প্রথম পাতা » শিক্ষা » রাজসিকের বিদায়

রাজসিকের বিদায়

GIAS SHAMIM

গৌড়ের সুলতান ছিলেন গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ। তিনি সাহিত্য অনুরাগী মানুষ ছিলেন। পারস্যের কবি হাফিজের সাথে আজম শাহের পত্রালাপ হতো। তিনি বাংলা অঞ্চলে কবি হাফিজকে আমন্ত্রণ জানান।

২০০৫ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হই। প্রথম বর্ষের অর্ধেক সময় কাটলো আমার বুঝতে পারা না-পারার দ্বন্দ্বে। বাকি অর্ধেক কাটলো আবু জাফর স্যারের ইনকোর্স পরীক্ষা দিতে দিতে। সেই গল্প আরেকদিন হবে। দ্বিতীয় বর্ষে ‘পথের পাঁচালি’ নিয়ে এলেন শামীম স্যার। প্রথম ক্লাসেই তাঁকে চিনে ফেললাম। খুবই গুছিয়ে কথা বলেন। একটা শব্দও অকারণে বলেন না। ভরাট গলায় বলে চলেন অপু-দুর্গার কাহিনি। আমাদের এই ক্লাসটি হতো আড়াইটায়। টিএসসি, ডাচ, হল কিংবা হাকিম চত্বরে দুপুরের খাবার খেয়ে যখন ভাতঘুমে যাওয়ার কথা তখন আমরা চলে যেতাম ২০১৭ নম্বরে। আমাদের যাত্রা শুরু হতো নিশ্চিন্দিপুরের অভিমুখে। সেখানে আছে সর্বসহায়হারা সর্বজয়ার আটপৌরে সংসার, হরিহরের কপর্দকহীন জীবন, অপু-দুর্গার মাঠ পেরিয়ে বন তারপর দিগন্তের প্রান্তে তেপান্তরের পথবেয়ে আম-জাম-হিজলের ছায়া, পথের ধারের ভাঁটফুল, আম-আঁটির ভেঁপুর সুরে অমিয় কুহক সৃষ্টি হতো পুরো ক্লাসজুড়ে। একসময় দুর্গার মৃত্যু হতো, আমাদের চোখ ভিজে উঠতো! অপু বড় হলো। আমরা চলে গেলাম হারু ঘোষের কাছে। লোকটা বজ্রপাতে মারা গেছে। লাশ নিয়ে শশী ডাক্তার গ্রামে প্রবেশ করলেন। কুসুমের সাথে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় আমরা বিশ্বভ্রমণ করতাম। সিগমুন্ড ফ্রয়েড, গায়র্ত্রী সিডাক, মার্ক্স, সিমোন দ্য বোভোয়ার হয়ে হালের তসলিমা নাসরিন। আমরা খুঁজে বেড়াতাম মানুষ। গাওদিয়ার তালপুকুর হয়ে পুরো পৃথিবী। আমাদের স্পৃহাটা জাগাতেন শামীম স্যার। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ ছেড়ে আমরা চলে যেতাম বাকুলিয়ায়। কানকাটা রমজানের নতুন দিনের নব্য কাহিনিতে। আমরা হয়ে উঠতাম ‘সংশপ্তক’ এর সৈনিক। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ঘুরে একবার দেখা হলো বাদশাহ হারুনের সাথে। তাতারির গল্প থেকে জানা গেলো : হাসি তো আত্মার প্রতিধ্বনি! কী চমৎকার সৃষ্টি শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’! আমাদের দুপুরগুলো আনন্দময় করে তুলতেন শামীম স্যার। বক্তব্যের পরিমিতিবোধ, বিষয়ের নির্মোহ বয়ানে তাঁর প্রভাষণসমূহ ছিল শৈল্পিকসমৃদ্ধিতে পূর্ণ। পড়ার আনন্দটা স্যার দিতে পারতেন। শিক্ষকের কাজই জ্ঞানের স্পৃহা তৈরি করা। শামীম স্যার সেই স্পৃহাটা তৈরি করতে জানতেন। আর শিক্ষার্থীদের ভালোবাসার, কাছে টানার গুণটি তাঁর ছিল অনন্য।

স্যারের কক্ষে বিভাগের শিক্ষার্থীদের ইজি এন্ট্রান্স ছিল। আমাদের ভরসার জায়গা ছিলেন তিনি। কখনো বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়াতেন। পিতার মতো স্নেহ ঢালতেন। শিক্ষকের আসল যে গুণটি শিক্ষার্থীর কাঁধে হাত রাখতে পারার মহত্ত্ব, সেটি স্যারের ছিল। তাঁর আরেকটি গুণ ছিল। প্রায় সবার নাম মনে রাখতেন। কারো কারো নিকনাম ধরে ডাক দিয়ে চমকে দিতেন!

২০১২ সালে আমার মাস্টার্স শেষ হলো। স্যারের সাথে আর দেখা হবে না হয়তো! আমি মানতে পারলাম না। ভিতরে ভিতরে ব্যাপক শূন্যতা বোধ করলাম। শুধু তাঁর সান্নিধ্যে থাকার মোহে আমি এম.ফিল. এ ভর্তি হলাম। বহু পরিশ্রমে আমার অভিসন্দর্ভটি সাবমিট করলাম। কী দুঃসহ সেই দিনগুলি! ঢাকা টু শেরপুর! শেরপুর টু ঢাকা! একদিন দশ মিনিটের জন্য ঢাকা গেলাম! স্যার অনেক কষ্ট স্বীকার করে আমার গবেষণাকর্মটি দেখেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন। সংশোধন করেছেন। প্রতিটি পৃষ্ঠা, প্রতিটি শব্দ তিনি পেন্সিল, লালকালির কলম দিয়ে প্রয়োজনে কারেকশন করে দিয়েছেন। অবশেষে সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ডিগ্রিটি প্রদান করে।

বাংলা বিভাগে একটি ফটোগ্যালারি আছে। বিভিন্ন প্রোগ্রামের ছবি সেখানে রাখা হয়। স্যারের একটি ছবি একদিন সেখানে দেখেছিলাম। স্যার ঘোড়ার পিঠে উঠে আছেন। নিচে ক্যাপশনে লেখা : গিয়াসউদ্দীন শামীম শাহ! ক্যাপসনটি আমার খুব পছন্দ হয়েছিল।

গৌড়ের সুলতানের নামানুসারে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল কি না জানিনা। তবে তিনি আমাদের বাংলা বিভাগের একজন সম্রাট। যাঁর কাছে পাওয়া যায় সমুদ্রসমান স্নেহ, আতিথ্য ও জীবনের বহুমুখী স্বপ্নের পরশ। আজ স্যারের জন্মদিন। গতকাল ছিল স্যারের শেষ কর্মদিবস। বাংলা বিভাগ চিরদিনের জন্য বিদায় জানাল একজন রাজসিক অধ্যাপককে। তাঁর মতো পিতৃতুল্য শিক্ষক কপালগুণে পাওয়া যায়।

বাংলা বিভাগের দুপুরগুলো আর নিশ্চিন্দিপুর হয়ে উঠবে না হয়তো। ঢাকায় গেলে আমি আর খুঁজবো না স্যার বিভাগে এসেছেন কি না, তাঁর কক্ষের সামনে আর দাঁড়িয়ে থাকব না প্রিয় মানুষটিকে একবার দেখে আসার জন্য!

স্যারের অবসরজীবন আনন্দময় হোক।

শিক্ষা থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *