প্রথম পাতা » শিক্ষা » আশার ছলনে ভুলি

আশার ছলনে ভুলি

poet

২০১৬ থেকে ২০২৪ ! মাঝে কেটে গেছে আটটি বছর ! আট বছর পেরিয়ে নবম বর্ষে পদার্পণ হলো সরকারি চাকরিতে ! বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে আটটি বছর পার করার পর এই শিরোনামে একটা লেখা লিখতে হবে চাকরিতে প্রবেশের আগে মনে হয়নি। তবে আজ লিখতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশা একটি অভিশপ্ত পেশার নাম। এ পেশা সৃষ্টি করে অহেতুক কুহক আর অর্থহীন কথার পেশাদারিত্ব। ধরে নেওয়া হয়, যারা অন্য কোনো চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পায় না তারা এ পেশায় আসে। এদেশে শুধু শিক্ষকরা ছাড়া আর সবাই ‘শিক্ষক’ ! আপনি অভিভাবকের কাছে গেলে জ্ঞান দিবে, শিক্ষা অফিসে গেলে জ্ঞান পাবেন, এসপি, ডিসি, পোস্টমাস্টারসহ যার অফিসে যাবেন সবখানেই ফ্রিতে জ্ঞান বিতরণ করতে দেখবেন। কোনো জায়গা থেকেই কেউ খালি হাতে আপনাকে ফেরাবে না। এখন তো ছাত্ররাও জ্ঞান দেয়! বেচারা শিক্ষককে শিক্ষা দেওয়ার জন্য পুরো জাতি যেন প্রস্তুত। এ জাতি শিক্ষকের চরিত্র বেঁধে দিয়েছে এমন : ‘শিক্ষককে হতে হবে নির্লোভ। তার অর্থের লালসা থাকবে না। সে থাকবে নিঃস্ব, কপর্দকহীন। তার নুন আনতে পানতা ফুরাবে। ভাঙা ছাতা তার নিয়তি। অল্প বেতন তার রিজিক। তার গাড়ি থাকবে না, বাড়ি থাকবে না। ছাপোষা সংসারে সে হবে অতি সাধারণ একজন। তার না থাকবে চ্যাতভেদ, না থাকবে মন-মেজাজ। সে হবে সমাজের সবচেয়ে মেন্দামার্কা গোবেচারা। ঢোঁড়াসাপ টাইপ- করে নাকো ফুঁসফাঁস, মারে নাকো ঢুসঢাস!’

আমার জানা মতে, বহুলোক শিক্ষকতাকে ভালোবেসে এসেছেন। পরে ছুটে যাওয়ার জন্য ব্যাকুলও হয়েছেন কেউ কেউ। কারো ভাগ্য ভালো তারা চলে গেছেন। কেউ বা পড়ে আছেন। আবার কেউ বা যেতে চাননি। আশায় বুক বেঁধে আছেন। হয়তো একদিন সব ঠিক হবে !

বাংলাদেশে কোন মাধ্যমের শিক্ষক ভালো আছে? আমার জানা মতে দুইজন শিক্ষক, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সরাসরি স্যার যাঁরা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার দুই এক বছরের মাথায় অসুস্থ হয়ে হাত পেতেছেন! বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যদি সারাজীবন চাকরি করে পাঁচ দশ লাখ টাকার চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে না পারেন বা তার জন্য সরকারি অনুদান না থাকে তাহলে মানুষ এ পেশায় কী করতে আসবে? কেন এদেশের মেধাবীরা মেডিক্যাল, বুয়েট পাশ করে পুলিশ, এডমিনে চাকরি নেয়? এ জাতি কি কখনো জানতে চেয়েছে মেডিক্যালে এতো বছর পড়ে, জনগণের টাকায় ডিগ্রি নিয়ে চিকিৎসাসেবা বাদ দিয়ে সে কেন যায় পুলিশের চাকরিতে? কেন তাকে এ সুযোগ দেওয়া হয়? একজন যেকোনো অনার্সপাশ ছেলেইতো সারদায় ট্রেনিং নিয়ে পুলিশে ভালো করতে পারে। একজন ডাক্তার হতে কী পরিমাণ মেধা, ত্যাগ ও খরচের প্রয়োজন তা কি কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখেনি? এই অপচয়গুলো কেন হয় এদেশে? কেন সাধারণ মানুষকে প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়?

প্রাইমারির একজন শিক্ষকের বেতন কাঠামো কেমন? একজন শিক্ষক কি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর সমান হতে পারে? কেন এতো বছরেও তাদের মর্যাদাকে আরেকটু বাড়ানো গেলো না?

হাইস্কুলগুলো এদেশের অসহায় এক রুগণগোষ্ঠীর আর্তনাদের সবচেয়ে করুণ জায়গা। এদেশে সবচে খারাপ আছে এমপিওভুক্ত স্কুলের শিক্ষকরা। টাউটশ্রেণির লোকেরা আবার এর ম্যানেজিং কমিটি! নানা চাপে পিষ্ট আমার বহু শিক্ষক আধা-পাগল হয়ে গিয়েছিলেন চাকরিতে থাকা অবস্থায়ই! কী মারাত্মক কষ্টের জীবন ছিল তাঁদের! আমি দেখেছি কতো কষ্ট তাঁরা করেছেন ! আজো কি আঁধার কেটেছে?

২০১৬ সালে, রাজধানী ছেড়ে, ঢাকার বুকে ৫২ একরের ভূ-স্বর্গ ছেড়ে সরকারি কলেজে যোগদান করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ গল্পের মতো বিরাট ছিড়ুখাঁ হতে চেয়ে হয়েছি ‘ভাঙা স্কুলের সহকারী শিক্ষক’! মাটসিনি গারিবালডি হওয়ার পরিবর্তে সে যেমন হয়েছিল ফেরারী প্রেমিক আমি তো তা-ও হতে পারিনি। তবে খুব আফসোস আর করি না। এটা ভেবে খারাপ লাগে যে, এমন অনেক তারুণ্যের শক্তিকে দেশ অচল করে রেখেছে যারা এদেশটা গড়তে পারতো সুন্দর সুখময় রূপে। আজ আট বছর পরও একটা প্রমোশন পেলাম না। অথচ সকল শর্ত পূরণ করে রেখেছি সেই কবে! আট বছর ধরে উপজেলায় পড়ে থেকে নিজেকে ভোঁতা বানিয়ে ফেলেছি। অথচ তিন বছর পর পর স্বাভাবিক বদলী হতে পারতো ! হয়নি। কেন হয়নি জানি না !

আমার হতাশা কখনো ক্লাসে আমার শিক্ষার্থীদের সামনে প্রকাশ করিনি। করবোও না। তাদের বরং স্বপ্ন দেখতে বলি দেশ নিয়ে, ক্যারিয়ার নিয়ে। অনেক হতাশা থাকলেও তাদের আমি পরম মমতায় পড়াই ‘বায়ান্নর দিনগুলো’ কিংবা ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’! ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার চেয়ে আমার দেশ আমার কাছে বড় ! দেশকে কতোটুকু ভালোবেসে আমি পাঠদান করি সেকথা আমার শিক্ষার্থীরা বলতে পারবে।

এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা দিনে হতাশার কথা শোনানো অভিপ্রায় ছিল না। কেন যেন এসে গেলো ! চাইলেও আর আনন্দ আসে না, হাসিও নয়। হাসি-আনন্দ আসলে আত্মার প্রতিধ্বনি !

আমার জন্য দোয়া করবেন। অর্পিত দায়িত্ব যেন যথাযথ পালন করতে পারি। আল্লাহ সহায় হোন।

শিক্ষা থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *