২০০৫ সালের ঘটনা। আমি তখন আদমজী ক্যান্ট. কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। আমাদের ক্লাস একেবারে শেষের দিকে। একদিন বাংলার পারভীন আপা এলেন ক্লাসে। আমাদের একটি ভাবসসম্প্রসারণ লিখতে দিলেন : দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা…
সবার আগে আমি লেখা জমা দিলাম। আপা পড়লেন এবং আমাকে দাঁড় করিয়ে বললেন : ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তোমার জন্য একটি সিট বরাদ্দ থাকবে। এটি আমার বিশ্বাস।’
আপার কথায় সেদিন খুব মন খারাপ হলো! আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখি কিন্তু বাংলায় পড়ি এমন স্বপ্ন কখনো দেখিনি। আমার ইচ্ছা ছিল…! থাক, সে কথা। যা হোক আমার পরীক্ষার পর পরই আমাদের এলাকার এক অতি সুন্দরী রমণীর বিয়ে হয়ে গেলো। এলাকার সুন্দর মেয়ের বিয়ে হলে আমার মন খারাপের কী কারণ তা আমি জানি না। আমার মনে হলো আমি ছ্যাকা খাইলাম! পড়ালেখা আমার কাছে বিষময় মনে হলো। ভর্তি কোচিং এ একদিন গেলে দুইদিন যাই না। পরীক্ষা দেই না। মনে হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েই আর কী হবে! তার তো বিয়ে হয়েই গেলো! তারপরও পরীক্ষা দিলাম। দুই একদিন পরই পত্রিকায় রেজাল্ট বেরুলো। পাশ করেছি। ১৪৩৯! সাধারণ জ্ঞানের মার্কস গেছে কানের কাছ দিয়া গুলি যাওয়ার মতো! ২১.৫! শুধু পাশ যাকে বলে। ইংরেজিতে ১৬! আর বাংলায় ২৫! বাংলা আমাকে ছাড়ল না! ছোটবেলা থেকেই নাটক করতাম। বন্ধু ও ভাইয়ের পরামর্শে জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্তটি সেদিন অবলীলায় নিয়ে ফেললাম। আমি বাংলায় ভর্তি হলাম। পারভীন আপার ভবিষ্যৎ-বাণী সত্যি হলো। আদমজী কলেজে কয়েকদিন পার্টটাইম ক্লাস নিতে গিয়ে পারভীন আপার কলিগ হলাম। তাঁকে ২০০৫ সালের ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। আপা হয়তো মনে করতে পারেননি কিন্তু পুরো ঘটনা শুনে তিনি হকচকিয়ে গেলেন। তাঁর চোখে জল তখন চকচক করছিল!
বাংলায় ভর্তি হওয়ার পর সবচেয়ে বড় যে বিপদ তা হলো বাংলার কোনো ইংরেজি নাম নেই! কেউ সাবজেক্ট জিজ্ঞেস করলে নৃবিজ্ঞানকে Anthropology, অপরাধবিজ্ঞানকে Criminology এমনি সব বিষয়ের নাম ইংরেজিতে বলা যায় কিন্তু বাংলা বলতে হয় ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে। সবাই প্যান্টের দিকে তাকায়! পায়জামার সাইজ আনিসুজ্জামান স্যারের শ্যাপে হইছে কি না তাই দ্যাখে। কথা বলতে গেলে সবাই ভাবে আহমদ শরীফ কিংবা হুমায়ুন আজাদের ডুপ্লিকেট কি না! কী যন্ত্রণা!!! বাংলা অঞ্চলে আহমদ শরীফ কি দুবার জন্মে? ওতো সাহস আর কোনো বাঙালির আছে কি???
যাই হোক, ডিপার্টমেন্টে অসাধারণ কিছু শিক্ষক, বন্ধু পেলাম। জীবনটা ভালোই কাটছিল। পড়ালেখা তো আর সারাজীবন করার জিনিস না। একসময় ইস্তফা দিয়ে চাকরগিরি করা লাগে। আমিও পড়ার পাঠ চুকিয়ে চাকরির বাজারে প্রবেশ করলাম। দেখা গেলো পড়ানো ছাড়া আমার তেমন কিছু ভালো লাগে না, পারিও না কিছু। মিরপুরের শহিদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ এবং শেষে বিসিএস সাধারণ শিক্ষায় এসেও চাকরিটা উপভোগ করি। এদেশে শিক্ষকরা ছাত্রদের পড়াতে ভয় পায়। যা বলা দরকার তা বলে না। কিন্তু আমি বলি। বাংলা পড়ে অন্তত মুদ্রার দুটো পিঠই চেনার এবং দেখার চেষ্টা করি। আমার প্রাণের শিক্ষার্থীদের সেভাবেই বলার চেষ্টা করি। কিন্তু জ্ঞান দান সাপেক্ষ নয়, গ্রহণ সাপেক্ষ। আজকাল ওয়াজ, নসিহত, আখিরাত, পরকাল এতো সহজেই হাতের কাছে যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক বা শিক্ষা কোনোটাই আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। ধর্মহীন ধার্মিকের সংখ্যা এতো প্রবল যে প্রচলিত মতের বাইরে যাওয়া রীতিমতো যুদ্ধজয়! পরীক্ষাহীন, ফেলহীন, অধ্যয়নহীন এক মোবাইলপ্রজন্ম পুরো জাতিকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। এরা ধর্মান্ধ তাই দেশে এতো অধর্ম, এরা প্রতিক্রিয়াশীল তাই দেশে ঘোর অমানিশা। এরা আত্মবিনাশের মধ্য দিয়ে জাতিকে চরমভাবে দেউলিয়া করে দিচ্ছে। এদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ কোনোটাই নেই। কর্মহীন, ধর্মহীন, নীতিহীন এক আজব প্রজন্ম। এরা বেড়ে উঠছে নসিহতের ময়দানে, হিংসার ছায়াতলে, প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে। ধর্মচর্চাও এদের মনোজগতকে বিকশিত করতে পারেনি।
এমন এক প্রজন্ম নিয়েই আমাদের দিনন গুজরান। চলছে, চলবে হয়তোবা। তবে ক্লাসে পড়িয়ে তেমন আনন্দ আর পাই না। আমার সামনে বসে থাকে এক ঝাঁক মেন্দামার্কা মৃতজীবী। এদের স্বপ্ন নেই, উচ্ছ্বাস নেই, প্রাণচাঞ্চল্য নেই। মোবাইল এদের মাথাকে নিচু করেছে। জীবনীশক্তির পুরোটাই শুষে নিয়েছে জাগ্রত রাত। রাত এখন এদেশে আর স্রষ্টার রহমত নিয়ে আসে না। রাত আসে আরো গভীরতর রাত হয়ে!
আমার একজন সদ্য পাশ করা ছাত্র সেদিন পরিচিত একজনের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবজেক্ট চয়েসের ব্যাপারে কথা বলছিল। বাংলা বিষয় পড়ার কথা এলে ছাত্রটি দ্বিধায় পড়ে যায়। তার বক্তব্য বাংলা পড়লে লোকজন কেমন যেন নাস্তিক টাস্তিক হয়!
হায়রে কপাল! সত্য কথা তবে নাস্তিক্যবাদ? দেশপ্রেম, সাম্যবাদ, নারীর অধিকারের বয়ান, মানবতাবাদের কথাগুলো কি ঈশ্বরবিদ্বেষী? জীবনের গান গাওয়া, জীবনের প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তোলার মন্ত্র কি কেমন কেমন হয়ে যাওয়ার ইশারা?
এভাবেই চলছে দেশ। বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের থিওরি পড়াবে কিন্তু সে-ও ধর্ম কচলায়, গণিতবিদও ধর্ম কপচায়, ইতিহাসবিদও ধর্মের কড়চা গায় তাহলে বাংলাবিদরা ধইনচা না হয়ে যাবে কোথায়? সাহিত্য সমাজ, মানুষ, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান সবার কথা বলায় যে!
এদেশে শিক্ষার্থীদের ধর্মান্ধ করার ক্ষেত্রে বৃহৎ একটা কৌশল করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকদেরই একাংশ। অথচ শিক্ষকের কাজ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা।