ইংরেজি থেকে আমদানি করা হলেও বিষয়টায় একটা খানদানি ভাব আছে-চেয়ার। বাংলায় এর নাম কেদারা হলেও শব্দটির চেহারা তেমন জুতসই নয় বলে আমাদের ‘চেয়ার’ই ভরসা। বাংলায় চেয়ারের শাব্দিক আমদানি সুপ্রাচীন নয়। বৃটিশরা এদেশে ‘চেয়ার’ শব্দগত এবং বস্তুগত ভাবে নিয়ে এসেছে। তারাই চেয়ার ব্যবহার করেছে, আমাদেরকেও শিখিয়েছে। প্রাচীন বাংলায় টুলের ব্যবস্থা ছিল। পণ্ডিতগণ টুলে বসতেন। ছাত্ররা সামনের চটে অথবা পাটিতে বসে বিদ্যালাভ করতো। চেয়ারের জায়গায় তখন সিংহাসন ছিল। কারো ছিল ময়ূর সিংহাসন! রাজারা সেসবে বসতেন। প্রজারা সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। হাত দুটো নিয়ে বাঙালির যন্ত্রণা হতো খুব। রাজার সামনে হাত দুটোর জুতসই জায়গা হতো না। কাঁচুমাচু করে সামনে বা পেছনে রাখা হতো ‘অপ্রয়োজনীয়’ দুইটি হাত! চেয়ার ছিল না কবির কবিতাতেও :
“আমার বাড়ি যাইও ভ্রমর বসতে দিব পিঁড়ে…”
এরপরে বাঙালি একদিন চেয়ারের সাক্ষাত পেল। নির্বাচন পেল। একবার এক নির্বাচনে কফিল উদ্দিন চাচা পেল চেয়ার মার্কা। আমরা গেলাম মিছিল করতে। গুঁড়ের চা আর এক কলস মুড়ি খেয়ে আমরা স্লোগানের তালিম নিলাম। চাচা চিল্লায়ে বললেন :
‘কফিল ভাইয়ের মার্কা/ চিহাইর চিহাইর’
আমরা সমস্বরে বললাম : চিহাইর চিহাইর
এইদেশে নির্বাচন এক আজব জিনিস। যার বেশি টাকা হয় সে হয় দুই চারটা বিয়ে করে আর না হয় নির্বাচনে দাঁড়ায়। টাকাপয়সা হারিয়ে একসময় নির্বাচন হয় নির্বাসনের কারণ। কারো আবার গজকপাল। একবার পাশ করলে বিশ বছরের কামসারা! খালি পাশ আর পাশ। নজরুল আর নির্মলেন্দু গুণরা আবার আসে চারাকপাল নিয়ে :
“কপালের কপাল আ-কপালের চারা
লাগাইলাম গেন্ডারি হইল দারা”!!
কবিদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। কফিল উদ্দিনও কাম বানাইতে পারে নাই। ভোটাররা চিহাইর-এর ছবি নাকি বুঝে নাই। ভুলে সিল মারছে খেঁজুরগাছে! চিহাইর আর খেঁজুর গাছের মধ্যে মিল কোন জায়গায় এটা বুঝতে কফিল উদ্দিন চাচা মনস্থির করলেন সামনের বার মক্কায় যাবেন। খেঁজুর গাছ সরেজমিনে দেখা দরকার। আর ভোটে জিততে চাইলে এদেশে হজের বিকল্প নাই। আমরা বুঝাইলাম। চাচা বুঝলেন কি না জানিনা। চিক্কুর দিয়া কইলেন : আমার চিহাইর?
আরএফএলের যুগ এখন। সবার বাড়িতেই চেয়ার আছে বেসুমার। তবু চেয়ারের প্রতি আমাগো পেয়ার গেলো না। ধাক্কাধাক্কি-ঠাসাঠাসি-জাতাজতি স্থানবিশেষে থাপড়াথাপড়ি-লাঠালাঠি-রক্তারক্তি করেও চেয়ার পেতেই হয়! নিজেরটা ঠিক রাখার জন্য অন্যের চেয়ারের কেয়ারে আমাদের হুঁশ নেই। অনেক নামিদামি লোককেও চিৎকার করে বলতে শুনেছি :
‘আমার চিহাইর?’