পহেলা বৈশাখ— বাংলা নববর্ষ। আমরা বাঙালি তাই আমাদের প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। বৈশাখ মানেই উৎসবে মাতোয়ারা বাঙালি। চৈত্র সংক্রান্তি, হালখাতা, মেলা, খেলা, অষ্টমী, ঘুড়ি উৎসব, মুখোশ উৎসব, রঙ মাখামাখি, ঢাক—ঢোল, পান্তা—ইলিশ, বাঙালির চিরায়ত গান আর চিরায়ত বাঙালির সাজ মিলেমিশে একাকার। বৈশাখে আবাল—বৃদ্ধ—বণিতার প্রাণের জোয়ার কি ঢাকায়, কি অজপাড়াগাঁয়।
যুগ যুগ ধরে বাঙালিরা তাদের চেতনায় অন্যতম উৎসব পহেলা বৈশাখকে পালন করছে পরম উৎসাহে। রাজধানী, মহানগর, নগর, বন্দর, শহর, উপশহরে সবখানে উৎসেবর আয়োজনে পুরো বাংলাদেশ সাজে নতুন সাজে। ঢাকাবাসী ছুটে আসে রমনার বটমূলে। নানান রঙের বর্ণিল চ্ছটা শুধু শরীর আর পরিবেশকেই রাঙায় না, মনকেও রাঙিয়ে তোলে বর্ণিল রঙের আবহে। এ যেন ভেতরে বাহিরে বাঙালির প্রকৃত রূপ।
পহেলা বৈশাখ আসার আগে থেকেই আয়োজনের ব্যস্ততা বাড়ে আমাদের। সাজা আর সাজানো নিয়ে নতুন নতুন ভাবনায় ব্যস্ত তারুণ্য। উদ্যম আর উচ্ছাসের সবটুকু ঢেলে দেয় বর্ণিল রঙের ছ্টায়। বৈশাখির চিত্রে দেখা যায়Ñ রমনা ও সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানে নাগরদোলা, ইলিশ—পান্তা, ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসে থাকা, ঢোল, একতারা, ডুগডুগি, বাঁশির সুর আর খই—মুড়ি—মুড়কি, মিষ্টি Ñ সব কিছু মিলিয়ে এক বাঙালি আমেজ।
বৈশাখের প্রথম দিনটা ভালো। ঘরে বাইরে আনন্দের বন্যা, উৎসবের আয়োজন, আর বাঙালি খানাপিনার প্রস্তুতি। সবাই মিলে ইলিশ ভাজা, পান্তা ভাত, কাঁচা পেঁয়াজ আর শুঁটকি ভর্তাÑ কী যে মজা। যে খায় সে জানে। আমরা বাঙালি। বাঙালিত্বই আমাদের চিরায়ত সাদাসিদে রূপ। আমাদের ঘরে বসে পান্তা খেতে দোষের কি আছে! বাঙালি ঢঙে বাঙালি রঙে সাজতে সমস্যা কোথায়! পান্তা খেলেই বাঙালি এমন তো কোনো কথা নেই। বাঙালির আছে কত গৌরবগাঁথা। তা নিয়েই আমরা সাজতে পারি। সাজাতে পারি সবুজ বাংলাদেশ। নববর্ষের এ উৎসব পহেলা বৈশাখ বাঙালির অসাম্প্রায়িক চেতনার প্রতিচ্ছবি। শাড়ি পড়ো, পাঞ্জাবি পড়ো, পড়ো লুঙ্গি- বাঙালি আবেশে।
হাজার বছরের গৌরবের পথে…
আমাদের ইতিহাস—ঐতিহ্য, কৃষ্টি আর সংস্কৃতি মিলেমিশে পহেলা বৈশাখকে দিয়েছে সর্বজনীন উৎসবের নিঢোল রূপ। ধর্ম—বর্ণ নির্বিশেষে বৈশাখ এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব। উৎসব একদিনই হবে। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু চেতনা সারা বছর থাকবে না কেন? আমরা কেন বাঙালি খাবার খাবো না। কেন পড়বো না আমাদের দেশের তৈরি পোষাক। বিদেশি জিনিসের প্রতি আমাদের মোহ অনেক বেড়ে গেছে। মেড ইন বাংলাদেশ কেন নয়, পছন্দের তালিকায়! কেন আমরা বিদেশি গান শুনি! গানের তালে নাচি! আমাদের দেশে কি ভালো গান নেই? আমাদের আছে হাছন রাজার গান। লালন ফকিরের গান। আব্দুল আলীম, আব্বাসউদ্দীনের গান। আমাদের কাঙালি সুফিয়া আছেন। বাউল আবদুল করিম আছেন। আমাদের একতারা আছে। আছে রাখালিয়া বিমোহিত বাঁশির সুর। গ্রাম বাংলায় আছে কেচ্ছার আসর, পঁুথি পাঠ। আমাদের নকশীকাঁথা আছে। এতসব নিয়ে কেন আমরা পরিপূর্ণ বাঙালি হতে পারব না!
আমরা নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর সভ্যতাকে আপন করে নিতে পারছিনা। আমরা আকাশ সংস্কৃতির পিছনে ছুটছি। হাজার বছরের সংস্কতিকে উপেক্ষা করে আমরা কিন্তু বেশি দূর যেতে পারব না। আমাদের ফিরে আসতেই হবে আপন সংস্কৃতির টানে। নববর্ষ মানেই বৈশাখী উৎসব। রবীন্দ্র সরোবরে মুক্তমঞ্চের গান। শিশুপার্কের সামনে গণসঙ্গীত। দিনভর টিএসসিতে গান, আবৃত্তি আর পথনাটক। জাতির বোধ ও বিবেক থেকে অমঙ্গল তাড়ানোর মিছিল ‘মঙ্গল’ শোভাযাত্রা। চারুকলা থেকে বের হয় এই শোভাযাত্রা। মুখোশ, ব্যানার, নাচ—গান সবমিলিয়ে আমাদের মনে করিয়ে দেয় ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’। বাঙালির শুভ হালখাতা, ষাঁড়ের লড়াই, মিষ্টিমুখ, বলিখেলা, লাঠিখেলা আর আমাদের গ্রামীণ বৈশাখী মেলা। আমাদের কি নেই? গান—নাচ—সাজ সবকিছুতেই বাঙালির আভিজাত্য। তারপরও কেন আমরা দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হইনা! উদাসীনতা আর পরশ্রীকাতর হয়ে অবলীলায় আমরা ভুলে যাচ্ছি বাঙলার ঐতিহ্যের কথা। আমাদের গৌরবগাঁথা হাজার বছরের। আমাদের মসলিন, কাঠের পালঙ্ক, পালকি, নকশী পাটি, নকশী পাখা, শীতলপাটি, লাঠিখেলা, গোল্লাছুট, কাবাডি, পালাগান, জারি—সারি, কবিগান, গম্ভীরা, কীর্তন, পুতুল নাচ, মুড়ি—মুড়কি, মিষ্টি—মিঠাই, সুগন্ধি চাল, পিঠা—পায়েশ কতকিছু।
মেলায় যাই—রে…
মেলা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য। লোক সংস্কৃতির সাথে মেলার রয়েছে নিবিড় সখ্যতা। শুধুমাত্র পণ্য বিকিকিনি নয়, মেলার সাথে জড়িয়ে আছে উৎসব অনুষ্ঠান আর বাঙালির আনন্দ মুখরতা। মেলায় বাঙালি শীর্ষে। বাংলাদেশে সারা বছরে ১২০০—র বেশি মেলা হয়। মেলার আছে বিভিন্ন রকম ফের। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের মেলা হয় কুমিল্লার কসবায়, জ্যৈষ্ঠ মাসের দোল পূর্র্ণিমায় দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে বুড়োশিবের মেলা, পৌষ মাসের সংক্রান্তিত শুরু হয়ে ২১ দিন চলে নোয়াখালির নলদিয়ার মেলা, কুষ্টিয়ার বিত্তিপাড়ার ঘোড়া পীরের মেলার কথাও আমরা জানি। তবে বাংলাদেশের প্রধান মেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- বৈশাখী মেলা, রাজপুণ্যার মেলা, আদিবাসীদের বিজু মেলা, গঙ্গার আবির্ভাব উৎসব, বৌদ্ধ মেলা, শিব মেলা, মঙ্গল চন্ডির মেলা, মুহরমের মেলা, রথ মেলা, মানসার মেলা, জন্মাষ্টমীর মেলা, দুর্গাপূজার মেলা, কার্তিকব্রতের মেলা, পৌষপার্বণের মেলা, বসন্ত উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি, বাউল মেলা, বইমেলা, কৃষি মেলা, কম্পিউটার মেলা, বাণিজ্যমেলা, তাঁতমেলা, চামড়া মেলা, মৎস্য মেলা, বিজ্ঞান মেলা, বৃক্ষমেলা প্রভৃতি। বাংলাদেশে নববর্ষ আর বৈশাখ মাসের অন্যান্য দিনে ২৮৩টিরও বেশি নিয়মিত মেলা বসে। দেশের মেলাগুলোর অধিকাংশই বসে গ্রামে—গঞ্জে। তথ্যমতে, ১২০০—এর বেশি নিয়মিত মেলার মাসভিত্তিক চিত্রটি নিম্নরূপ : বৈশাখ—২৮৩টি, জ্যৈষ্ঠ—৪৮টি, আষাঢ়—৭৮টি, শ্রাবণ—৪৮টি, ভাদ্র—৪৮টি, আশ্বিন—৯৩টি, কার্তিক—৫৩টি, অগ্রহায়ন—৫১টি, পৌষ—৯১টি, মাঘ—৭৮টি, ফাল্গুন—৮৭টি এবং চৈত্রমাসে ২৫৯টি মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
মেলায় আছে লাটাই-লাটিম
বাংলার মেলায় বাঙালি পণ্যের পসরা সাজানো হয়। মেলায় পাওয়া যায়— মাটির হাড়ি—পাতিল, কলসি, বাসন—কোসন, মালসা, সরা, ঘটি বাটি, শিশুদের খেলনা— রঙ বেরঙেয়ের হাতি, ঘোড়া, নৌকা, পুতুল, কাঠের— লাঙ্গল—জোয়াল, মই, খাট—পালঙ্ক চেয়ার—টেবিল, সিন্ধুক, পিঁড়ি, বেলনা, লাটাই—লাটিম, খড়ম; বাঁশ—বেতের— কুলা, ডালা, টুকরি, পাখির কাঁচা, দরমা, চাটাই, মাদুর, বাঁশি; লোহার— দা, বটি, খন্তা, কড়াই; খাবারের মধ্যে রয়েছে— মন্ডা মিঠাই, জিলাপি, তক্তি, নাড়ূ, চিড়া, মুড়ি, বরফি, বাতাসা। এছাড়াও শাখাড়ি সম্প্রদায়েরা নিয়ে আসে— শংখ ও ঝিনুকের শাখা, বালা, আঙটি, চুড়ি, নাক ও কানের ফুল। কাচের চুড়ি, আয়না, চিরুনি, ফিতা আর পাশাপাশি মৌসুমি ফল তো আছেই। মেলায় বসে খেলনার শব্দময় ঝংকার। রঙিন বাঁশি, ভেঁপু, ডুগডুগি, একতারা, দোতরা, বেলুন, লাটিম, চরকি, টমটম গাড়ি, ঘুড়ি আরো কত কি। এই যে এতসব বাঙালি ঐতিহ্যের আয়োজন সারা বছরজুড়ে তবুও জাগ্রত হয়না আমাদের বাঙালি সত্তার চেতনা।
শুভ হালখাতা
নববর্ষ ব্যবসায়ীদের বার্ষিক হিসাব মেলানোর দিন। ‘হালখাতা’ আমাদের প্রাচীন বণিক রেওয়াজ। সকল শ্রেণীর ব্যবসায় হিসাবের একটা খাতা থাকে। বছর ব্যাপী লেনদেন করে বছরের শেষ দিনে হিসাব মিটানো হয়। নতুন বছরের প্রথম দিন নতুন খাতা খোলা হয়। তাই নববর্ষ মানুষের প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু। পুরাতন হিসাব চুকিয়ে নতুন হিসাব খোলার দিন। নতুন ভাবে, নতুন উদ্যমে ও পরিকল্পনায় সামনে যাওয়ার দিন। নববর্ষে আমাদের জাতীয় জীবনের প্রত্যাশাও অনেক। দেশ থেকে চিরতরে সন্ত্রাস নির্মূল হোক। শান্তি ফিরে আসুক।
বাঙালির এক স্রোত…
বাংলাদেশের পাহাড়ে, সমতলে ও উপকূলে সকল ধর্ম বর্ণের, জাতির—উপজাতির ব্যবধান ভুলে আমরা বাঙালি, আমরা বাংলাদেশি এই পরিচয়ে অনাবিল উৎসবে মেতে উঠি । এই শুভ দিনে আমরা অঙ্গিকার করবো আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসব। আমাদের দেশ আমরাই গড়বো। আমরাদের দেশের তৈরি পণ্য কিনব এবং এর ব্যবহার নিশ্চিত করব। মেইড ইন চায়না, জাপান, আমেরিকার মানসিকতা পরিহার করব। দেশের খাবার খাবো। দেশের সিনেমা ও নাটক দেখব। দেশের গান শুনব। বিদেশি শিক্ষণীয় সিনেমা নাটকও আমরা দেখব। দেশের বই পড়ব। গ্রামে—পাড়ায়—মহল্লায় না পারলে অন্তত নিজের বাড়িতে নিজের এবং পরিবার ও স্বজনদের জন্য পাঠাগার গড়ে তুলব। আমাদের বংশপরম্পরায় পৈতৃক শেকড় রয়েছে গ্রাম বাংলায়। আমরা বছরে একবারও হলেও গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাব। দেখব গ্রাম বাংলার শ্যামল সৌন্দর্য। আমাদের কাজে—কর্মে, চিন্তা—চেতনায় সবকিছুতে থাকবে সবার আগে দেশ।
এস এম মুকুল : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক