প্রকৃতির কাছে মানুষ বড়ই অসহায়। মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রযুক্তি দক্ষতায় অনেক কিছু করতে পারলেও বিজ্ঞানের জাদু দিয়ে ভূমিকম্পের মতো এত বড় শক্তিকে কিছুতেই বশে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও মানুষ বুঝতে চায়না যে মহান প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার কাছে বাকি সব তুচ্ছ, নগন্য। এইটুকুন নাড়া দিলে সবটুকুন শেষ— আছে হীম্মত কারো রুধিবে এ প্রলয়ঙ্করি শক্তি!!
ভুমিকম্প নাড়িয়ে তছনছ করে দিয়ে গেল নেপালকে। ধ্বংসলীলায় মৃত্যুপুরীর হাহাকার এখন নেপাল জুড়ে। এর আগে হাইতিকে বানিয়েছিলো মৃত্যুর নগরী। বড় ধরণের নাড়া দিয়ে গেল বাংলাদেশটাকেও। আল্লাহর অশেষ কৃপায় এবার রক্ষা পেল বাংলাদেশ। তবে প্রস্তুত থাকার সতর্ক সংকেত দিয়েছে বৈকি। ভূমিকম্পের কোনো আগাম বার্তা দিতে পারছে না বিজ্ঞান। সুতরাং কখন, কীভাবে ঘটবে, কী পরিণতি হবে কারো জানা নেই। প্রস্তুতি চাই সব সময়ের জন্য।
ভূমিকম্প কেন ঘটে
প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে জ্বলন্ত সূর্য থেকে খসে পড়া একটা আগুনের পিণ্ড হচ্ছে আমাদের এই পৃথিবী। কোটি কোটি বছরে তার ওপরের আস্তরণটা শীতল হয়ে শক্ত হয়েছে। ৬৩৭৮.১ কিলোমিটার গভীরে হচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্র। আর শীতল হয়েছে মাত্র ওপরের প্রায় ৫৫ কিলোমিটার আস্তরণ। খুব সহজ করে ভাবতে গেলে, ঠিক যেন একটা আপেলের চামড়াটা হচ্ছে আমাদের পৃথিবীর মাটি। আর এর ভেতরের রয়েছে জ্বলন্ত, গলন্ত পাথর, ধাতু ইত্যাদির মিশ্রণ।
সমস্যা হচ্ছে এই যে ৫৫ কিলোমিটার আস্তরণ শক্ত হয়ে মাটি হয়েছে তা আবার একত্রে জোড়া লাগানো না। সাতটা টুকরায় এই আস্তরণটা বিভক্ত। প্রত্যেকটা টুকরাকে বলা হয়, টেকটোনিক প্লেট। এই প্লেটগুলো চরম উত্তপ্ত গলিত লাভার ওপর ভাসমান। প্লেটের নিচের হাজার হাজার কিলোমিটার জ্বলন্ত তরল লাভা স্থির বসে নেই। কারণ সাতটা টুকরার ফাঁকে ফাঁকে আছে সাগর, আছে আগ্নেয়গিরির চূড়া। যার কারণে লাভার তাপমাত্রাও পরিবর্তন হচ্ছে নিয়মিত। লাভার ঘনত্ব কম—বেশি হয়ে এরা নিজেরা একটা গতি পায়। এই কারণে গতিময় লাভার ওপরে ভাসমান সাতটা আস্তরণও সঙ্গে সঙ্গে চলতে বাধ্য হয়। সাতটা টেকটোনিক প্লেট যদি মুখোমুখি চলতে থাকে। তাহলে, দুইটা প্লেটের মাঝখানের অংশ চাপ সহ্য করতে না পেরে ওপরের দিকে উঠে যায়। আর তখন স্বাভাবিক কারণেই প্লেট দুটো একটু একটু করে ধাক্কা খাবে। আর তার নামই ভূমিকম্প।
জেনে রাখার মতো ব্যাপার, প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় এক লাখবার ভূমিকম্প হয়। কিন্তু রিখটার স্কেলে যদি এই মাত্রা ৪—এর কম থাকে তাহলে আমরা তা টের পাই না। এই মাত্রা যদি ৭—এর ওপরে হয়, তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয় অত্যাধিক। ৯—এর ওপর হয়, তাহলে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। জাপানে সুনামির সময় এই মাত্রা ছিল ৯.১। গোটা জাপান দেশটিই কয়েক মিটার সরে যায় এর ফলে।
করণীয়
— যদি উঁচু বিল্ডিংয়ে থাকো, তাড়াহুড়া করে নামতে পারবে না। আশপাশের শক্ত কিছু ধরে দাঁড়িয়ে থাক।
— লক্ষ্য রাখবে আশপাশে যেন কাচ বা সহজে ভেঙে যায় কিছু না থাকে।
— ভূমিকম্পের সময় কিছুতেই লিফটে উঠবে না। লিফট মাঝপথে আটকে যেতে পারে বা ছিঁড়ে যেতে পারে।
— রাস্তায় নেমে এলেও খেয়াল রাখবে যেন আশপাশের গাছ, খাম্বা ইত্যাদি মাথায় এসে না পড়ে।
— গাড়িতে থাকলে, গাড়ি রাস্তার পাশে পার্ক করতে হবে। কিছুতেই ব্রিজের নিচে বা বিল্ডিংয়ের আশপাশে পার্ক করবে না।
— স্কুলে থাকলে বইয়ের ব্যাগটি মাথায় ধরে বেঞ্চ বা টেবিলের নিচে বসে পড়বে।
— বাসায় থাকলে মাথায় বালিশ ধরে টেবিল বা খাটের নিচে অথবা বিম বা পিলারের বরাবর দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে হবে।
— আসবাবপত্র না পেলে ঘরের ভেতরের দিকের দেয়ালের নিচে বসে আশ্রয় নিতে পারো। বাইরের দিকের দেয়াল বিপজ্জনক।
— জানালার কাচ, আয়না, আলমারি, দেয়ালে ঝুলানো বস্তু থেকে দূরে থাকা। এগুলো ভেঙে মাথায় পড়তে পারে।
— বহুতল ভবনের ওপরের দিকে অবস্থান করলে ঘরের ভেতরে থাকাই ভাল। কারণ, নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর পূর্বেই ভূমিকম্পের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া নামতে নামতেও ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
— ভূমিকম্প শেষ হলেও আরও কম্পনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রায়ই পরপর কয়েকবার কম্পন হয়। এই আফটার শকের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। এবারের আফটার শক এক ঘণ্টার মধ্যেই দুই বার হতে পারে। কখনও এক মাসের মধ্যেও হতে পারে।
— খোলা জায়গায় আশ্রয় নিতে হবে। বহুতল ভবনের প্রান্তভাগের নিচে কোনোভাবেই দাঁড়াবে না। উপর থেকে খণ্ড পড়ে আহত হতে পারো।
— লাইট পোস্ট, বিল্ডিং, ভারি গাছ অথবা বৈদ্যুতিক তার ও পোলের নিচে দাঁড়াবে না।
অভিভাভকদের করণীয়
— বাড়ির ভেতরে এবং বাইরে নিরাপদ স্থানগুলো চিহ্নিত করে সবাইকে দেখাতে হবে। যাতে ভূমিকম্পের সময় কোথায় আশ্রয় নেবে এ কথা ভাবতে না হয়।
— মাঝে মাঝে ভূমিকম্প ও জরুরি প্রয়োজনে মহরা করলে ভালো হয়, ছোটরাও প্রস্তুতি সম্পর্কে সজাগ হবে।
— ভারী মালপত্র শেলফের নিচের দিকে রাখুন। ঝাঁকুনিতে যেন এগুলো গায়ের ওপর না পড়ে।
— লিক হওয়া গ্যাস লাইন, বৈদ্যুতিক লাইন মেরামত করে নিন এবং নিয়মিত পরীক্ষা করুন।
— অন্ধকারে দেখার জন্য টর্চ রাখুন বাড়ির প্রতিটি কক্ষে ও হাতের কাছে।
সতর্ককতা
— ভয় পেলে চিৎকার চেচামেচি করলে কাজ হবেনা।
— বিপদে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য ও দয়া প্রার্থনা করাই উত্তম।
— পারলে গ্যাসের চুলা, লাইট, ফ্যানের সুইচ বন্ধ করে দিতে হবে।
— ছোট বাচ্চা থাকলে তাকে আগে নিরাপদ করতে হবে।
— বৃদ্ধ বা অসুস্থ লোক থাকলে তাকেউ সাথে সাথে নিরাপদে রাখতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা ভূমিকম্পের সময় নিজে বিভ্রান্ত হবে না, দিকভ্রান্ত হবে না। এতে করে তা আশপাশে ত্বরিত গতিতে ছড়িয়ে যাবে। বিপদের সময় মানুষের যা ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বিপদের গুজবের কারণে।