প্রথম পাতা » শিক্ষা » ‘আব্বু, এখানে আসা আমাদের বিরাট ভুল হয়েছে!’

‘আব্বু, এখানে আসা আমাদের বিরাট ভুল হয়েছে!’

Teaching

বাংলাদেশের শিক্ষক-সমাজ কাজী কাদের নেওয়াজ সাহেবের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটার সাক্ষাৎ না পেলে এতোদিনে দমবন্ধ হয়ে পগারপার হয়ে যেতো সেই কবে! আমার ধারণা, কবিতাটা এঁরা প্রায়ই নীরবে নিভৃতে পাঠ করে এবং মোটা ফ্রেমের চশমার নিচে জমা জলবিন্দু পরিষ্কার করে আর মনে মনে আওড়ায় : ‘শিক্ষক আমি সবার সেরা!’ এই একটি বাক্যের মধ্যে আছে রাষ্ট্রীয় যাবতীয় বঞ্চনা আর পরিহাসের বাণী। এদেশে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী! যেদেশের শিক্ষকদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেদেশে শিক্ষকরা সবার সেরা কেমনে? দামি পাজেরো গাড়ি কিংবা বিএমডব্লিউ থেকে নেমে কোনো একজন ছাত্র পায়ে ধরে সালাম করে আবার ভোঁ দৌঁড় দিলেই আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। পরদিন কদমবুসির ছবি ছাপা হয় ফ্রন্ট পেজে! শিক্ষক বেচারা তারো পরের দিনের বাসি পত্রিকা হাতে নিয়ে কাঁদতে থাকেন। এদেশের শিক্ষকরা বেঁচে থাকে ‘কদমবুসির’ ডামাডোলে।

বাংলাদেশের শিক্ষাখাতের মতো রুগ্ণ খাত পৃথিবীতে আর একটিও আছে বলে আমার মনে হয় না। এদেশে কখনো কোনো শিক্ষক শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। এখানে শিক্ষকরা গরিবের সেই বৌয়ের মতো যার কাছে পাড়ার সকল চ্যাংড়া পোলাইন ভাবির দাবি নিয়ে আসে! বঙ্গবন্ধুর সরকারে শিক্ষকদের অংশীদারিত্ব ছিল। তিনি শিক্ষকদের মর্যাদা দিতেন। তাঁর পরে আর কোনো সরকারে এমনটা দেখা যায়নি। একদল চাটুকার কৌশলে শিক্ষকদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে সরকারের মূলস্রোত থেকে। সেদিনকার জাতীয় অনুষ্ঠানের বানান ‘বিভ্রাট’ অশনি সংকেত বলেই মনে হয়েছে আমার।

অন্ধের শহরে আয়না বিক্রির মতো মৃত আর নির্জ্ঞান সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছেন শিক্ষকরা। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে যতটা যত্ন নিয়ে দেশপ্রেম ও মূল্যবোধের দীক্ষা দেন তাতে একটি লেকচারের মূল্য এ জাতি কোনোদিন শোধ করতে পারবে না।

তবু এদেশে শিক্ষকরাই বারবার আক্রান্ত হন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমাদের মহান শিক্ষাবিদগণ অকালে শহিদ হয়েছেন পাকিস্তানিদের দ্বারা। কিন্তু ৯৯১ জন শিক্ষকের তালিকা করেছিল এদেশরই ছাত্ররা! এখানে ছাত্ররাই তাদের শিক্ষকদের ওপর ‘ময়লা হামলা’ করে, টুটি চেপে ধরে, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে, টিজ করে, কখনো মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এদেশে শিক্ষকতা সবচেয়ে মানসিক চাপের চাকরি হিসেবে পরীক্ষিত সত্য। এদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক-শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত ভোগেন ‘পদাতঙ্ক’ রোগে। ছাত্রদের ‘ম্যানেজ’ করে তাঁদের সেই রোগের ভয় দূর করতে হয়! এখানে নকল করা ছাত্রদের ‘পবিত্র অধিকার’ এর পর্যায়ে পড়ে! সেই অধিকারে ব্যাঘাত হলে তারা ‘প্রতিবাদী’ হয়ে ওঠে। ‘দেখে নিব’, ‘হল থেকে বের হন’, ‘বাড়ি কই’ প্রভৃতি শ্রাব্য অশ্রাব্য বাক্যবাণে জর্জরিত বেচারি শিক্ষক খাতা আর প্রশ্ন দিয়ে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করেন আর সার্টের হাতায় চোখ মোছেন কদাচিৎ। শিক্ষকতা পেশায় আট বছর ধরে আছি। ‘কালের সাক্ষী বটগাছের’ মতো অনেক ঘটনার সাক্ষী আমি।

গত দুদিন আগে বগুড়ায় একজন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষক-কর্মকর্তা একটি পরীক্ষা কক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। সেখানে শুরুতেই অনেকে নকল করছিল। তিনি কঠোরভাবে নকল নিয়ন্ত্রণ করেছেন। নকলের সুযোগ না পেয়ে একজন মেয়ে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনে। শিক্ষক নাকি তার কনুইয়ে হাত দিয়েছে! কনুই আসলে কোনো যৌনাঙ্গের মধ্যে পড়ে কিনা সেটা যৌন-বিজ্ঞরা বলতে পারবেন। পঞ্চাশজন শিক্ষার্থীর সামনে একজন শিক্ষক ছাত্রীর কনুই ডলাডলি করে তার যৌনতৃষ্ণা দূর করবেন এতোটা যৌনপ্রিয় তার হওয়ার কথা না। ঐ রুমে থাকা অন্য অনেকেই সাক্ষ্য দিয়েছে যে, এমন অপ্রীতিকর ঘটনা আসলে ঘটেনি। অধ্যক্ষ, অন্যদের বক্তব্য শুনে আমার মনে হয়েছে বিষয়টি খুবই পরিকল্পিত এবং উদ্দশ্যমূলক। এতে অভিভাবকরা ‘এক’ হয়েছেন, ছাত্রনেতারা ‘ন্যায়বিচার’ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন!

মিডিয়ার সামনে ঐ শিক্ষককে আনা হলে অনেকেই তাকে মারার জন্য তেড়ে আসে। তাকে ধমকাধমকি, গালিগালাজ করা হয়। সেসময় শিক্ষকের চার বছরের মেয়েটিও সাথে ছিল। এহেন পরিস্থিতিতে মেয়েটি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায় এবং কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে : ‘আব্বু, এখানে আসা আমাদের বিরাট ভুল হয়েছে! আমাদের সাথে সবাই এমন করছে কেন?’ এই মেয়েটি যে মানসিক যন্ত্রণাটা পেলো তা কি সে কোনোদিন ভুলতে পারবে? সে কি কোনোদিন ভুলবে যে, কোনো একদিন তার সামনেই তার বাবাকে মারতে উদ্যত হয়েছিল একদল অ-বিবেচক লোক ! প্রত্যেক সন্তানের কাছে তার বাবাই হিরো। এই মেয়েটির সামনে তার বাবাকে যে অসম্মান করা হলো তাতে মেয়েটির মন থেকে তার বাবার অসহায়ত্ব কোনোদিন ঘুচবে না।

এই ঘটনায় ছাত্রনেতাদের ভূমিকা আমাকে আশার আলো দেখিয়েছে! বাংলার ছাত্রী-অভিভাবকরা এবার নড়েচড়ে বসবেন! তারা ‘মাঠে’ থাকবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তারা যদি সত্যিই ‘মাঠে’ থাকে তাহলে বাংলার নারীদের অনেক দুঃখ ঘুচবে অনুমান করি। আর ‘মাঠে’ থাকার পাশাপাশি তাদের কিন্তু ক্লাসেও যেতে হবে বৈকি! সবসময় ‘মাঠে’ থাকলে ছাত্রনেতা বহাল থাকবে কী করে!

ঢাকার নামিদামি এক কলেজের ঘটনা: একজন তরুণ শিক্ষক নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। সব কিছুতে তার কৌতূহল। একেকটা ছাত্রকে একেকটা প্রমিথিউস বানাতে চান! রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ গল্পের নায়কের মতো! একদিন তার ক্লাস ছিল তিনতলায়। ঘণ্টা বাজল। সেদিন ভাবি প্রমিথিউসদের বস সেই তরুণ শিক্ষক অপেক্ষার উত্তেজনায় কখন যে তিনতলা ক্রস করে পাঁচতলায় চলে গেলেন টেরই পেলেন না! পাঁচতলার সিঁড়ির ওপরে দুজন রোমিও জুলিয়েট ক্লোজড হয়ে বসা! এরা হয়তো বা লদকা-লদকি টাইপ কিছু করছিল। তরুণ শিক্ষক এদের পাকড়াও করলেন। নিয়ে গেলেন অধ্যক্ষের কাছে। বিরাট সালিশ বসলো। অভিভাবক আনা হলো। হালকা পাতলা মিঠাই ঢঙের একটা বিচার হলো। এদিকে রাজ সাক্ষী হওয়ায় তরুণ শিক্ষকের সেদিনের ঐ ঘণ্টার ক্লাসের সময় পার হয়ে গেলো। পরদিন সেই শিক্ষকের নামে শোকজ এলো ! নিজের ক্লাস বাদ দিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি ও ক্লাস না নেওয়ার দায়ে তার একদিনের বেতন কাটা হলো! ঘটনাটির জুলিয়েট ছিল কোনো ‘বড়কর্তা’র আদরের মেয়ে! তার ‘দুধের মেয়ের’ (ছোট বাচ্চা অর্থে) নামে এমন অভিযোগে কত্তা খুব চটেছিলেন। ‘পদাতঙ্কে’ অধ্যক্ষ শোকজ ও বেতন কাটতে বাধ্য হয়েছিলেন!

ভুক্তভোগী শিক্ষকের ছোট্ট কন্যাটির মতো বলতে হয় : বাংলাদেশে এই পেশায় আসা শিক্ষকদের বিরাট বোকামি হয়েছে।

শিক্ষা থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *