আমাদের সময় ২০০৫-০৬ সেশনে ডিপার্টমেন্টের এক বন্ধু হলমেসের ম্যানেজারি করে একটা কেইস খেলো। মাসের শেষে হিসাব মিলাতে গিয়ে দেখল ১৮০০ টাকা গরমিল! আমার বন্ধু গ্রাম থেকে উঠে আসা সহজ সরল মানুষ। বাড়ি থেকে যে টাকা তার নামে আসতো তা নেহায়েতই অপ্রতুল। এই টাকা থেকে কিছু বাঁচিয়ে ১৮০০ টাকা শোধ করতে তার লাগবে প্রায় সাত আট বছর! বন্ধু তাই সিদ্ধান্ত নিল বদনামের ভাগী হয়ে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। মুহসীন হলে থাকতো। এক ভোরে সে ছয়তলার ছাদ থেকে লাফ দিল। সকাল আটটার ক্লাসে গিয়ে শুনলাম এ ঘটনা। আমরা দৌঁড়াদৌঁড়ি করে গেলাম। গিয়ে দেখি হারামজাদা মরে নাই। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নারিকেল গাছের ডাইগ্যার মধ্যে পড়ে আটকে ছিল। তবে মেরুদণ্ড গেছে। কয়েকটুকরা হয়ে আধামরা হয়ে হাসপাতালে গোঙড়াচ্ছে। আমরা তাকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে পড়লাম। সারা ক্যাম্পাস ঘুরে তার জন্য ফান্ড কালেক্ট করলাম। ও জীবনে ফিরে এলো। এখনো বেঁচে আছে। বন্ধু আমার আত্মবিনাশের পথে গিয়েও ফিরে এলো আল্লাহর কৃপায়। কিন্তু অনেকেই আর ফিরে আসে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। গতকাল একজন নারী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আজ আমার বাংলা বিভাগের একজন মনজু আত্মহত্যা করেছে। নিজ রুমে সে গলায় মাফলার পেঁচিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করেছে। বাংলাদেশের এরকম একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েও কেন ছেলমেয়েরা আত্মবিনাশের পথ বেছে নিয়েছে তা নিয়ে কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভেবেছে? কোনো গবেষণা তারা করছে? ছাত্র সংগঠনগুলো কি জানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কতোজন ছাত্র আজ রাতে না খেয়ে শুয়ে পড়েছে? তারা কি জানতে চায় কতোটুকু কষ্ট নিয়ে এরা ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ায়? কতো দুপুর তারা সামান্য একটা বিস্কুট অথবা সিঙ্গারা খেয়ে কাটিয়ে দেয়? ছাত্র রাজনীতি কীসের জন্য? নিজেদের পদপদবির জন্য? ভবিষ্যত নমিনেশন পাওয়ার জন্য নিরীহ ছাত্রদের পুঁজি করে এগিয়ে চলার নামই কি ছাত্র রাজনীতি? একুশ শতকের বিবেক কী বলে তা জানা জরুরি। এখানে কি একদল নেতা হবে আরেকদল পিকেটার হবে? কিছু ‘সহমত ভাই’ তৈরি করা ছাড়া গত বিশ বছরে ছাত্র রাজনীতি বাংলাদেশকে কী দিয়েছে সেই প্রশ্ন হতেই পারে! সাধারণ শিক্ষার্থীদের ডিপ্রেশন দূর করে তাদের আলোর পথে আনতে ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যকরী ভূমিকা থাকা উচিত। এখন অনেকেই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলেন। কেন বলেন? সেটির উত্তরও তাদের খুঁজতে হবে। ছাত্ররা রাজনীতি না করলে কারা করবে রাজনীতি? কিন্তু যে ছাত্র জানে না ছাত্র বানান লিখতে ‘ত’ এর সাথে র-ফলা দিতে হয় এবং লিখে ‘ছাএ’ তার কি ছাত্ররাজনীতি করা উচিত?
থাক, বানান ভুলের কথা বলায় আপনারা কেউ মাইন্ড খায়েন না। ‘বানাম’ ভুল দোষের কিছু না। উপরন্তু ‘বানাম’ ভুল করলে পাপও হয় না। এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক জিনাত হুদা ম্যাম বিরাট এক জবাব দিয়েছেন। তাঁর কথা শুনে আজ বাংলাদেশের মানুষ নড়েচড়ে বসছে। তিনি কোনো এক বিবৃতিতে ২৯ টি বানান ভুল ধরার কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন বাংলা একাডেমির ডিজি চেঞ্জ হলে বানানও চেঞ্জ হয়! বানান ভুল শুদ্ধ কোনো বিষয়ই নয়। মানুষ হুদাই খোঁচাখুচি করে। বানান কি খায় না মাথায় দেয়? অসভ্য জাতির কোনো কাজ নাই খালি জ্ঞান দেয়! তিনি কি বেহুদা কিছু বলেছেন? তাঁর নামে আছে হুদা। বেহুদা কথা তিনি বলেন না বলেই আমার বিশ্বাস।
‘নিজেকে ধ্বংস করার জন্য কেউ ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড আনে বারোটি! কোনো দল নিজেরাই নাটক সাজিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের হত্যা করে অকাতরে’- ক্ষমতার মোহে এমন আজগুবি কথাও আমাদের বেঁচে থেকে শুনতে হয় একুশ শতকের বাংলাদেশে ! দায়িত্বশীল পদে থেকেই বাংলার মানুষ দায়িত্বহীন কথা বলে সবচেয়ে বেশি। বাংলার রাজনীতি থেকে প্রতিহিংসা দূর করা দুঃসাধ্য ব্যাপার।
দেশটাকে ছাত্র রাজনীতি যতটা না খাইছে তার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংস করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল-সাদা পার্টি। এইসব বন্ধ হওয়া দরকার সবার আগে! শিক্ষকদের রাজনীতির প্রয়োজন আমি আজো বুঝিনি। আর শিক্ষক সমিতি ভুল বানান আর শুদ্ধ বানান যা-ই হোক জাতির ক্রান্তিকালে তারা বিবৃতি দেওয়ায় ওস্তাদ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের কাছে আস্থাভাজন হওয়ার জন্য এর বিরোধিতা করে সকল শিক্ষক সমাজ বিবৃতি দিয়েছে সবার আগে- মনজোগানো সেই বিবৃতি! (হুমায়ূন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ / ‘মাতাল হাওয়া’ উপন্যাসে এ বিষয়ে লেখা আছে)
জীবনের কাছ থেকে পালিয়ে আসলে মুক্তি নেই। জীবনের মোকাবেলা করাই জীবনের ধর্ম। মনজুকে এ কথাগুলো তাঁর কোনো শিক্ষক বা ছাত্র সংগঠনের কেউ বলেছিল কি?