প্রথম পাতা » গল্প » চিলঘুড্ডি

চিলঘুড্ডি

kite

– বাজান,পাঁচটা টেকা দেও
– কানের কাছে ভেজর ভেজর করবি না
– দেও
– বজ্জাতপোলা দূর হ কইলাম। টেকা কি গাছে ধরে?
– একটা চিল ঘুড্ডি কিনমু, দেও বাজান!
– আসমানে বহুত চিল উড়ে। হা কইরা থাক । ঘুড্ডি মুহো পড়ব
– ‘ হা কইরা থাক ঘুড্ডি মুহো পড়ব ‘ অবিকল বাপের মতো বলতে বলতে চলে যায় নসু। নাদের বিড়বিড় করে। ‘কামকাইজ নাই – হাতে নাই টেকা – চিলওয়ালা আইছে – বাপেরে ভ্যাংচায় – বজ্জাতপোলা পয়দা করছি একটা – যেদিন ধরমু পোলা তোর জন্মগু বাইর করমু।’

নাদের গরুর জন্য খড় কাটে। একটাই গরু তার। যত্নের কমতি নেই। ঘাস কেটে খাওয়ায়। ধরে খাওয়ায় সময় সময়। মেজাজটা তার খুব চড়া। নাই কথা নিয়ে লোকজনের সাথে মারামারি পর্যন্ত গড়ায়। এইতো সেদিন বারেকের সাথে মহা গ্যানজাম। নাদের খড় কাটছিল। বারেক জিজ্ঞেস করে সে করে কী-

– ভাই আমি নাচতাছি
– নাচতাছো? কাটতাছো খেড় অথচ কও নাচতাছি? খুব একটা ভাব লইছো!
– দেখতাছো খেড় কাটি – আবার জিগাও কী করি – খাজুইরা পেঁচালের মানে কী?
– এমন লাটবাহাদুর তুমি – তোমার সাথে মনে হয় কথাই বলা যাইব না?
– আমি কারো দুলাভাই না যে কথা না কইলে বৌ বেজার হইব!

এই কথাতেই বারেক চটে গেলো। হাতাহাতি পর্যায়। গ্রামে দুইপক্ষ মারামারি করার আগ পর্যন্ত তেমন কেউ এগিয়ে আসে না। আর একপক্ষ যদি হয় নাদের তবে তো কথাই নেই। ঝগড়া কিনে নেয় কার এতো ঠেকা! পাড়ার মানুষের সাথে নাদেরের সখ্য কম। কথাও কম বলে। যেদিন কাজ থাকে না গরুর সাথেই সারাদিন কাটে। কথাও তার সাথেই হয় –

– ‘মানুষ হয়ে জন্মানোর ঠেলা আছে। এইদিক দিয়া তোর রাজকপাল। বছরে একটা বিয়ান দিলি মালিকে খুশি। বাটভইরা দুধ দিলি পোয়াবারো। বিয়াশাদির ঝামেলা নাই। বিয়া করলি কী মরলি। তোর পোলা মাইয়া পাঁচকথায় রা নাই। আর আমাগো টা? বজ্জাতের আঠারো কিস্তি। আজকা চিল ঘুড্ডি,কালকা সাপ, পরশু ব্যাঙ। না দিছো কী খাইবা ল্যাঙ।’

নাদেরের বৌ আসে তড়িৎ গতিতে।

– পোলাডারে একটা ঘুড্ডি আইনা দেন – মাইনষের ঘুড্ডি নিয়া পারাপারি – কখন করব মারামারি – আমি দিশ পাই না – প্রতিদিন বিচার আসে – না হয় একটা ঘুড্ডি বানায়া দেন – নসুর মামা আসব কইছিল – ঘরে নাই কিছু – কথা কি শুনছেন?

না, নাদের শুনে নাই। গরুর জন্য পানি তোলে সে। যে গতিতে তার বৌ এসেছিল তারচেয়ে দ্বিগুণ গতিতে সে ফিরে যায়। নাদের বলতে থাকে –

– ‘ বেডি মাইনষের সব কথায় কান দিছো কী সাড়ে সর্বনাশ! এরা হইল পেঁচাইনা জাত – কামের কথা একটাও পাইবা না – বজ্জাতপোলার খালি মারামারি – বিচার যদি আসে এইবার ধইরা বুহো মাডি – কামে অকামে শ্বশুরবাড়ির লোক আইবো বাড়িতে – এরা হইলো গিয়া তোমার চ্যাটের আত্মীয়- বেশি পাত্তা দেওন নাই।’

গরুর দিকে তাকিয়ে নাদেরের আফসোসের সীমা নেই। এরা কতো সুখেই না আছে! সালাসুমুন্দির ঝায় ঝামেলা নাই। নাদেরের খরচের চেয়ে বেশি ভয় কথাবলায়। এরা অকারণে কথা বলে অস্থির করে তোলে। পাশের মাঠের চকিত তর্জন গর্জনে সম্বিত ফিরে নাদেরের। সবাই ছুটাছুটি করছে। তার বৌ-ও দৌঁড় দিলো। পোলায় ঘটনা ঘটিয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। গরুঘরের চালায় থাকা লাঠিটা হাতে নেয় সে। মায়- পোলা দুইজনরেই পেটানো লাগবে। পোলা হইলো বজ্জাত, মা তার ঘোড়া বজ্জাত। প্রায় দৌঁড়ে ছুটে আসে মেহেরের মা। কোমড়ে কাপড় গুজে শুরু করে এবার –

‘ তোর ষণ্ডা পোলার বিচার কী করবি কর। আমার পোলারে পায়ের মধ্যে তিনটা বারি দিছে। মানুষ চিনস না। হারামি পোলা জন্ম দিছস! তোর পোলার পায়ের রগ আমি ছিঁড়মু।’

-‘ ছিঁড়োগা যাও’। বলেই নাদের তাকালো বাঁশঝাড়ের দিকে। বজ্জাতটা পালিয়ে আছে। লাল প্যান্ট দেখা যায়। লাঠিটা ফেলে কাস্তেটা নিয়ে দিলো দৌঁড়। নসু এবার বুঝতে পারে। তটস্থ শিকারের মতো সেও টের পেয়ে লাফ দিয়ে ক্ষেতে নামে। তারপর ছুটে…
নাদেরও ছুটছে। নসুকে তার ধরতেই হবে আজ। বজ্জাতপোলার জন্য বেডিমানুষ তাকে গালাগাল দিয়েছে। নেংটিছাড়া মাতব্বর হইলো এই মহিলারা। তাদের কাছে অপমান! আজ সে সত্যসত্যই জন্মগু বের করবে। নসু দৌঁড়ায়। মাঠ পেরিয়ে নদী। এবার সে নদীতে নামে। চর ভাঙে, আবার খাদে পড়ে। আবার চর, আবার খাদ। সব তার মুখস্থ। সারাদিন নদী আর মাঠ। নাদেরও চর ভাঙে। এবার সে খাদে পড়ে চুবানি খায়। উঠতে উঠতেই নসুর লালপ্যান্ট হাওয়া হয়ে যায়।

গর্জন করতে করতে নাদের বাড়িতে আসে। বৌটা গেলো কই? আগে ঝাড় ভাঙতে হবে,পরে বাঁশ কাটা। নসুর দাদি অন্ধ। বারান্দায় বসে বিলাপ করছে। মেহেরের মা তার নাতির রগ কেটেছে – এই হলো তার কাছে প্রথম সংবাদ। দ্বিতীয় সংবাদ হলো নাদের পিছনে পিছনে দৌঁড়ে গেছে তাকে ধরতে। নাদেরের উপস্থিতি বুঝতে পেরে সে শুরু করলো –

– ঐ হারামিপোলা, নাতি আমার ভয় পায় নাই? তার পিছনে ছুটছস নদী পর্যন্ত? বাপগিরি মারাস? তুই জ্বালাস নাই? মাইনষেরে মারস নাই? ওরে বলদা, একটা ঘুড্ডি দিতে পারস না? বাপ সাজস? আয় আমার কাছে তোর দুই গালে কইষা চর লাগাই,আয়।’ এবার গালাগালি মৃত মানুষটার দিকে।নসুর দাদাকে –

– দামড়া বুইড়া খাইছে আর হাগছে। নায় নাতির লাইগা থুইয়া গেছে কিছু? বুইড়া , মইরা বাঁচছস নাইলে তোর নাতি আর আমি মিলা তোরে বুহো মাডি লয়াইতাম। খাটাশ কোনহানকার!’

নাদের আর কিছু বলে না। ‘এই মহিলার মাথার ঠিক নাই। আন্ধারেও মানুষ চিনে। খপ করে ধরে চর লাগাবে যহন তহন।’

নসুর দাদির বিলাপ চলতে থাকে। বংশের সবাইকে গাল দিয়ে সিরিয়াল শেষ করার পর তবে থামবে। এখন নাদেরর দাদার পালা চলছে। মসজিদে এশার আযান শোনা যাচ্ছে। নসুর মা সবদিকে খোঁজ করলো। ছেলে ফিরেনি। রাতে কোনো রান্না হলো না। নসুর মামা এসেছিল। বাড়ির এইসব শুনে সে নসুকে খোঁজার কথা বলে লাপাত্তা।

রাত বাড়তে লাগলো। নসুর দাদি ক্ষুধা সহ্য করতে পারেনা। তার মাথা এমনিই খারাপ। আজ হলো বেসামাল। নাদের শুয়ে পড়লো। একবার ভাবে কাঁচা কঞ্চি দিয়ে বৌএর পিঠে কয়টা ঝাড়তে। রান্না বাদ দিয়ে শুয়ে আছে কেন? না খেয়ে ঘুমানো যায়? মাগী!

নসুর মা কাঁদছে। অভাবী সংসার। স্বামী তার কেমন জানি! ছেলের প্রতি দরদ নাই। পাড়ায় সবারই ঘুড্ডি আছে। নাই খালি নসুর। পোলাডা বৃত্তি পায়। ঐ টাকাও পেটেয় নম। একজোড়া সেন্ডেল নাই। একটা লালপ্যান্ট পড়ে দিন গুজরান। এসব আর ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে এমন হয় দশ পাঁচটা টাকাও হাতে থাকে না। একটা চিল ঘুড্ডি পেলে ছেলেটা এমন মারামারি করতো আজ? ওর ঘুড্ডির নেশা। এর ওর লাটাই নিয়ে সারামাঠ ছুটে বেড়ায়। এইবার নসুর মা উঠে বসে। ভাত বসায়। আলু সিদ্ধ করতে দিয়ে আরেকটু খোঁজে আশেপাশে। নাই,কোথাও নাই। তার ডুকরে কান্না আসে। লোকটা কেমন পাষাণ। খুঁজেও না একটু!

আকাশ নিকষ কালো। বৃষ্টি হবে। একটাও তারা নেই। নসুর দাদি খেয়েছে। কলতলায় থালা বাসন রেখে নসুর মা বাঁশঝাড়ে তাকিয়ে দেখে একবার। ভ্যাঁপসা গরম। কাঁঠালগাছে অচেনা পাখি ডেকে ওঠে। এবার সে আর কান্না ধরে রাখতে পারে না। শব্দ করে কাঁদলেও লোকটা ছাড়বে না। এমন বদ!

রাত বাড়তে থাকে। সবাই ঘুমিয়ে গেছে।কাঁদতে কাঁদতে নসুর মা না খেয়েই ঘুমিয়ে গেছে। টর্চটা নিয়ে নাদের এবার বের হয়। আধাঘন্টা পরই ফিরে আসে। নসুর দাদির ঘরে উঁকি দেয় একবার। লালপ্যান্ট পড়া বজ্জাতটা দাদির বুকঘেঁষে শুয়ে আছে। গরমে ঘেমে ন্যাদাভেদা। ঘুমাক বজ্জাতপোলা। বাকিটা সকালে।

রাত বাড়ছে। নাদের আলী ঘুমায় না। নসুর গত বছরের ওয়ান ক্লাসের পুরোনো বইটা খুঁজে বের করে। বাঁশের চটি,কিছু ভাত, সুতা নিয়ে সে বসে পড়ে বারান্দায়।

বড় যত্ন করে সে তার ‘বজ্জাতপোলার’ জন্য রাতজেগে ঘুড়ি বানায়, চিলঘুড্ডি।

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *