প্রথম পাতা » মতামত » আল মাহমুদ : খণ্ডিত কবিসত্তা

আল মাহমুদ : খণ্ডিত কবিসত্তা

Al Mahmud

‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেলো শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে…
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরে ফিরবো না।’

আমাদের ছেলেবেলায় এ কবিতাটি পাঠ্য ছিল। সম্ভবত সপ্তম শ্রেণিতে। কবিতাটি আমার মনে ব্যাপক দাগ কেটেছিল। এখনো এ কবিতা শুনলে নব্বই দশকের শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাই। মনে পড়ে : আমাদের হাসনা দুলালী আপা মাথা ঝাঁকিয়ে আবৃত্তি করছেন আল মাহমুদের ‘নোলক’ কবিতা।

আল মাহমুদের (১৯৩৬-২০১৯) জন্ম বিশ শতকের ত্রিশের দশকে। পড়ালেখা বেশিদূর হয়নি। মাধ্যমিক পাশ। জন্মেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর পাড়ে। তিতাস নিয়ে তাঁর আবেগমাখা কবিতা ‘তিতাস’ পড়েছি ছোটবেলায়। তিতাসকে কবি দেখেছেন যৌবনের প্রতীক রূপে। ‘একুশের কবিতা’য় তিনি বাঙালির আবহমান কালের সংগ্রামকে করেছেন শিল্পিত :

‘চিনতে নাকি সোনার ছেলে ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে মুক্ত বাতাস কিনতে?’

কবি হিসেবে আল মাহমুদের আবির্ভাব পঞ্চাশের দশকে। তাঁর ‘লোক-লোকান্তর’ (১৯৬৩), ‘কালের কলস’ ( ১৯৬৬), ‘সোনালী কাবিন’ (১৯৭৩), এবং গল্পগ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ (১৯৭৫) পর্যন্ত লেখনীতে মার্কসবাদ, বামপন্থী দর্শন শৈল্পিকরূপ লাভ করেছে। শ্রেণিচেতনার নামে রতিরসের স্বাধীনতা নিয়েছেন তিনি :

‘তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
ক্ষেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারো বেশি ঢেলে দেবো আন্তরিক দরদ
সলাজ সাহস নিয়ে ধরে আছি পট্টময় শাড়ি
সুকণ্ঠি কবুল করো, এ অধমই তোমার মরদ-‘

অবশ্য বৃদ্ধ বয়সে তিনি বেশ ‘ভালো’ হয়ে গিয়েছিলেন! লিখেছেন : ‘আমার বুকের ভেতর ধর্মের কল বাতাসে নড়ে ওঠে।’ যৌবনে পাড়ার মসজিদ ভাঙার খবরে আপ্লুত হয়েছেন : ‘হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে পাড়ার মসজিদ!’ জায়নামাজে বসে পরস্ত্রী সঙ্গমের স্বপ্ন দেখেছেন! কৃষকেরা সচিবালয় দখল করবে এমন স্বপ্নও দেখেছেন। কৃষকদের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে এমন মনোভাব ব্যক্ত করে কবিতা লিখেছেন। কিন্তু পরে সবই তিনি অস্বীকার করেছেন। বলা যায়, তওবা করে মার্কসবাদকে বিদায় জানিয়েছেন। ভিড়েছেন অন্য ইজমে।

কবিদের জীবনে রাজনীতিবিদের মতো স্ট্যান্ডবাজি চলে না। বাংলা সাহিত্যে আল মাহমুদ বিরল কবি যিনি সকলকে ‘খুশি’ করতে পেরেছিলেন। তাঁর মুক্তিযুদ্ধে যোগদান নিয়েও নানা কথাবার্তা শোনা যায়। এইচটি ইমাম ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধান আমলা। তিনি আবার আল মাহমুদের দুলাভাই। শ্যালককে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি কার্ড দিয়েছিলেন। আল মাহমুদ সেই কার্ড গলায় ঝুলিয়ে বেড়াতেন, আত্মগোপনেও থাকতেন! সবই শোনা কথা। আসল সত্য বের হয়নি। কবিও তেমন কিছু জোর দিয়ে বলে যাননি। বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে রহস্যময় অধ্যায় মনে হয় ১৯৭১! এখানে কার ভূমিকা কী ছিল একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।

যুদ্ধের পর আল মাহমুদ বাংলা একাডেমির প্রুফ রিডার থেকে বঙ্গবন্ধুর সুপারিশে শিল্পকলায় অফিসার পদে যোগ দেন। যদিও তাঁর ইন্টারের সার্টিফিকেটও ছিল না। তিনি বঙ্গবন্ধুর বাকশালেও যোগ দিয়েছিলেন। পরে তিনি শিল্পকলার পরিচালকের পদ থেকে অবসরে যান। জিয়াউর রহমানের আমলেও তিনি বেশ ‘সুবিধাজনক’ জায়গায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘কাবিলের বোন’ নামের এক উপন্যাস। জেনারেল জিয়াকে নিয়ে লিখেছেন ‘তৃষিত জলধি’ নামে একটি গল্প। অনেকে বলেন এরশাদের অনেক কবিতা তিনিই লিখে দিয়েছেন! এটা অবশ্য প্রমাণ করা যায়নি। তবে প্রেসিডেন্ট এরশাদ গুলশানে তাঁকে একটি প্লট বরাদ্দ দিয়েছিলেন। এটা প্রেসিডেন্টের বদান্যতাও হতে পারে। জাসদ প্রতিষ্ঠিত ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আবার জামাত প্রতিষ্ঠিত ‘সংগ্রাম’ পত্রিকাতেও কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে কবিদের কেউ কেউ জনসম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। জনবিচ্ছিন্নতাই কবিদের জীবন হওয়া উচিত। জনসম্পৃক্তি রাজনীতিবিদদের কাজ, কবিদের নয়।

আল মাহমুদ পরবর্তীতে জামাত দ্বারা লালিত পালিত হয়েছেন। তাঁর কবিতার আদর্শেরও পালাবদল হয়েছে। তাঁর প্রথমদিকের পাঠকদের জন্য এটি বড় একটি ধাক্কা। আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর ষাটের দশকেই পরিপূর্ণ। এরপরে তিনি আর জ্বলে উঠতে পারেননি। বরং ক্রমশ হারিয়ে গেছেন। তাঁর সময়েও বাংলা সাহিত্যে আরো বড় মাপের কবিরা এসেছেন। যেমন : হেলাল হাফিজ, রফিক আজাদ বা আবদুল মান্নান সৈয়দরা।

বর্তমান বাংলাদেশে আল মাহমুদ এর নাম বেশ জোরে-স্বরে উচ্চারিত হচ্ছে। কেউ তাঁকে প্রধানকবির তকমা দিচ্ছেন। সভা- সেমিনারে আল মাহমুদ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর কিছু অপাঠ্য কবিতা আবৃত্তির চেষ্টা করা হচ্ছে! তাঁর প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন :

‘আল মাহমুদের শুরু পঞ্চাশের দশকে, ষাটের দশকেই তিনি শেষ হয়ে গেছেন।’ যারা এখন তাঁকে ‘বড়কবি’ বানাতে চাচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্য বেশ সুবিধার মনে হচ্ছে না।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *