প্রথম পাতা » শিক্ষা » একালে আমাদের কাল

একালে আমাদের কাল

teaching

প্রথম জীবনে প্রেমে আমার তেমন আস্থা ছিল না। তাই ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় একদিন টিফিনের সময় সরাসরি আমার ক্লাসের এক অতি রূপবতী মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেই। মেয়েটি আমার কথা শুনে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বলল টিফিনের পর এই বিষয়ে বিস্তারিত কথা হবে। প্রবল উত্তেজনায় টিফিন না খেয়েই আমি ক্লাসে বসে আছি। টিফিন শেষ হলো। ক্লাসে ম্যাডাম এলেন। আমি তার পাশের বেঞ্চে বসে মাঝে মাঝে তার দিকে তাকাই। সে আবারো মুচকি হাসে। ভাবলাম ঘটনা ঘটে গেছে। বিয়ের আর দেরি নাই! অর্ধেক ক্লাসের সময় পিওন রফিক ভাই আমার নাম ধরে ডাকলেন। জানালেন লাইব্রেরিতে স্যার ডেকেছেন। আমার আত্মাহিয়াতু শুকায়ে কাঠ! দেখলাম বিবাহের কন্যা তখনো হাসছে! আমি লাইব্রেরির দিকে হাঁটছি। মনে হচ্ছিল পুলসিরাত পার হচ্ছি। দেখলাম ‘গাওয়াইর স্যার’ (স্কুলের দুর্ধর্ষ স্যারের নাম ছিল কমরউদ্দিন। তিনি গাওয়াইর নামক এলাকায় থাকতেন। তাঁকে দেখলে বাঘে মহিষে একঘাটে জল খেতো) বসে আছেন। সামনে বেতের ঝাড়! আমাকে দুই চার কথা জিজ্ঞেস করার পরই ঘটনা ঘটতে শুরু করল। যখন জ্ঞান ফিরল দেখলাম আমার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে! মাইরের চোটে দার্শনিক বনে গেলাম। সেদিন বুঝেছিলাম অতি রূপবতী মেয়েরা জগতে নিষ্ঠুরতা নিয়ে জন্মায়! আমার বিয়ের ভূত সন্ধিবেতের তাড়া খেয়ে সেই যে পালালো!

প্রাইমারি পাশ করে হাইস্কুলে গেলাম। সেভেনে পড়ার সময় একদিন অ্যাসেম্বলিতে এক ভাইয়ের সাথে সামান্য তর্ক করলাম। তখন ইংরেজির এক নতুন স্যার এসেছেন। তাঁর হাতে সারাদিনই বেত থাকত। ঐ ভাইটি সেদিন স্যারকে আমার নামে বিচার দিল। তিনি আমার সামনে এলেন। নাম কী, বাড়ি কৈ এমন তিন চারটি প্রশ্ন করতেই তিনি পঞ্চাশ ছুঁলেন! আমি ত্রিশ পর্যন্ত গুনতে পেরেছিলাম। বাকিগুলো বন্ধুরা গুনেছে। আমি যথারীতি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফেরার পর দেখি ঐ স্যার আমাকে জুস খাওয়াচ্ছেন। আমি ফার্স্ট বয় এবং ভালো ছেলে এইসব তথ্য অন্য স্যাররা তাঁকে দিয়েছেন এবং কিঞ্চিৎ তিরস্কার করেছেন। স্যার কিছুটা লজ্জিত হয়ে আমাকে আদর করলেন। তাঁর সরি সরি ভাব দেখে আমিও কিছুটা লজ্জিত হলাম। এরপর তাঁর সাথে আমার একটা ভালো সম্পর্কও হলো। আমি স্কুল ত্যাগ করার আগেই স্যার ব্যাংকে চলে গেলেন। তবে তিনি আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। যাওয়ার সময় আমাদের ভালোবাসাই নিয়ে গেলেন।

ক্লাস এইটে বেপরোয়া জীবন শুরু হলো আমার। নানা ধরনের নেতিবাচক ঘটনায় জীবনটা পতিত আত্মার মতো হতে লাগল। বৃদ্ধ মতিয়ুর স্যার আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। আমি কয়েকদিন স্কুলে আসিনি। তিনি প্রায়ই আমার খোঁজ করতেন। আমার রোল ছিল এক। একদিন ক্লাসে এসেই আগের দিনের একটি পড়া ধরলেন। আমি পারিনি। স্যার আমার ডান হাতে কব্জির ওপরে একটা আঘাত করলেন। সাথে সাথে হাতের রক্ত চলাচল বন্ধ হলো। হাত সাদা হয়ে গেলো। কী যেন বিড়বিড় করে বলে ঐ একই জায়গায় আরেকটি আঘাত করলেন সজোরে। এবার রক্ত চলাচল শুরু হলো। আমি ঝিমমেরে দাঁড়িয়ে আছি। হাতটা অচল মনে হলো! স্যার কাঁপছেন, আমি কাঁদছি!

মতিয়ুর স্যারের মার খেয়ে আমি জীবনে ফিরলাম। সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক জীবন। পড়ালেখা, স্কুল ছাড়া আর কিছু না। বেপরোয়া জীবন থেকে শৃংখলিত জীবন যাপন। এই ঘটনাটা আমার জীবনকে নতুন দিকে মোড় ঘুরিয়ে দিলো। সেদিন মতিয়ুর স্যারের বেতের আঘাত আমার জীবনের একটি বিরাট আশীর্বাদ হয়ে উঠল।

সমগ্র ছাত্রজীবনে আমি তিনবারই কড়া মার খেয়েছি। বাড়িতে জ্বরে কেঁপেছি। আমার মা-বাবা অশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন স্যারদের আঘাতের জায়গাগুলো জান্নাতে যায়! আমাদের সময় বাবা-মা স্যারদের বলতেন হাড্ডিগুলো পাঠায়ে দিয়েন আর গোশতগুলো আপনাকে দিলাম!

আমাদের কালে শিক্ষকের মারকে নির্যাতন হিসেবে গণ্য করা হতো না। তাই তখন অভিভাবকরা কারো কাছে প্রতিকার চেয়ে এপ্লিকেশন লিখাতেন না। এখন অবশ্য দিন পাল্টেছে। শিক্ষকরা এখন সমাজের মানুষের কাছে নিপীড়ক হিসেবে পরিগণিত!

শিক্ষা থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *