝাঁকি জাল নিয়ে আসে। কিন্তু জালে শুধু উঠে আসে কাঁদা আর ইঁচা মাছ। “ফইটকা আবার ঝাপ দিতে গেল কেন? পোলাপানগুলা এতিম হইল। সাথে বুড়া বাপ মা-ও।“ রজ্জব ডাক্তার আফসোস করে বলে উঠে। এখন খুঁজাখুঁজি করে লাভ নাই। ফজর ওয়াক্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আস্তে আস্তে সবাই পুকুর পাড় থেকে চলে যায়। এর আগেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। পাড়ার মানুষজনের কাছে ব্যাপারটা যে একদম নতুন তা নয়। তাই আহাজারি আর উত্তেজনা কমতে সময় লাগে না বেশি। তবে এবার দুই দুইজন মানুষকে একসাথে পাতালপুরীতে টেনে নিয়ে গেল চুল প্যাঁচানী ডাইনীটা৷ তাও আবার জামাই বউ। এরকমটা আগে কখনও হয়নি। সারারাত ফইটকার বাড়ি থেকে মরাকান্না ভেসে আসতে থাকে। কান্নার সাথে সাথে সমানতালে চলে চুল প্যাঁচানীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ। ফজরের আযান না পড়া পর্যন্ত থামে না সে গালির বান। আলো ফুটলে সবাই জড়ো হয় পুকুর পাড়ে। চুল দিয়ে মোড়ানো দুইটা মাথা আকাশের দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে। চোখ আর নাক ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
এই ঘটনার পরেই গ্রামের মুরুব্বিরা সালিশ করে সিদ্ধান্ত নেয় পুকুরটা ভরাট করে সেখানে একটা পাঞ্জেগানা মসজিদ করার। সবাই তাতে সায় দেয়। শুধু পুকুরের মালিক ঘটু বেপারী বেঁকে বসে। “মসজিদ বানাতে চান বানান। আমার তাতে আপত্তি নাই। আপত্তি থাকার কথাও না। তবে পুকুর কিনে তারপর বানান। আমি জমি দান করতে পারব না। তাছাড়া পুকুর ভরাট করার খরচপাতিও আছে।“ ঘটু বেপারীর বক্তব্যের সারকথা বুঝতে পারে রজ্জব ডাক্তার। “তুমি জমিটা দান করলে পুকুরটা সবাই গায়ে গতরে খাইটা ভরাট কইরা দিব। মাটির অভাব অইব না। খাল থেকে মাটি আইন্যা পুকুরে ফেলব। তাছাড়া মাটি কাটার সর্দার রিয়াজকে কইলেও হাজি কোঁদাল দিয়া সাহায্য করব। তুমি শুধু আল্লাহর ওয়াস্তে জমিটা দান কর মসজিদের নামে।“ এসব কথায়ও যখন ঘটু বেপারী রাজি হয় না রজ্জব ডাক্তার কথাটা বলবে না বলবে না করেও বলে ফেলল, “আচ্ছা সবাই যদি মত দেয় তাহলে মসজিদের নামটা তোমার পছন্দমতোই হইব।“ এবার ঘটু বেপারী নড়েচড়ে বসে। তার অনেকদিনের ইচ্ছা বাপের নামে একটা মসজিদ মাদ্রাসা দেবে। হউক না সেটা পাঞ্জেগানা মসজিদ। চুল প্যাঁচানীর পাতালপুরী চাপা পড়ে যায় চাকলা চাকলা মাটির নিচে।
কিন্তু মসজিদ দিয়েও চুল প্যাঁচানীর অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়া গেল না। চুল প্যাঁচানীর উপদ্রব যেন আরও বেড়ে গেল। ঘটু বেপারীর নাতিন মিনি একদিন স্কুল থেকে তেঁতুল গাছের নিচ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ “ও মাগো আমার চুল ছিড়া ফালাইলোগো” বলে চিৎকার শুনে দৌড়ে যায় মিনির নানী। “ওই ছেরি কি অইছে? গলা ফাটাইয়া চিল্লাস ক্যান।“ মিনি দৌড়ে গিয়ে নানীকে জড়ায়ে ধরে। “নানীগো কে জানি আমার চুলের বেনী ধইরা উপর থেকে টান মারছে“। “কি কস তুই? কাশীর নাতি মনে অয় তোর হাথে জাইরামি করছে”। “ওরে আমি কোনহানে দেহি নাই নানি, বিশ্বাস কর উপর থেকে কে জানি টান মারছে”। ঘটু বেপারীর বউয়ের বিষয়টা আন্দাজ করতে দেরি হয় না। এটা চুল প্যাঁচানীর কাম।
“গেদা পোলাহানরেও ছাইড় দিতাছে না!” ঘটু বেপারীর বউ আছিয়া খাতুনের কাছে শঙ্কা প্রকাশ করে। “তোমার নাতিরে ওই প্যাঁচানীই ধরছে”। এরকম রাজপুত্রের মতো নাতি। প্যাঁচানীর নজর লাগতেই পারে। দক্ষিণপাড়ার লাচ্চুর মা-র নাকি প্যাঁচানীর চুল ছাড়াও ওর গতর দেখার ভাগ্য হয়েছিল। শরীরের রঙ নাকি ভেড়ার পশমের মতো সাদা আর হাত পা বাচ্চা ছাগলের মতো চিকন চিকন। বয়স লাচ্চুর বউয়ের মতোই। ম্যাট্রিক পাশ বউ লাচ্চুর। চুল প্যাঁচানীর বয়সের কোন গাছপাথর নাই। চিকন চিকন হাত পা দেখে লাচ্চুর মা কম বয়সের মেয়েছেলে ভেবেছিল। লাচ্চুর মা-কে পাড়ার সবাই ভুট্টি নামে এক ডাকে চিনে। তিমি মাছের মতো শরীর। এই তিমি মাছের শরীরের কারনেই বোধহয় সেদিন প্যাঁচানীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল ভুট্টি। পায়ে কিছু একটা টের পেতেই গড়ানি দিয়ে ঘাটে শুয়ে পড়েছিল। হাতি পড়ার শব্দ শুনে ম্যাচের খাপ খেলা বাদ দিয়ে ছুটে এসে হাতির খেলা দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিয়েছিল পাড়ার পোলাপানেরা। পাশে পড়ে থাকা আলমের এক নম্বর পঁচা সাবানের দলা ছুঁড়ে মেরে ভুট্টি বলেছিল, “মরার পোলাপানেরে ধরে না ক্যান প্যাঁচানী ! প্যাঁচানীর পোলাপান চোহে পড়ে না, পড়ে শুধু বুইড়া বুড়ি”। ভুট্টির সেদিনকার কথা প্যাঁচানী যে মনে রেখেছিল আর ঘটু বেপারির নাতিন মিনির চুলের বেনি ধরে টান মারার ঘটনা নেহায়েত কাকতালীয় নাও হতে পারে।
আছিয়া ঘটুর বউয়ের কথা শুনেই ইসাক ফকিরের বাড়িতে যাওয়ার চিন্তাটা করে। ইসাক ফকিরের বাড়ি শ্মশানঘাট পার হয়ে কয়েকটা বাড়ি পরেই। দিনের বেলায় ইসাক ফকিরকে পাওয়া যায় না। ক্ষেতেখামারে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আসল ফকিরি করে ইসাক ফকিরের বউ। দোলেচা বানু। ইসাক ফকির জিনিসপত্র জোগাড় যন্তর করে দেয়, চৌরাস্তার ধুলা, শিমুল গাছের শিকড়, জাফরান কালি, কালীঘাটের ছাই ভস্ম, তাবিজ কবজ আরও নানা জিনিস। একেক চিকিৎসার জন্য একেক জিনিসের ফর্দ।
ঘরের কোণায় মাটির আসনে গভীররাতে ধ্যানে বসে ইসাক ফকিরের বউ। তার একটা পালাপোষা জ্বীন আছে। এই জ্বীন দিয়েই ফকিরি চিকিৎসা চালায় দোলেচা বানু।
বাজারে ইসাক ফকিরের সাথে দেখা করে সিতুলির জামাই জয়নাল। জয়নাল ছেলের চোখ উল্টায়ে কান্নাকাটি আর তেঁতুলগাছের নিচে সিতুলির বসে থাকার ফিরিস্তি দেয়। শ্বাশুরি আছিয়া খাতুনের শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়া কথাগুলো নিষ্ঠার সাথে বলে যায় জয়নাল মিয়া। “সন্ধ্যার পর বাড়িতে পোলারে নিয়া আইসো। সাথে করে এক ডজন মোমবাতি আর এক প্যাকেট আগরবাতি আইনো। সোয়া কেজি মিষ্টিও আইনো।“ ইসাক ফকির এক কথা হাজারবার বললে যেরকম শোনায় সেরকম স্বরে কথাগুলো বলে জয়নালকে।
দিনের বেলায় আসনে বসে না দোলেচা বানু। দিনের কাজ দিনে, রাতের কাজ রাতে। মানুষের সময় আর জ্বীনদের সময় আলাদা। জাহেরি আর বাতেনির ভেদ আছে। সন্ধ্যার পর সিতুলি, আছিয়া, জয়নাল আর রুবিয়া রওনা হয় ইসাক ফকিরের বাড়ির দিকে। শ্মশানঘাটের বটগাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় গা ছমছম করে উঠে সবার। কেউ যেন বাধা দিতে চাইছে তাদের। যেতে দেবে না ইসাক ফকিরের বাড়ি অব্দি। জয়নাল হঠাৎ বটগাছের শিকড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। আছিয়া খাতুন জোরে জোরে “হক ওয়ারিছ, হক ওয়ারিছ” জপঁতে থাকে। পাশের গ্রামের ওয়ারেছি মাজারের মুরিদ আছিয়া। বিপদে আপদে এই নাম জঁপলে খাকছার পীরসাহেব সব বিপদ দূর করে দেয়। পীরের নাম খাকছার আউলিয়া।
ধানখেতের আইল ধরে হেঁটে ইসাক ফকিরের বাড়ির দুয়ারে পা দিতেই গোঙ্গানীর আওয়াজ শোনা যায়। আজকে আগেভাগেই আসনে বসেছে ইসাক ফকিরের বউ দোলেচা বানু।
ইসাক ফকির সবাইকে বারান্দার কাঠের বেঞ্চে বসায়। সামনে দুয়ার, চারপাশে আম জাম কাঁঠালের গাছ দিয়ে ঘেরা। পাটখড়ির বেড়া আর টিনের চাল দেয়া একটামাত্র ঘর। উঠানের একপাশে রান্নাঘর। রান্নাঘরে কুপি জ্বলছে কিন্তু রান্নাবান্নার কোন ব্যাপার নাই। ইসাক ফকির চাপকল থেকে সবাই্কে অযু করে আসতে বলে। জ্বীনরা নাপাকি পছন্দ করে না। জয়নালের হাত থেকে মোমবাতি আর আগরবাতি নিয়ে ঘরে ঢুকে ইসাক ফকির। অযু করে ঘরে ঢুকে সবাই অবাক হয়ে দেখে এর মধ্যেই একটা কাঠের টুলে বারোটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে ইসাক ফকির। মোমবাতিগুলো সমান তেজে জ্বলে যাচ্ছে। একটা টিনের প্লেটে চাউল দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছে আগরবাতি। ঘরে মোমবাতির আলো ছাড়া আর কোন আলো নাই। ইসাক ফকির ইশারা করতেই সবাই কাঠের টুলের তিন দিকে নামাজের সুরতে বসে যায়। বাঁশের মাচার এক কোণায় সবুজ কাপড় দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা। সেখানেই মাটির আসনে বসে আছে দোলেচা বানু। দোলেচা বানুকে না দেখেই সবাই আন্দাজ করতে পারল। কাপড়ের আড়াল থেকে একটু পরপরেই বিড়বিড় আওয়াজ আসছে, যেন কারও সাথে কথা বলছে দোলেচা বানু। “যা, তুই নিম গাছে গিয়া বইয়া থাক, পরে ডাক দিমু”। সবাই চমকে উঠে এদিক সেদিক তাকায়। কথাগুলো যেন কোন এক পাতালপুরীর গভীর থেকে কাঁপতে কাঁপতে উঠে এল জমিনের উপর। কারও বুঝতে বাকি থাকে না। গৃহপালিত জ্বীনটাকে হুকুম করছে তান্ত্রিক দোলেচা বানু।
আসন থেকে উঠে ঘুমন্ত মানুষ যেভাবে হাটে সেভাবে হেঁটে এসে মোমবাতিসহ কাঠের টুলটাকে সামনে রেখে বসে পড়ে দোলেচা বানু। আছিয়া যেন চিনতেই পারে না তাকে। রাস্তাঘাটে অনেকবার দেখা হয়েছে। কিন্তু এখন যেন চেহারা একদম বদলে গেছে। কালচে চেহারার দোলেচা বানুর মুখ যেন নুরা্নী হয়ে গেছে, কপাল ফুলে গেছে। শুরু থেকেই চোখ বন্ধ করে আছে দোলেচা আর ডানে বামে একটু একটু করে দুলছে। ভাবে আছে জ্বীনের মালেকীন। ভাব আছে যার গায় দেখলে তারে চেনা যায়। আজকে বাজার থেকে শোনে আসা গানের কলি জয়নালের মাথায় বাজতে থাকে।
আসমান জমিনের সব জ্ঞান এখন দোলেচা বানুর বুজে থাকা চোখের মধ্যে। চোখ খুললেই টুনটুনি পাখির মত উড়ে যাবে। চোখ খোলা যাবে না। ইসাক ফকির এক টুকরা কাগজ দোলেচা বানুর হাতে দেয়। জাফরান কালিতে রোগীর নাম লেখা। ওয়াসিম। কাগজ হাতে নিতেই মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে থাকে দোলেচা বানু। সবাই ভয় পেয়ে যায়। ইসাক ফকির সবাইরে আশ্বস্ত করে। ভয়ের কিছু নাই। কোহেকাফ নগরের সাথে বাতচিত হচ্ছে। জ্বীনদের নগরী। রোগের সমাধান জানতে পারলেই কাঁপুনি থেমে যাবে। কিন্তু কাঁপুনি যেন থামতেই চায় না। কঠিন রোগ মনে হয়। জ্বীনরাও হিমশিম খাচ্ছে।
“তর পোলারে জ্বিনের আছর করছে। বদ জ্বীন। এলেমহীন জ্বীন। এই জ্বীন খেদাইতে না পারলে তর পোলা সারাজীবন গোমুর্খ হইয়া থাকব। বইপত্র গুলাইয়া খাওয়াইলেও পরীক্ষায় পাশের মুখ দেখব না। বই পত্র দেখলেই চোখ উল্টাইয়া খালি চিক্কুর পারব। মাকাল ফল অইব। চেহারা সুরত সুন্দর কিন্তু ভেতরে ছাই”। কথাগুলো শেষ করে দোলেচা বানু চোখ বন্ধ করেই কয়েক মূহুর্ত আছিয়ার কোলে ঘুমন্ত ওয়াসিমের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ বন্ধ করেও দোলেচা যেন সব দেখতে পাচ্ছে। তার বুজে থাকা চোখের পাতা ফুলেফুলে উঠছে।
“উপায় কি তাইলে?” ভয়ে ভয়ে বলে উঠে আছিয়া।
“এই এলেমহীন জ্বীনরে ভোগ দিতে অইব। ভোগ দিয়া খুশি করন গেলে ও তর পোলারে রেহাই দিব। এই জ্বীনের প্রিয় খাদ্য বকরির দুধ। সোয়া সাত কেজি বকরির দুধ দিয়া মিঠা শিরনী রানবি। সেই শিরনী একটা কাঁসার পাতিলে ভইরা নতুন একটা গামছা দিয়া মুখ বাইন্ধ্যা মঙ্গলবার কইরা অমাবস্যা রাইতে ক্ষেতের চার আইলে যেহানে অনেক জংলা কঁচু্ গাছ আছে ঐহানে রাইখ্যা আসবি। সাথে করে এক কলস কাচা দুধ নিবি। আর পা বাইন্ধ্যা তিনটা ডিমপাড়া মুরগি নিবি। তিনজনের বেশি যাবি না। কেউ যেন তোদের যাইতে না দ্যাহে আর পোলারে দিবি একজন মর্দ মানুষের কোলে। ভোগ দিয়া পোলারে কলসির দুধ দিয়া গোসল করাইয়া এক হাঁটায় বাড়ি ফিরা আইবি। খবরদার পেছন ফিরা একবারও চাইবি না কইলাম।”
একদমে এসব কথা বলেই দোলেচা বানু মেঝেতে নেতিয়ে পড়ে আর দপ করে সবগুলো মোমবাতি একসাথে নিভে যায়। কোহেকাফের সাথে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সবাই একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। কিন্তু কার মুখে কি অভিব্যক্তি তা ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে বুঝার উপায় থাকে না। রান্নাঘরের কুপির আলো তিরতির করে খড়ির বেড়ার ফাঁক গলে ভেতরে আসছে। অন্ধকারটা চোখে একটু সয়ে আসতেই সিতুলি ও মাগো বলে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ইসাক ফকির বলে উঠল, আরে আমি আমি ডরাইও না। ইসাক ফকির রান্নাঘরের কুপিটা ভেতরে আনতে যাওয়ার সময় সিতুলির শরীরে ধাক্কা লাগে। সিতুলি জ্বীনে ধাক্কা দিয়েছে ভেবে মূর্ছা যায়।
কুপির আলোয় দোলেচা বানু আছিয়া খাতুনের সেই চিরচেনা দোলেচা বানু হয়ে ধরা দেয়। বাজারের হারাণ পাইন্যার দোকানে প্রায়শই দেখা সাক্ষাত হয় তাদের। দুইজনেরই পান খাওয়ার অভ্যাস। একবেলা ভাত না খেয়ে থাকতে পারলেও পান না খেয়ে এক ঘন্টাও চলে না।
“কেমন আছ আছিয়া বু”?, গায়ের কাপড় আর গোমটা ঠিক করতে করতে বেশ আন্তরিকতার সাথেই জিজ্ঞেস করে দোলেচা বানু।
“ভালই তো আছিলাম, নাতিটারে নিয়া বিপদে পইড়া গেছি।“
“চিন্তা কইরো না। সব ঠিক হইয়া যাইব। ব্যবস্থা হইছে। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ শাফি আল্লাহ কাফি।“ কথা শেষ করেই পানের পুটলা বের করে দোলেচা। দুই খণ্ড পান বানিয়ে নিজে এক টুকরা মুখে দেয় আরেক টুকরা বাড়িয়ে দেয় আছিয়াকে।
এক গ্লাস পড়া পানি খেয়ে সিতুলি এখন বেশ ধাতস্থ। ইসাক ফকির নিজেও কিছু ঝাড়ফুঁক জানে। সবাই ফকির ফকির বলে ডাকে। টুটকা কিছুটা না জানলে চলে না।
“চিন্তা কইরো না, কালকে একটা ডিম পইড়্যা দিমনি, খালি পেটে খাইব্যা।“ সিতুলিকে অভয় দেয় ইসাক ফকির।
“আজকে উঠি তাইলে।”পানের রস ঢুক গিলেই আছিয়া বলে উঠে।
“দেইখ্যা শুইন্যা যাইও। একটা কথা, গাছের ডালপালা ভাঙ্গার শব্দ শুনলে ভয় পাইও না৷”
আছিয়া কোন কথা না বলে মাথা দোলায় শুধু৷ এলেমহীন বদ জ্বীনটা ক্ষেপে গেছে৷ তাকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ ডালপালা ভেঙ্গে রাগ প্রকাশ করবে৷ কিন্তু ভয়ের কিছু নাই, কোন ক্ষতি করতে পারবে না৷ দোলেচা বানু সে ব্যবস্থা করেছে৷
ইসাক ফকির বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয় সবাইকে৷ “বটগাছটা পার কইরা দিয়া আহেন কাক্কু”, ভয়ে ভয়ে সিতুলি বলে৷ “বাড়িতে তোমার চাচি একা৷ ডরের কিছু নাই”, বলেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে কয়েক কোয়া রসুন বের করে সবার হাতে এক কোয়া করে দেয় ইসাক ফকির৷ রসুন সাথে থাকলে ভয় নাই, পড়া রসুন৷ সিতুলি আছিয়া আর রুবিয়া কাপড়ের আঁচলে বেধে নেয় রসুনের কোয়া৷ জয়নাল মিয়া বুক পকেটে রসুন রেখে বিড়ি ধরায়৷ ভূত প্রেত জ্বীন জানোয়ার আগুন ভয় পায়৷ কিন্তু বটগাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় ঠিকই সবার গা ছমছম করে উঠে৷ আচমকা মট করে বটগাছের ডাল ভাঙ্গার শব্দ হতেই সবাই সমস্বরে “হক ওয়ারিস, হক ওয়ারিস” করতে করতে কোনমতে শ্মশানঘাট আর বটগাছ পাড়ি দেয়৷
ফজরের ওয়াক্ত থেকে শুরু হয় জ্বীনের জন্য ভোগের জোগাড় যন্তর। সিতুলির কাঁসার কলস নাই। আশেপাশে ঘটু বেপারীর বাড়ি ছাড়া কারও বাড়িতে কাঁসার কলসি পাওয়া যাওয়ার কথা না। কলসি চাইতে ঘটু বেপারীর বাড়ি যায় আছিয়া। ঘটুর ছোট ছেলে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে, কাঁসার কলস দিয়ে কি করবেন চাচি? আছিয়া খাতুনের জ্বীন ভূতের বিষয়টা নিয়ে কিছু বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। আবার এই সাঁঝ সকালে মিথ্যা কথা বলতেও তার মন সায় দেয় না। দুই চার কথায় আছিয়া লম্বা কিচ্ছা শেষ করে। “তোমরা যে কি করো না চাচি?” কিছুটা রাগতস্বরেই বলে জ্বীন ভূতে অবিশ্বাসী ফরহাদ। রোগ ব্যাধির জন্য ডাক্তার। তাবিজতুমার, ফকির কবিরাজি সব ভাঁওতাবাজি। এসব বাদ দিয়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ কেন্দ্রের জাকির ডাক্তারের কাছে ওয়াসিমকে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে পুরাতন একটা হিরো সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যায় ফরহাদ। ফরহাদ ইন্টার পরীক্ষা শেষ করে এই পাড়ায় ওই পাড়ায় ছাত্র ছাত্রী টিউশনি পড়ায়। টিউশন মাস্টার হিসেবে সে ভালই জনপ্রিয়। সপ্তাহে একদিন করে হাইস্কুলেও ক্লাস নেয়। প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব স্যারকে ঘটু বেপারী অনুরোধ করে ছেলের জন্য এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এতে করে ফরহাদের টিউশনির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। আর বেণীমাধব স্যারও রাজি হয়ে গিয়েছিল। স্কুলে শিক্ষক সংখ্যা কম। অবৈতনিক একজন শিক্ষক পেয়ে বেণীমাধব স্যারও খুশি। তবে ইন্টার পরীক্ষা দেয়া একজনকে দিয়ে সিক্স সেভেন ছাড়া অন্য ক্লাস নিতে উনি রাজি হননি।
নামেই স্বাস্থকেন্দ্র আর ডাক্তার! স্যালাইন আর নাপা ট্যাবলেটের পাতা ছাড়া কিছুই দেয় না। জাকির ডাক্তাররে তো পাওয়াই যায় না, কম্পাউন্ডার দীলিপের হম্বিতম্বি দেখে একবার যে যায় সে আর দ্বিতীয়বার যায় না। সূর্যের চেয়ে বালির উত্তাপ বেশি, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত। দীলিপ কম্পাউন্ডার বাজারের ওষুধের দোকানে স্বাস্থকেন্দ্রের ওষুধপত্র বিক্রি করে দেয় তা প্রায় সবার জানা। জেনেও কিছু বলার থাকে না। ডাক্তার কম্পাউন্ডার মিলে গেলে রোগীদের আর কিইবা করার আছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে আছিয়া কলস হাতে বাড়ির দিকে হেঁটে যায়।
পশ্চিম পাড়ার কবরস্থানের পাশে জংলা কচুগাছে ভরা একটা জায়গা পাওয়া গেছে। রুবিয়ার স্বামী খবরটা দিয়েছে জয়নালকে। জায়গাটা আশেপাশের বাড়িঘর থেকে বেশ দূরে। শিয়াল দিয়ে ভরা। সন্ধ্যা হতেই মাগরেবের আজানের সাথে হুক্কা হুয়া করে উঠে। কুকুরগুলোও গলা মেলায়। তখন জায়গাটাকে কাছেই মনে হয়। রাতের বেলায় দূরকে নিকট আর নিকটকে সুদূর মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সারাদিন কেটে যায় বকরির দুধ, মুরগি কেনা আর শিরনী রান্না করে। বেশ অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার। আচমকাই এই খরচের ব্যাপার ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে। কিন্তু ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ধার দেনা করতেও পিছপা হয় না জয়নাল। শুধু ভ্যানে খ্যাপ মেরে ধার দেনা শোধ করা যাবে না। রিয়াজ সর্দারের দলের সাথে মাটিও কাটতে হবে। সিতুলিকেও সাথে নিতে হবে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাখে জয়নাল। কিন্তু তারপরও ছেলেটার ভবিষ্যত যেন বদ জ্বীন নষ্ট করতে না পারে। লেখাপড়া না শিখে ছেলে আইলা জাইলা কামলা হইলে তার কষ্টের টাকা পয়সা থাকলেই কি না থাকলেই কি।
এশার নামাজের পর সব শুনশান হয়ে আসে। ভোগের জিনিসপত্র শেষবারের মতো গুছিয়ে নেয় সবাই মিলে। সিদ্ধান্ত হয় আছিয়া সিতুলি আর জয়নাল যাবে। তিনজনের বেশি যাওয়া যাবে না। জয়নালের কোলে থাকবে ওয়াসিম। আছিয়া আর সিতুলি কাঁখে করে নেবে শিরনী আর দুধের কলস। হাতে থাকবে পা বাঁধা মুরগি।
ক্ষেতের আইল ধরে হাটতে গিয়ে কয়েকবার পা পিছলে পড়ে যেতে নেয় আছিয়া। জ্বীনে ধাক্কা দিতাছে, সিতুলি ভাবে। কোলে ছেলের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে জয়নাল বুঝতে পারে ওয়াসিম ঘুমায়ে গেছে। ঘুমন্ত ছেলেকে কিভাবে দুধ দিয়ে গোসল করাবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় জয়নাল।
গোরস্থানের কাছাকাছি যেতেই সবার গা ছমছম করে উঠে। অন্ধকার এদিকে একটু বেশিই গাঢ় বলে মনে হয়। বেতগাছ আর জিকাগাছ গোরস্থানের অন্ধকারকে আরও ঘন করে রেখেছে। একটু পরপর শুকনো পাতার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার শব্দ শোনা যায়। শিয়ালরা তাদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে, আছিয়া আর জয়নাল এটা বুঝলেও সিতুলি যথারীতি জ্বীনদের পায়চারী ভাবে এসব্কে। সিতুলি বারবার উদ্বিগ্ন হয়ে জয়নালের দিকে তাকায়। জ্বীনরা এই বুঝি তার ছেলেকে ছুঁ মেরে নিয়ে গেল, পোলাটার ভাল করতে গিয়ে মনে হয় জানটাই যাবে। বিদ্যাবুদ্ধি না থাকলে নাই কিন্তু জানটা তো বেঁচে যেত। কবিরাজির জোরে জ্বীনরা কিছু না করতে পারলেও শিয়ালের পেটে যাবে মনে হয় তার ছেলে।
জংলা কচুঁ ক্ষেতের কাছে চলে আসে সবাই। অন্ধকারে কচুক্ষেতটাকে ওঁত পেতে থাকা দানবের মতো মনে হয় সিতুলির। ছেলেকে নিজের কোলে নেয়ার জন্য মন অস্থির হয়ে যায়। কিন্তু সে পুরুষ মানুষ না। ছেলেকে মর্দ মানুষের কোলে রাখতে হবে। দোলেচা বানুর আদেশ। “আর দেরি কইরো না। তাড়াতাড়ি শিরনী আর মুরগি রাইখ্যা ওয়াসিমরে দুধ দিয়া নাওয়াও”। আছিয়া খাতুন জয়নালকে তাড়া দেয়। ঘন অন্ধকারে কার মুখে কিসের চিহ্ন বুঝার উপায় নাই, শুধু মুখের কায়া দেখা যায়। সবাই যেন ছায়া হয়ে গেছে। এতসব আয়োজন যার জন্যে সেই ওয়াসিমও এক ঘুমন্ত ছায়া। ঘুমন্ত ছায়ার উপর দুধ ঢেলে দিতেই হাত পা ছুঁড়ে মোচড় দিয়ে অন্ধকার ভেদ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় ছায়াটি। গোরস্থানের ভেতর খচমচ আওয়াজ বেড়ে যায়। শিয়ালের বাচ্চারা যেন ওয়াসিমের কান্না নকল করে কেঁদে উঠে। মানুষের বাচ্চার কান্না আর শিয়ালের বাচ্চার কান্নার মধ্যে পার্থক্য করার উপায় থাকে না।
পরেরদিন সকাল যেন এক নতুন সকাল। বদ জ্বীনের কুনজর নাই, ওয়াসিমের শিক্ষাদীক্ষা আর ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা নাই। ছেলেটা এখন শিমুলগাছের মতো তড়তড়িয়ে বেড়ে উঠবে, বড় হয়ে তাদের দুঃখ ঘুচাবে। ওয়াসিম চোখ উল্টিয়ে বারিঘর মাথায় তুলে কান্নাকাটি বন্ধ করলেও জ্বর কাশি লেগেই থাকে। বাচ্চাদের এরকম হয় এই কথা মেনে নিতে চায় না আছিয়া আর সিতুলি। কিছু হলেই সন্ধ্যার পর ছুটে যায় দোলেচা বানুর কাছে। তাবিজ কবজ আর পড়া পানি নিয়ে ফিরে আসে আছিয়া। ওয়াসিম বড় হতে থাকে আর ওর হাত গলা কোমর ভরে যায় নানা রকমের তাবিজে। লোহার তাবিজ, রুপার তাবিজ, অষ্ট ধাতুর তাবিজ।
এসব তাবিজ আর ভোগের জোরেও ওয়াসিম যখন ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠতে পারল না তখন আছিয়া দোলেচা বানুর কবিরাজির যে পাওয়ার নাই তা পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে প্রচার করতে থাকে। আইয়ুব মেম্বারকে ধরে ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস সিক্সে উঠানোর ব্যবস্থা করেছিল জয়নাল। “ছেলেরে মন দিয়ে পড়তে কইও, আবার ফেইল করলে আমি কিছু করতে পারব না”। আইয়ুব মেম্বার বলে দিয়েছিল। সেভেনে উঠানোর ব্যাপারে কার কাছে যাওয়া যায়? ভাবনায় পড়ে যায় জয়নাল। সেই ক্লাস ওয়ান থেকেই টেনেটুনে পাশ। উপরের ক্লাসে উঠলে ঠিক হয়ে যাবে, বদ জ্বীনকে দেয়া ভোগের ফল পাওয়া যাবে, এসব ভাবনা ভাবতেও মন আর সায় দেয় না জয়নালের।
তাবিজ কবজ আর ভোগ তো আছেই! এই জোরে জয়নাল ছেলের খোঁজ খবর তেমন একটা রাখেনি। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মান্নু চকিদারের নাতির সাথে নসিমন আর ভটভটি চালিয়ে বেড়ায় ওয়াসিম, বিড়ি সিগারেট তো ধরেছেই মাঝেমাঝে অন্য জিনিসও খায়। বাজারের বাস স্ট্যান্ডে সব জিনিসের সাপ্লাই নাকি আছে। এই খবর যেদিন জয়নালের কানে আসে তার মনে পড়ে যায় সেই রাত্রির কথা। শিয়ালের কান্না আর মানুষের কান্না মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার রাত্রি। মনে পড়ে যায় সেদিনকার সকালের কথা, নতুন ভোরের কথা। সেই স্বপ্নের কথা। ছেলে তার বড় হবে তাদের দুঃখ ঘুচাবে।
ওয়াসিম ঢাকায় রেন্ট -এ-কারের মাইক্রোবাসের ড্রাইভারের চাকরিটা শুরু করলেও জয়নালের তাতে খুশি হওয়ার কিছু থাকে না। বিয়ে করে ওয়াসিম যেদিন আলাদা হয়ে যায় সেদিন থেকেই জয়নাল আর সিতুলি বুঝে গেছে এই ছেলে তাদের কোন কাজে আসবে না, খাওয়া খরচ দেয়া তো দুরের কথা বিপদে আপদে পাশে এসেও দাঁড়াবে না। এমন সন্তানও মানুষ পেটে ধরে! “কি এমন দুনিয়া উল্টায়ে দিছ আমার জন্যে?” ঝগড়া করতে করতে ওয়াসিম একদিন সিতুলিকে ঝাঁঝের সাথে বলেছিল। একদম কি কিছুই করে নাই তারা? জ্বীন আর শিয়ালে মেরে ফেলবে বলে দুশ্চিন্তায় কত রাত ঘুমায়নি সিতুলি, আছিয়া আর জয়নাল। ভোগের জিনিসপত্র কেনার টাকা শোধ করতে তিন বেলা মাটি কেটেছে আর ভ্যানে খ্যাপ মারতে মারতে পিঠটাই বাকা হয়ে গেছে জয়নালের। আরও কত মনে না থাকা জিনিস করেছে এই ছেলের জন্য। পিতামাতা সাধ্যমতো সব কিছু করে কিন্তু সেসব তাদের মনে থাকে না, মনে রাখে না। মনে রাখে না বলেই “কি এমন করছ আমার জন্য?”, ছেলেমেয়ের এরকম প্রশ্নের মুখে উত্তরহীন হয়ে যায় তারা। নিজের জ্ঞানে যা ভাল মনে করেছে সেটাই করেছে। ভুলও কিছু হয়েছে। না জেনে না বুঝে। ছেলেপুলে বড় হয়ে ক্ষমাহীন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় পিতামাতাকে।
ঘটু বেপারীর নাতিন মিনি বাপের বাড়িতে নাইয়র খেতে এসেছে। চুলে বেনীর জায়গায় খোঁপা। এই পাড়ায় ওই পাড়ায় ঘুরে বেড়িয়ে জয়নালের বাড়ির উপর দিয়ে বাড়ি ফিরে। “চাচি, ওয়াসিমের পোলা হইছে দেখতে যাও নাই?” সিতুলি মাটির চুলায় একটা কাঠের খণ্ড গুঁজে দিয়ে তাকায় ঘটুর নাতিনের দিকে। ওয়াসিম আলাদা হয়ে পাশের পাড়ায় থাকে। সিতুলিকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলে, “পোলা নাকি সন্ধ্যা হইলেই চোখ উল্টায়ে কান্নাকাটি করে বাড়িঘর মাথায় তুলে”। ঘরের বারান্দায় বসে থাকা জয়নালের সাথে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সিতুলি। আছিয়া খাতুন বেঁচে থাকলে তিনটি মুখ চাওয়াচাওয়ি করতো।