হাই স্কুলে আমার একজন হিরো ছিলেন। আমার গাজী স্যার। আমাদের গাজী হুমায়ুন কবির স্যার। প্রচণ্ড জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। শিক্ষার্থীবান্ধব, রাগী, গণিতের আইনস্টাইন খ্যাত আমাদের গাজী স্যারের থাপ্পর ছিল ভুবনবিখ্যাত। তাঁকে দেখলেই সিক্স সেভেনের পোলাপান প্যান্টে হিসু করে দিতো। স্যারের সাস্থ্য ভালো ছিল। গায়ের রঙ ছিল কালো। জটিল জটিল অঙ্কগুলো কতো সহজেই না স্যার সমাধান করতেন! তাঁর মতো প্রাণখোলা হাসি তখন কোনো স্যারকে হাসতে দেখিনি। কাউকে ভয় করতেন না। প্রচণ্ড সাহসী আর উদ্যমী ছিলেন তিনি। ছাত্রদের জন্য স্যারের নিবেদন ছিল স্মরণীয়।
আমি ক্লাস সিক্সে হাই স্কুলে ভর্তি হই যখন মনে পড়ে, ভর্তির সময় আমার দিতে হয়েছিল ছয়শত টাকা। এরপর অর্ধবার্ষিক, বার্ষিক পরীক্ষার সমস্ত বেতন ও পরীক্ষার ফি বকেয়া হলো। আমি ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠলাম প্রথম স্থান অর্জন করে। ক্লাস সেভেনে গাজী স্যারকে পেলাম। আমাদের বিজ্ঞান ক্লাস নিতেন। প্রথম সাময়িক পরীক্ষার আগের দিন আমি স্কুলে গেলাম প্রবেশপত্র নিতে৷ আমার অনেক টাকা বকেয়া আছে তাই অফিস থেকে জানানো হলো প্রবেশপত্র দেওয়া যাবে না। আগামীকাল পরীক্ষা, সবাই পড়ছে আর আমি অপেক্ষা করছি হেডস্যারের সাথে দেখা করে পরীক্ষার অনুমতির জন্য! হেডস্যার খুব ব্যস্ত থাকায় বিকেল হয়ে গেলো। আমি শহিদমিনারে বসে আছি। হঠাৎ গাজী স্যারকে দেখে দাঁড়ালাম। তিনি ধমক দিলেন। কাল পরীক্ষা অথচ এখনো স্কুলে কেন এটা জানতে চেয়ে ধমক। আমি চোখের পানি আটকাতে পারলাম না। স্যার হয়তো বুঝতে পারলেন। আমাকে অফিসে নিয়ে গেলেন। সব শুনলেন। তারপর হেডস্যারের কক্ষে নিয়ে গেলেন। সব বুঝিয়ে বললেন। স্যার বললেন : ‘এই ছেলেটিকে ফুল ফ্রি করে দেন। কোনো সেশন চার্জও দিতে পারবে না। ওরে আজীবন ফ্রি করে দেন।’ সেবার আমার পরীক্ষার ব্যবস্থা হলো। এরপর কতোবার? প্রতিবারই। বছরে দুইবার। প্রত্যেকবারই আমার প্রবেশপত্র আটকে যেতো আর এগিয়ে আসতেন গাজী স্যার!
আমাদের এসএসসি পরীক্ষার দুই এক বছর আগে সম্ভবত কোনো এক পরীক্ষায় স্যার নকলে বাধা দিলেন। পরীক্ষার পর স্থানীয় পোলাপান পরিকল্পিতভাবে স্যারকে চরম অপদস্ত করলো। স্যার বিস্মিত হলেন এবং ভয়াবহরকম ভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। তাঁর প্রাণখোলা হাসি থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। ঐ বিপদের সময় তিনি কাউকে পাশে পাননি। স্যারের নির্লিপ্ততায় দ্রুত প্রাণ হারালো ঐতিহ্যবাহী স্কুলটি। ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হলো ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত আমার প্রিয় বিদ্যাপীঠ। এখন ধুঁকে ধুঁকে কেবলই টিকে আছে। স্যার কোথায় আছেন আমি জানি না। বহুবছর তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ নেই।
আপনারা আদর্শ শিক্ষকের কথা বলেন? আদর্শ শিক্ষক আমি দেখেছি। আদর্শ শিক্ষকদেরও ভয়াবহ তকমা গায়ে লাগানো হয়। ঢাবির বাংলা বিভাগে বহু আদর্শ শিক্ষক আছেন। তাঁদের মতো শিক্ষক পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার। অথচ কয়েকদিন আগে কে বা কারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কয়েকজন গুণী শিক্ষককে ‘হিজাববিরোধী’ তকমা লাগিয়ে পদত্যাগের এবং লাঞ্ছনার ডুগডুগি বাজাচ্ছে! আপনারা রোগটা ধরতে পারছেন না হয়তো। কেন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এভাবে পরিকল্পিতভাবে হেয় করা হচ্ছে তার কারণটা দ্রুতই জানতে পারবেন। এই অস্থিরতার পশ্চাতে আছে ভয়াবহ আইডিয়োলজির খপ্পর।
শুধু এটুকু বলতে চাই, একজন গাজী স্যার না থাকলে আমার দুফোঁটা অশ্রুতে মর্মাহত হওয়ার কে থাকতো? কে-ই বা আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলতো : প্রবেশপত্র দিলাম, যা। এই পরীক্ষায় ফার্স্ট না হলে তোর খবর আছে মানিক!’
দেশের মারী আর মড়কের বিষ সবসময় শিক্ষকদেরই গায়ে লাগে আগে। এখানে আদর্শ, অনাদর্শের হিসাব পরে।