আরিফের বাড়ি হাড়িপাড়া গ্রামে৷ পাকুটিয়ার পাশেই৷ পাকুটিয়া বাজার থেকে দক্ষিন দিকে একটা ছোট ব্রিজ পার হলেই বইন্যাপাড়া গ্রাম৷ এই গ্রামের পরেই হাড়িপাড়া৷ আরিফের সাথে আমি লেখাপড়া করেছি ক্লাস ফোর থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত৷ আরিফ ব্র্যাক স্কুল থেকে ক্লাস থ্রি পাস করে পাকুটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়৷ সাথে আরো অনেকেই ভর্তি হয়৷ তাদের মধ্যে ছিল সাজ্জাদ, বায়েজিদ, নুর মুহাম্মদ, রেজাউলসহ আরো কয়েকজন৷ ব্র্যাক স্কুলের ছেলেমেয়েরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে ভালো হয় বলে সবার ধারণা আছে৷ তাই ব্র্যাক থেকে যখন এই এক ঝাঁক মেধাবী ক্লাস ফোরে ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্ররা আসলো তখন আমার একটু দুঃশ্চিন্তা হলো৷ আমার রোল নাম্বার বরাবর এক৷ এবার বুঝি আর রোল নাম্বার এক ধরে রাখা গেলো না!
তবে ধরে রাখতে পেরেছিলাম৷ আমার রোল নাম্বার এক-ই থাকলো৷ ক্লাস ফাইভে বায়েজিদের রোল নাম্বার হলো দুই৷ আরিফের তিন৷ আমি আর আরিফ এ সেকশনে৷ বিজোড় রোল নাম্বার তাই৷ বায়েজিদ বি সেকশনে৷ জোড় রোল নাম্বার৷ আমরা ক্লাস ফাইভ পাস দিয়ে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম পাকুটিয়া হাই স্কুলে৷ এবার আমি খেলাম ধরা৷ ফুপুর বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার ফল পেলাম৷ আমি সরাসরি ফুপুর বাড়ি নাগরপুরের কলমাইদ গ্রাম থেকে এসে ক্লাস সিক্সে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম৷ উলটা পালটা অবস্থা৷ ফলাফল বের হলে দেখলাম আমার ক্রমিক নাম্বার হয়েছে ১০৷ আর আমার বন্ধুরা সবাই আমার চেয়ে এগিয়ে৷
ফুফুর বাড়ি বেড়ানোর জন্য ডাব্বা মেরেছি পরীক্ষায় এটাকে অজুহাত হিসেবেও ভাবা যেতে পারে৷ পরীক্ষা খারাপ দিয়েছিলাম তাই ফলাফল খারাপ৷ হিসাবটা তাই হয় আর তাই হওয়া উচিত৷ কোন কোন ক্ষেত্রে দুই একটা কিন্তু থাকতে পারে৷ যাই হউক, আমার আব্বা একটা কথা সব সময় বলে৷ যাই করো না কেন, আসল জিনিস বুঝা যাবে রেজাল্টে৷ ক্লাস সেভেনে বুঝা গেলো আসল ব্যাপারটি৷ রোল নাম্বার দুই হয়ে গেলো৷ ক্লাস এইটেও আর উন্নতি হলো না৷ আবারও দুই৷ ক্লাস নাইনে উঠে আর দুই নাম্বার থাকলাম না,এক নাম্বার হয়ে গেলাম৷ তাও আবার অনেক নম্বরের ব্যবধানে৷
ক্লাস নাইনে আরিফের রোল নাম্বার ছিল চার৷ বায়েজিদের তিন৷ সাজ্জাদ ক্লাস সিক্সে গিয়ে ভর্তি হয় আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজে৷ ওর রোল নাম্বার ওখানে কতো হয়েছিল তা আমার জানা নাই৷ আরিফ ক্লাস ফাইভে বৃত্তি না পেলেও আমি পেয়েছিলাম৷ ক্লাস এইটে আরিফ সাধারণ বৃত্তি পায়, আমি পাই ট্যালেন্টপুলে৷ নাগরপুর থানায় নাকি প্রথম হয়েছিলাম আমি৷ যাই হউক আরিফের কথা বলি৷ আরিফ দেখতে কালো আর লিকলিকে৷ আমার মতোই৷ শুধু একটু কম লম্বা৷ হাতের লেখা চকচকে সুন্দর৷ গোটা গোটা অক্ষরে লিখে৷ অংকে অনেক ভালো৷ আমার চেয়েও৷ দুইজনেই বিজ্ঞান বিভাগ নিয়েছিলাম৷ উচ্চতর গণিতে আরিফ আমার চেয়ে সব সময় নাম্বার বেশি পেতো৷ অনুশীলনের উপপাদ্য নিজে নিজে সমাধান করতে পারতো৷ গাইডবই লাগতো না৷ ইংরেজিতেও ভালো ছিল আরিফ৷
এসএসসিতে আরিফ এ প্লাস পেলো না৷ কিন্তু ভালো রেজাল্ট করেছিল৷ ঐ বছর পাকুটিয়া হাই স্কুল থেকে আমি একাই এ প্লাস পেয়েছিলাম৷ ২০০৫ সালে৷ আমি ভর্তি হলাম ঢাকায় সরকারী বিজ্ঞান কলেজে৷ আরিফ ভর্তি হল পাকুটিয়া কলেজে৷ কিন্তু সেকেন্ড ইয়ার থেকেই ওর মাথায় কিসের একটা গন্ডগোল দেখা দিলো৷ লেখাপড়া ঠিকঠাকমতো করতে পারলো না৷ খারাপ জিপিএ নিয়ে এইচএসসি পাস করলো ঠিকই কিন্তু মাথা আরো বিগড়ে গেলো৷ এইচএসসির পর আর লেখাপড়া করা হয়ে উঠেনি আরিফের৷ আলাভোলা হয়ে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতে শুরু করে৷ মাঝেমাঝেই দা বটি নিয়ে নাকি ওর বাবাকে মারতে যায়৷ কাউকে তেমন চিনতে পারেনা৷ পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকে আর প্রশ্ন করে, “ক্যারা তুই?” আগে চেহারায় তীক্ষ্ণ একটা ভাব ছিল আরিফের৷ নাকের ডগায় সব সময় মুক্তার দানার মতো চকচকে ঘাম জমে থাকতো৷ ওর হাতের তালুও অনেক ঘেমে যেতো৷ একটু পরপর স্কুল ড্রেসের শার্টে হাতের তালু মুছে নিতো৷
লিকলিকে আর চেহারায় সপ্রতিভ ভাবওয়ালা সেই আরিফকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা৷ শরীরে পানি আসার মতো মোটা হয়ে গেছে আরিফ৷ চেহারা গোল হয়ে পুতিয়ে গেছে বলে মনে হয়৷ লুঙ্গি আর শার্ট পরে খালি পায়ে একমনে হেটে বেড়ায় আরিফ৷ দেখলে মনে হবে সামনে দূর থেকে অদৃশ্য কেউ ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ আশেপাশের কাউকে তেমন চিনতে পারে বলে মনে হয়না৷
বেশ কিছুদিন আগে আরিফের সাথে দেখা হয়েছিল চাচিতারা গ্রামে৷ হঠাৎ দেখা৷ আমাকে দেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো, “আফজাল”৷ আমাকে চিনতে পেরেছিল৷ তারপর একটু দাঁড়িয়ে থেকে “যাইগ্যা” বলে হন্তদন্তভাবে হাটা শুরু করে চলে গেলো৷ আমাদের বন্ধু আরিফ৷ সব সময় একই বেঞ্চে বসতাম৷ টিফিন পিরিয়ডে বাদাম কিনে মাঠে গোল হয়ে বসে বাদাম খেতাম৷ স্কুল ছুটি হলে একসাথে হেটে বাড়ি ফিরতাম৷ ঐদিন খুব ইচ্ছা হচ্ছিল আরিফের সাথে হেটে হেটে যাই, আর বাদাম খাই৷ কিন্তু সেই নেভী ব্লু প্যান্ট আর সাদা শার্টের আরিফ আর নাই৷ হারিয়ে গেছে৷ হারিয়ে গেছে আমার বন্ধু আরিফ, আমাদের বন্ধু আরিফ৷
আমাদের বন্ধু আরিফ
