প্রথম পাতা » বিতর্কিত বিষয় » উপমার ভুল প্রয়োগ

উপমার ভুল প্রয়োগ

what

বাংলা ব্যাকরণে ভাষার অপপ্রয়োগ নামে একটি টপিক আছে। উপমার ভুল প্রয়োগকে ভাষার অপপ্রয়োগের একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপমা হয় তুলনায়। কার সাথে কাকে তুলনা করছেন তাতে যদি হুঁশ হারিয়ে ফেলেন তাহলে উপমার ভুল প্রয়োগ হয়। উপমার ভুল প্রয়োগে ব্যক্তিগত কোনো লাভ ক্ষতি হয় না। একটি ভাষাগোষ্ঠীর সমূহ পতন হয় ধীরে ধীরে। একটি জাতিকে নষ্ট করতে চাইলে প্রথমে তার ভাষাকে হত্যা করতে হয়। আগে ভাষা মরে, তারপর মরে মানুষ।

মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাইদী ইহলোক ত্যাগ করেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি একজন সুবক্তা, সুরেলাকণ্ঠী, ইসলামি চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি কোরআনের তাফসির করেছেন দীর্ঘ সময়। জনপ্রিয়তার দিক থেকে তার সমকক্ষ আর কোনো ওয়ায়েজিন সমকালে এবং স্মরণকালে ছিল বলে মনে হয় না। রাজনীতিবিদ হিসেবেও জনগণের রায় পেয়েছেন। দুইবার সাংসদ হয়েছেন। বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। ইসলামের জন্য কাজ করেছেন। রাজনীতিতে তিনি ইসলামকেই করেছিলেন ঢাল। জামায়াতে ইসলামির নেতা ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জামায়াতের ভূমিকা শুধু প্রশ্নবিদ্ধই নয় বরং বিস্ময়সূচক। সেই দলটির সিপাহসালার হিসেবে আমৃত্যু তার সংশ্রব ছিল। তার বক্তৃতায়, সমাবেশে লোকজনের স্রোত ছিল অস্বাভাবিকের চেয়েও বেশি। তার সম্মোহনী শক্তি ছিল। আলেম হিসেবে তিনি বিপুল জনসমর্থন পেয়েছিলেন। ৮৩ বছর বয়সে তিনি মারা গেলেন। গড় আয়ুর হিসেবে তিনি দীর্ঘজীবন লাভ করেছিলেন বলাই যায়। তার অন্তিম বিদায়ের ১১ বছর আগেই তার বড় ছেলে চলে গেছেন চিরবিদায় নিয়ে। তখন তিনি কারাদণ্ড প্রাপ্ত। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিশটি অভিযোগের আটটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাকে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগে তা আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়। এ শাস্তি ভোগ করা অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।

তাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখনো বাংলাদেশে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। তার ভক্তকুল বিশেষ করে জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত লোকজন ভয়াবহ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে বহু পুলিশ, সাধারণ মানুষও মারা যায়। তাকে যারা পছন্দ করে তাদের সবাই জামায়াতপন্থী বিষয়টা এমনও নয়। ক্ষমতাসীন দলেরও বহুলোক তাকে সমর্থন করে। সেটা হতে পারে ইসলামিক বক্তা হিসেবে তার সম্মোহনশক্তি।

আমি তার বহু ওয়াজ শুনেছি। তিনি খুব সতর্কতার সাথে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতেন। ইসলামি শাসন কায়েমের কথা বলতেন। তিনি যদিও জানতেন ইসলামি শাসন কায়েম করার জন্য এদেশ স্বাধীন হয়নি। তিনি দুইবার আইনপ্রণেতা হয়েও ইসলামি শাসন কায়েম করার মতো কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি। বরং একটা সময় বোমা, হামলা, মামলা, সংঘর্ষ, জঙ্গিবাদে দেশটা তালেবানি হয়ে উঠেছিল। তার বক্তব্যের কিছু জায়গায় জাতির পিতা বিষয়ক একটা প্রশ্ন থাকতো। তুরস্ক, পাকিস্তান, সৌদির জাতির পিতা নিয়ে তিনি কোনো বিরূপ মন্তব্য করেননি। শুধু বাঙালির জাতির পিতার বেলায় তিনি ইব্রাহিম আ. এর ব্যাপারে আপসহীন ধৃষ্টতা দেখাতেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি ‘হাবিজাবি লোক’ হিসেবে প্রচার করতেন, বিদ্বেষ ছড়াতেন। বঙ্গবন্ধুকে আড়াল করে, অপব্যাখ্যা করে এদেশে রাজনীতি করলে টিকে থাকা যায় না। সত্যকে মিথ্যার বেসাতি পরিয়ে আটকানো যায় না।

ইসলামি বক্তা হিসেবে বাংলাদেশে তার অবস্থান আকাশচুম্বী। আদালত তার রায়ে বলেন, আমরা মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাইদীকে শাস্তি দিচ্ছি না। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ‘একজন রাজাকার’ বা ‘দেলোয়ার শিকদার’কে এ শাস্তি প্রদান করা হলো। একাত্তরে তিনি কোথায় ছিলেন, কী করেছিলেন তা তার এলাকার মানুষের জানার কথা। তাকে যখন এ অপরাধে শাস্তি দেওয়া হয় তখন পিরোজপুরের কেউ এ রায়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ বা সংক্ষুব্ধ হয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে বলে শুনিনি (আপনাদের কাছে তথ্য থাকলে কমেন্টে জানাবেন)। নোয়াখালি বা অন্য কোনো অঞ্চলের কেউ যদি তখন প্রবল দুঃখে আত্মবিনাশী হয় তবে তা করেছে তার ইসলামি বক্তার সম্মোহনের গুণে। আদালতও তার এ গুণের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, একজন মাওলানাকে শাস্তি দিতে বিব্রত হয়েছেন।

তিনি চলে গেছেন। এখন তাকে নিয়ে নানারকম মিরাকল আলোচনায় আসছে। তাকে এর আগে চাঁদেও দেখা গেছে একবার। তার মৃত্যুর কয়েক মিনিট পর দেশে ভূমিকম্প হয়েছে। আল্লাহর আরশ নাকি কেঁপে উঠেছে। তাই এ ভূমিকম্প। অথচ ভূমিকম্পের উৎপত্তি আসাম প্রদেশ। সাইদী সাহেব বাংলার জমিনে হয়তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন কিন্তু আসামের মাটি তার জন্য কেঁপে ওঠার কথা না। তাছাড়া রাসুল স. এর স্পষ্ট হাদিস আছে- কারো মৃত্যুর সাথে চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, ভূমিকম্পের সম্পৃক্ততা নেই। এসব বিশ্বাস করাও শিরক। ইসলামের জন্য ওমর রা., আলী রা., ওসমান রা. জীবন দিয়েছেন। তাদের কাউকে চাঁদে দেখা গেছে এমন কথা কোনোদিন শোনা যায়নি। আসলে বাংলার মুসলমান অতি আবেগী, ধর্মান্ধতা এদের মধ্যে প্রবল।

জীবিত সাইদী সাহেবের কয়েকটি ছবি দেওয়া হয়েছে। তার জানাজা, কাবা থেকে বের হওয়া এমন আরো বেশ কিছুর ছবি। কয়েকটি ছবি এডিট করা হয়েছে। এর প্রমাণও ফেসবুকে আছে। এতে তো তাকে অপমানই করা হচ্ছে। মিথ্যা দিয়ে কাউকে বড়ো করা যায় না। প্রত্যেকটি মানুষের অবস্থান আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এডিটিং করে কাউকে বড় করে দেখানোর কিছু নেই। পরপারে তার জায়গা আল্লাহ নিশ্চয়ই ঠিক করে রেখেছেন। মৃত মানুষের মিরাকলে তার কিছু এসে যায় না। ইসলামে অন্ধত্ব, কুসংস্কারের স্থান নেই।

যে জিনিসটি অস্বাভাবিক লাগছে তা হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার তুলনা করাটা। তার অতি আবেগী কিছু ভক্ত প্রচার করছে যে বঙ্গবন্ধুর জানাজায় এতো কম লোক থাকার কারণ কী? এতোবড় একজন নেতাকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হলো কেন? তার লাশ তিনদিন পড়ে থাকলো কেন?

প্রথমত বঙ্গবন্ধুর সাথে কারো তুলনা করা চলে না। He is the embodiment of our independence. বাংলাদেশে বহু মোফাস্সিরে কোরআন এসেছে, আসবে। কিন্তু একটি জাতিকে বারবার স্বাধীনতা এনে দেয়া যায়না। স্বাধীনতার স্বপ্ন মানুষ প্রতিদিন দেখে না। একজন স্বাধীনতার মূর্তপ্রতীকের সাথে আপনি কার তুলনা করছেন? কী উপায়ে তাঁকে হত্যা করা হলো, কতটা জিঘাংসা নিয়ে পুরো পরিবারকে শেষ করা হলো সেই ইতিহাসটা পড়েছেন? হেলিকপ্টারে করে কারা বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে গেলো টুঙ্গিপাড়ায়, অস্ত্রের মুখে তাঁর দাফন হলো কেন একজন মুসলিম হিসেবে এ প্রশ্নটা করেছেন কখনো? একজন প্রেসিডেন্টকে শেষ গোসল করানো হলো সবচেয়ে সস্তা ৫৭০ সাবানে? রিলিফের কাপড়ে কাফন পরানো হলো স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে? তাঁর জানাজার লোকসংখ্যা নিয়ে আপনার জিজ্ঞাসা! পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রনায়ককে বন্দুকের নলের সামনে সমাহিত করা হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের তুমুল জনপ্রিয় সাদ্দাম হোসেনের জানাজার লোকসংখ্যা কতো ছিল? ইতিহাসটা জানেন।

উপমহাদেশের রাজনীতি মূলত হত্যার রাজনীতি। ইসলামের ইতিহাস পড়লেও দেখবেন চারজন মহান খলিফার তিনজনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে অপঘাতে মৃত্যু বলে পাড় পাবেন না।

পৃথিবীর আর কার কার লাশ তিনদিন পড়ে ছিল অনলাইনে সার্চ দিন, পাবেন।

ঘৃণার চাষ করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না। ঘৃণার প্রতিদানেও যেখানে ভালোবাসার আবাদ করতে হয় সেখানে বিদ্বেষী মনোভাব আপনাকে কতদূর নিয়ে যাবে?

জসীমউদদীনের কবিতার ভাষায়-

“যে মোরে দেয় বিষে ভরা বাণ
আমি দেই তারে বুকভরা গান!”

থাক, আপনাদের তো আবার গানেও সমস্যা।

বিতর্কিত বিষয় থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *