প্রতি বছরই পৃথিবীব্যাপী অবস্থিত বিশ্ববিদ্যাগুলোর ‘মান নির্ণয়-সূচক’ তালিকা প্রকাশ হয় এবং তাতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কাঙ্ক্ষিত জায়গায় স্থান না পাওয়ায় পুরো জাতির মধ্যে যে হাপিত্যেশ এবং মুচকি হাসির রেখা দেখা দেয় তাতে বিচলিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
বিশ্ববিদ্যালয় জাতির মননের প্রতীক। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঠিক সংখ্যা আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়মঞ্জুরি কমিশনও জানে না। এশিয়ার সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন : ইতর প্রাণী প্রসব করে বেশি! এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থীকে সার্টিফিকেট পৌঁছে দেয়। অথর্ব বেকার তৈরির লাভজনক প্রতিষ্ঠান এটি। সরকারকে প্রতিবছর তিনশ থেকে পাঁচশত কোটি টাকা পর্যন্ত এরা জমা দেয়! শিক্ষাঙ্গন যে লাভজনক প্রতিষ্ঠান এটি এই বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়! এটি ঘরে বসে পরীক্ষা দেওয়ার এক মোক্ষম জায়গা। এর আসল নাম ওপেন ভার্সিটি। বই ওপেন করে লেখাই এর মূল আদর্শ। এতে দেশের শিক্ষার তেরোটা বাজলেও কিছু পছন্দের মানুষের বসার জায়গা ও পয়সা কামাইয়ের পথ তৈরি হয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এদেশের মূল স্রোতের বাইরে। দেশীয় কালচার কৃষ্টি থেকে এরা বহুদূর। এদের রয়েছে নিজস্ব বলয়। এই বলয়ে বাংলার মেহনতি আমজনতার প্রবেশের সুযোগ নেই। বিত্ত-বৈভব অহমিকা প্রদর্শনের তীর্থভূমি এসব ভার্সিটির মূলপ্রেরণা। দু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মান ভালো। তবে খরচ অত্যধিক হওয়ায় সর্ব সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
নিজে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। এ নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা আছে। একটু শেয়ার করি। বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ে বেড়ে ওঠা নিম্নবিত্তের ছেলেমেয়েরাই বাংলাদেশের পাবলিক ভার্সিটির মূলস্রোত। এরা প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আগত। প্রায় সবারই সংসারে নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। মাসকাবারের খরচ মেটাতেই এদের হিমশিম খেতে হয়। একবেলা না খেয়ে থাকার মতো শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যাতীত। প্রয়োজনীয় বই তো দূরের কথা পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় ফটোকপি করার টাকাও অনেকের থাকে না। টিউশনি, অন্য কোনো কাজে আয়ের পথ বাগানোতেই এইসব পোলাপানের সময় যায়। গবেষণা, পড়াশোনা এসব দরকারি বিষয় ছাড়াও ক্যাম্পাসে আরো জরুরি বিষয় হলো রাজনীতি ও হলে থাকার জন্য একটি সিট সরবরাহ করা। এইদেশে ফকিন্নির পুতের নাম মিঞা, খান। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রুমভাড়া, সিটভাড়া, দোকানভাড়ার মতো কালচার আছে৷ জমিদারের পুতেরা ভার্সিটিতে গিয়েই শরীরী-অশরীরী বলে হল দখল করে, ক্যাম্পাস লিজ নেয়। তাদের জুতমতো চললে ভালো। তাদের জুতসই না হলে ক্যাম্পাসে থাকাই অসম্ভব। এ ধরনের মানসিক চাপে পড়াশোনার বারোটা বাজিয়ে কয়েক সেমিস্টার পগার পাড়! তারপর শুধু ফেল ঠেকানোর চিন্তা। কোনো মতো সার্টিফিকেটটা পেলেই হলো! বিসিএসে বসতে পারলেই কম্ম কাবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্টাল লাইব্রেরিতে প্রতিদিন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে আড়ম্বর দেখা যায় তা কিন্তু কোনো গবেষণাধর্মী পড়ালেখার জন্য নয়। স্রেফ পদ্মাসেতুর নাটবল্টু মুখস্থ করার জন্য এরা ভিড় করে। আমিও করেছি। লাইব্রেরিতে আমি মাঝে মধ্যে যেতাম প্রস্রাব করতে! ওখানে বসে পড়ার সময় আমার ছিল না! আমি দ্রুত পাশ করেছি, দ্রুত চাকরি নিয়ে চাকর হয়েছি। এ-ই হচ্ছে প্রতিবছর। সমাজে সংসারে একজন গবেষক গুরুত্বপূর্ণ নয়, একজন সরকারি চাকরিজীবী আবশ্যক। জাতির মুক্তির চেয়ে বড় মুক্তি নিজের বালবাচ্চার। নিজে বাঁচলে বাপের নাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এ পৃথিবীর এক অষ্টম আশ্চর্য। পারিবারিক পছন্দ, দলীয় পছন্দ, লাল-নীলের খেলা প্রভৃতির ডামাডোলে যোগ্যরা অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে থাকে। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন গোয়ালঘরে রূপ নিয়েছে।
শিক্ষকদের অবস্থাও এদেশে শোচনীয়। মুখে বলা হয় শিক্ষকতা মহান পেশা। আদতে শিক্ষকতা হলো এ জাতির সবচেয়ে লজ্জাকর পেশা। নানামাত্রিক বঞ্চনা ও প্রপঞ্চনা এ পেশার মূলে ক্রিয়াশীল। এ অঞ্চলে সকল শিক্ষকই একটি বিশেষ গোষ্ঠীর দ্বারা নিষ্পেষিত। ভালো শিক্ষক না হলে ভালো শিক্ষার্থী তৈরি করা অসম্ভব।
এখানে পড়ে কারা? আপনার আমার ভাই, বোন, সন্তান, পরিজন। এ দেশের লোকজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মতো যোগ্যতাই রাখে না। বিশ্বকে ধারণ ও লালন করার মতো একটি মন এ জাতির নেই। বিশ্ব মানের কোনো বিষয়কে অনুভব করে পাঠ করার মতো উদারতা আমাদের নেই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি রুমে, প্রতিটি হলে মসজিদ, মন্দির চাই। আমরা প্রার্থনায় যতটা আগ্রহী, গবেষণায় ততটা নই। আমরা আধ্যাত্মিকভাবে চাকরি চাই, ভক্তের দোয়া চাই, ঈশ্বরের দয়া চাই, সুন্দরী বৌ চাই, হ্যান্ডসাম বর চাই- সবই চাই কেবল ঐশ্বরিক উপায়ে। ফলে আমাদের কাছে প্রার্থনালয়ের মূল্য বেশি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মুক্ত জ্ঞানচর্চার জায়গা। এটি পূজার মিষ্টি কিংবা শবে বরাতের রুটি বিতরণের জায়গা হওয়া উচিত নয়।
আমি বারো বছরে বহু শিক্ষার্থী দেখেছি তারা একটি কাদার মতো মন নিয়ে ভার্সিটিতে গিয়েছে। তারা ফিরে এসেছে চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মান্ধ হয়ে। তারা একটি চাকরি নিয়ে ফিরে এসেছে কিন্তু মানুষ হয়ে ফিরতে পারেনি। হয়তো আমিও পারিনি। আমার শিক্ষকদেরও এ আক্ষেপ থাকতে পারে। তবে আমি নিজেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করিনি। এটুকু এনশিওর করতে পারবো।
আমরা আজো বিশ্বাস করি চাঁদে না গিয়েও আমরা যেতে পারি। শুধু ধর্মের কারণে একজন কুখ্যাত রাজাকারের সন্তানের পরস্ত্রী কাতরতাকে অন্যায় মনে করি না। আমাদের প্রতিদিনের সংলাপ- আমারে চিনস? শুধু নিজের মতো নয় বলে সোসাইটি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া এই আমাদের মতো কূপমণ্ডুকদের সন্তানরাই তো পড়ে দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। তো আমরা কি বিশ্ব মানের মানুষ হতে পেরেছি? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন হবে বিশ্বমানের? রবীন্দ্রনাথ বলেননি তবু তাঁর নামে ছড়ানো প্রোপাগান্ডা হলো তিনি নাকি বলেছিলেন : চাষার দেশে বিশ্ববিদ্যালয় কেন? আমি মনে করি রবীন্দ্রনাথ যদি সত্যই এ কথা বলতেন তবে তিনি এ জাতির প্রতি সুবিচার করতেন!
রুহানি সন্তানদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় লাগে না, তাদের জন্য প্রয়োজন বিশ্বকুয়া, যেখানে ডুব দিলেই পগারপাড়; আঙুর-বেদেনা-কিসমিস!