প্রথম পাতা » গল্প » আমার বেতেরবেলা

আমার বেতেরবেলা

poet

স্কুলে প্রথম মার খেয়েছিলাম ক্লাস ওয়ানে। আমার প্রাথমিক জীবনের শিক্ষক ছিলেন আবদুল ওয়াহাব স্যার। তিনি ছিলেন সাক্ষাত আজরাইল। তাঁর হাতে বেত দেখলেই আমাদের গলা শুকিয়ে প্যান্ট ভিজে যেতো। রাস্তাঘাটে চলতে কিংবা বাজারে গেলে একটাই টেনশন হতো স্যার দেখে ফেলেন কি না? আমরা তাঁকে দেখা দিতে চাইতাম না। তাঁর রুদ্রমূর্তি আজো চোখে ভাসে। তাঁর ধমকেই পিলে চমকে যেতো। একদিন স্যার আমাকে ব্ল্যাকবোর্ডে যেতে বললেন। স্যার বললেন : ‘বৈশাখ’ লেখ্। আমি ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম। এমন শব্দ জীবনেও শুনেছি বলে মনে করতে পারলাম না। অথচ একটু আগেও মনে হয় পড়ছিলাম। আসলে স্যারের চোখে হঠাৎ চোখ পড়ে যাওয়ায় সব আউলা ঝাউলা লাগছিল। সাহস করে লিখে ফেললাম। ব-তে ঐ-কার না দিয়ে মনে হয় ঔ-কার দিয়েছিলাম! ‘বৌশাখ’ লেখার অপরাধে সেদিন আমার পশ্চাদদেশ ফুলে গেলো। বাড়িতে বলার সাহস কোনোদিন হয়নি। আমাদের আব্বা আম্মা মনে করতেন ছেলে বেহেশতে না গেলেও তার ‘পশ্চাতদেশ’ বেহেশতে যাবে। স্যাররা যেখানে বেতান সেই জায়গাগুলো আগের কালে বেহেশতে যেতো। তারপর অনেকদিন স্যার বেঁচে ছিলেন। রাস্তায় দেখা পেলে দাঁড়াতেন। কতো স্নেহের পরশ বুলাতেন! স্যার আজ আর নেই। আমার যা কিছু অর্জন তাতে বহুলাংশে আমার এই শিক্ষকের অবদান রয়েছে। আমি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন জান্নাতে যান। তাতে তাঁর যদি কিছু নেকি কম হয় আল্লাহ যেন আমার কোনো ভালো কাজের বিনিময়ে প্রাপ্ত নেকিটুকু তাঁকে দিয়ে দেন। আমার পড়ালেখার জীবনটা শুরু হয়েছিল ব্র্যাক স্কুলে। সেখানে আমি বছর দুয়েক পড়েছি। আমার মা বাবা নিরক্ষর ছিলেন। ওয়াহাব স্যার আমার হাতেখড়ি দিয়েছিলেন। আমি কেন জানি তাঁর মতো শিক্ষক হতে চেয়েছি। আমি জানি, সেটা আমি পারিনি।

প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে প্রথম মার খেয়েছিলাম প্রেমঘটিত ব্যাপারে। কমরউদ্দিন স্যার আমাকে মেরে শুয়ায়ে দিলেন। উনি ছিলেন আরেক যমদূত! স্যারের বেতমারা ছিল জগত-বিখ্যাত। আমরা তাঁকে ডাকতাম ‘গাওয়াইর স্যার’। তিনি গাওয়াইর নামক এলাকায় থাকতেন বলেই এই নামকরণ। স্কুলে তাঁর নামে বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খেতো। স্যারের জোড়াবেতের আঘাতে সেই যে প্রেম পালিয়েছিল বহুবছর আর কাছে ঘেঁষেনি।

হাইস্কুলে আমি প্রথম থাপ্পর খাই গাজী স্যারের। গাজী স্যার ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি। কী একটা অঙ্ক না পারার অপরাধে সশব্দে মারা চড়ে আমি খাবি খেলাম। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সময় স্যার ধরে ফেললেন। কী মনে করে বুকে নিলেন। এরপর শুধু স্নেহই পেয়েছি। এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত আর কোনোদিন গাজী স্যারের মার খাইনি। অঙ্কেও বেশ পাকা হয়ে উঠলাম। গাজী স্যারের মার খেয়েও যারা স্কুল ছাড়েনি তাদের জীবন এগিয়ে গেছে। যারা স্কুল ছেড়েছিল তারা হারিয়ে গেছে। গাজী স্যার আমার জীবনটা গড়ে দিয়েছিলেন অনেকটা। আমি তাঁর কাছে চিরঋণী।

একদিন পিটি করার সময় এক বড় ভাই আমার নামে ইংরেজির নতুন স্যার সাইফুল স্যারের কাছে বিচার দিল। স্যার আমাকে কিছু না জিজ্ঞেস করেই মারতে শুরু করলেন। আমি মনে মনে ত্রিশটা পর্যন্ত গুনেছিলাম। এরপর হুঁশ ফিরলে দেখি আমার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। অন্য স্যাররা সাইফুল স্যারকে তিরস্কার করলেন। আমি তখনো ফার্স্টবয়। সবার কথা শুনে স্যার লজ্জিত হলেন। আমাকে আদর করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি চলে গেলেন। তাঁর সাথে আমার আর কোনোদিন দেখা হয়নি। জানিনা তিনি কেমন আছেন।

ক্লাস এইটে পড়ার সময় শ্রদ্ধাভাজন মতিউর স্যারের মার আমার জীবন ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তখন কী একটা ঝামেলায় আমি কয়েকদিন স্কুলে আসিনি। অথচ আমার বৃত্তি পরীক্ষা সামনে। স্যার ইংরেজিতে প্যারাগ্রাফ লিখতে দিলেন। আমি বানিয়ে বানিয়ে লিখলাম। লেখাটা মনে হয় ততটা খারাপ হয়নি। কিন্তু স্যার টার্গেট করে ছিলেন আমাকে মারবেন। খাতা নিলেন। কয়েকটা বানান ভুল হলো। দুটো বেত একসাথে করে ডানহাতের কবজির ওপরে একটা আঘাত করলেন। সাথে সাথে রক্ত বন্ধ হয়ে হাত সাদা হয়ে গেলো। একই জায়গায় আরেকটা মারার পর রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হলো। আমি বেঁচে রইলাম। এরপর ইংরেজিটা পড়া শুরু করলাম। বিশ্বাস করেন ঐ সময়ে গড়ে ওঠা ইংরেজির বেসিক দিয়েই বিসিএস পর্যন্ত কাম সারলাম আমি!

এরপর আর কোনোদিন বেতেরবারি আমি খাইনি। স্কুল শেষ করে কলেজ, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়। পড়ালেখা শেষ করে কর্মজীবন চলছে। আমার অসংখ্য শিক্ষক এ জীবনের পলে পলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন। তাঁদের স্নেহের ছায়াতলে থাকতে আমার খুব ইচ্ছা হয়। আমি আবার পৃথিবীতে আসতে চাইলে তাঁদের স্নেহঋণেই বাস করতে চাইবো। কলেজ জীবনের উপল তালুকদার স্যার, সাইদুর রহমান স্যার, পারভীন আপাদের জীবনাদর্শ আমাকে বারবার করেছে উজ্জীবিত। আমি তাঁদের মতোই হতে চেয়েছি। আর কিছুই হতে চাইনি, হইনিও।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পেয়েছি স্বনামে উজ্জ্বল শিক্ষকবৃন্দের সান্নিধ্য। বিশেষ করে গিয়াস শামীম স্যার, সৈয়দ আজিজুল হক স্যার, ভীষ্মদেব চৌধুরী স্যার, রফিক উল্লাহ খান স্যার, সিরাজ স্যার, আকতার কামাল আপাদের বিদগ্ধ চিন্তার জগত আমাকে আলেড়িত ও আন্দোলিত করেছে প্রতিনিয়ত এবং এখনো তার নির্যাস রয়ে গেছে। আল্লাহ যেন আমার শিক্ষকবৃন্দের সকলকে উত্তম পুরস্কার দান করেন সেই প্রার্থনা করি অবিরাম।

আমি শিক্ষকতায় প্রবেশ করেছি বেতহীন এক সুন্দর জগতে। তবে কিছুকথা তবু রয়ে যায়। আমি চাচ্ছি না যে বেতের যুগ আবার ফিরে আসুক। কিন্তু এটুকু চাইতে দোষ নেই যে বিগত কালের শিক্ষকতা পেশার সম্মানটুকু নষ্ট না হোক। আমাদের কালে শিক্ষকদের দেখলে আমরা তটস্থ থাকতাম। একালে মনে হয় শিক্ষকদের তটস্থ থাকতে হয় শিক্ষার্থীদের দেখে। মনে নানারকম ভয়, শঙ্কা, সন্দেহ অবিরত। আমাকে কথা বলতে হয় চিন্তা করে। আমি যা বলছি তা কি আমার শিক্ষার্থীদের পছন্দ হবে কি না? জ্ঞান বিতরণে একালে একটা পরিবর্তন আসাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে পরিবর্তনটা যদি হয় বিধ্বংসী তাহলে শিক্ষকের দাঁড়াবার জায়গাটা কোথায়? শিক্ষকরা এ যুগের নিধিরাম সর্দার। ঢাল নাই, তলোয়ার নাই যার। এ রাষ্ট্র শিক্ষকদের উন্নয়নে কোনোদিন এগিয়ে আসেনি। সমাজ আসেনি। শিক্ষকের জীবনমান নিয়ে এখানে গবেষণা নেই। এর কারণ একটা হতে পারে এই যে, আমাদের কর্তাব্যক্তিদের সোনার সন্তানরা এদেশে পড়ে না বললেই চলে। বাজেটে শিক্ষার বরাদ্দ সবচেয়ে কম। আমরাও রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেটা’ কবিতার মতো শিক্ষার্থীদের ‘মনের কথাটি’ হয়তো বলতে পারিনি। কিংবা পারিনি তাদের সবহারানো ট্রাজেডিটি ধরতে। কিছু দায় আমাদেরকেও নিতে হবে বৈকি।

এ সময়ে সবচেয়ে হতাশার বিষয়টি হলো স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করা হচ্ছে। যে সময়টি শিক্ষকের স্নেহছায়ায় জীবনগড়ার কথা সে সময়ে এরা ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসায় জর্জরিত হচ্ছে। পিতৃ-মাতৃতুল্য শিক্ষকদের শরীরে হাত তুলতেও এরা পিছপা হচ্ছে না। এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জায়গাটা বিনষ্ট হলে আমাদের সন্তানরা আর শিখবে কোথায়? আমাদের পরিবারগুলো তো আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। বহুমাত্রিক হতাশায় পারিবারিক জীবন এখন নড়বড়ে।

এই অসূয়াবিষ থেকে বের হতে জাতির রক্ষাকবচটি কে দেবে?

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *